সব্যসাচী বাগচী: রূপকথায় সাত সমুদ্র তেরো নদী পার করে রানির কাছে পৌঁছে যায় রাজা। তবে এই রূপকথায় রানি আছেন। জলের রানি। ওঁর নাম সায়নী দাস (Sayani Das)। বাস্তবের মাটিতে সাত সমুদ্র পার হওয়া এক প্রকার অসম্ভব। তবে সাত সমুদ্র নাই হোক, চারটি দুর্গম চ্যানেল পার করাও তো মুখের কথা নয়। তবে সেই কঠিন কাজটা আবার করে দেখালেন কালনার সায়নী। মার্কিন মুলুকের মলোকাই চ্যানেল (Molokai Channel) জয় করলেন জলকন্যা। তাও আবার শুধু ভারত নয়। এশিয়ার প্রথম মহিলা সাঁতারু হিসেবে এমন বিশেষ কীর্তি গড়লেন ২৪ বছরের এই কলেজ পড়ুয়া। তবুও তিনি অবসরের কথা ভাবছেন। 


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

মলোকাই চ্যানেল জয়ের লক্ষ্যে ২৯ শে মার্চ মার্কিন মুলুকে পা রেখেছিলেন কালনার সায়নী। এপ্রিল মাসের প্রথম দু’সপ্তাহের মধ্যে মলোকাইয়ের জলে নামার কথা থাকলেও খারাপ আবহাওয়ার কারণে নামতে পারেননি তিনি। তবে শেষ পর্যন্ত অসাধ্য সাধন করলেন এই বঙ্গতনয়া। কনকনে ঠাণ্ডা জলে টানা হাত-পা নেড়ে যাওয়া। সঙ্গে সামুদ্রিক বিষাক্ত প্রাণীর সঙ্গে লড়াই তো ছিলই। তবে সব বাধা পেরিয়ে নজির গড়লেন তিনি। দীর্ঘ সময় জলে থাকার জন্য শরীর একেবারে ক্লান্ত। তবুও এরমধ্যেই জি ২৪ ঘণ্টাকে হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ থেকে একান্ত সাক্ষাৎকার দিলেন জলকন্যা। পাশে ছিলেন ওঁর বাবা রাধেশ্যাম দাস। 


প্রশ্ন: আপনাকে প্রথমেই অভিনন্দন। মালোকাই চ্যানেল জয় করা কতটা কঠিন ছিল? 


সায়নী: যেখানে ইংলিশ চ্যানেল জয় করার সাফল্যের হার ৭৫ শতাংশ, সেখানে মালোকাই চ্যানেল জয় করার সাফল্যের হার মাত্র ৩৫ শতাংশ। ওশিয়ান সার্কিটের মধ্যে এখন দীর্ঘতম চ্যানেল হল মালোকাই। স্বাভাবিক ভাবেই এত বড় চ্যানেল অতিক্রম করা কঠিন ছিল। এই চ্যানেল জয় করার জন্য আমাকে একমাস অপেক্ষা করতে হয়েছে। 


প্রশ্ন: শোনা যায় মালোকাই জয় করার আগে আপনি নাকি মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত ছিলেন! এটা কি সত্যি? 


সায়নী: আসলে ২০২০ সালে মালোকাই চ্যানেলে নামার কথা ছিল। সেইমতো সব ব্যবস্থা করেও রেখেছিলাম। স্পনসরদের সাহায্য পাওয়া ছাড়াও অনেক টাকা ধার করতে হয়েছিল আমার বাবাকে। কিন্তু কোভিডের জন্য সব মাঝপথে থেমে যায়। দুই বছর সময় নষ্ট হয়েছে। এরমধ্যে এ বার হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে এসে আমাকে একমাস অপেক্ষা করতে হয়েছে। এপ্রিল মাসের প্রথম দু’সপ্তাহের মধ্যে মলোকাইয়ের জলে নামার কথা থাকলেও খারাপ আবহাওয়ার কারণে নামতে পারিনি। তাই একটা সময় ভেঙে পরেছিলাম। তবে এখন মালোকাই চ্যানেল জয় করার পর অনেকটা স্বস্তি লাগছে। তবে আমার কাছে এই জয় এখনও স্বপ্ন দেখার মতো। শুরুতে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। 



প্রশ্ন: এত বড় সাফল্যের পর মাত্র ২৪ বছর বয়সে আপনি অবসর নিচ্ছেন! এটা কি সত্যি? 


সায়নী: আসলে 'ওপেন সুইমিং' ছাড়া আমি লেখাপড়াকেও সমান গুরুত্ব দিয়ে থাকি। এই মুহূর্তে অ্যানথ্রোপোলজিতে মাস্টার্স করছি। ভবিষ্যতে রিসার্চ করার ইচ্ছা আছে। তাই আপাতত চ্যানেল সুইমিং থেকে কয়েক বছরের জন্য অবসর নিচ্ছি। তবে এর আগে নিউজিল্যান্ডের একটি চ্যানেল জয় করার ইচ্ছা আছে। 


প্রশ্ন: মালোকাই জলে নিজের নাম লেখাতে কত সময় লেগেছিল? 


সায়নী: এখনও আমার কাছে সরকারি তথ্য নেই। সার্টিফিকেট হাতে পেতে সময় লাগবে। তখন বিস্তারিত জানতে পারব। তবে আমার ধারণা ১৯ ঘণ্টা লেগে গিয়েছিল। 


 



প্রশ্ন: মালোকাই জয় করার পর পরিবার ছাড়া আর কাকে ধন্যবাদ জানাতে চান? 


সায়নী: আমেরিকার হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে টানা বাইশ দিন থাকাকালীন অবস্থায় অনুশীলনে খামতি রাখিনি। মলোকাই চ্যানেল সুইমিং অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট বিল গোডিং আমাকে দায়িত্ব নিয়ে যেমন অনুশীলন করিয়েছেন। তেমনই প্রতিটিক্ষণে আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতির উপর নজর রেখেছেন আমার পাইলট ম্যাথিউ বাকম্যান। ওঁরা পাশে না থাকলে বিশ্ব মঞ্চে নিজেকে ফের একবার তুলে ধরতে পারতাম না। তাই ওঁদের প্রতি কৃতজ্ঞ। 


প্রশ্ন: ইংলিশ, রটনেষ্ট ও ক্যাটলিনার পর এ বার মালোকাই চ্যানেল জয় করলেন। আপনি কতটা তৃপ্ত? 


সায়নী: অবশ্যই তৃপ্ত। কারণ আমি যে পরিবার ও পরিবেশ থেকে উঠে এসেছি, সেখানে কেউ এমন নজির গড়ার কথা ভাবতেই পারেনা। কিন্তু আমার বাবা সব সময় সাহস জুগিয়ে গিয়েছেন। এই চ্যানেলগুলোতে নামার জন্য অনেক অর্থ দরকার। সাফল্য পেলে সবাই আলোচনা করেন। কিন্তু আর্থিক সাহায্যের সময় অনেকেই এগিয়ে আসেন না। চারটি চ্যানেলে নামার জন্য টাকা জোগাড় করতে গিয়ে কত অসুবিধা হয়েছে সেটা বলে প্রকাশ করা যাবে না। আমার ইচ্ছা পুরণ করার জন্য বাবা-মা অনেক কিছু ত্যাগ করেছেন। বাবা সরকারি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। তবুও নিজের সাধ্যের বাইরে গিয়ে বাবা আমার সাফল্য দেখতে চেয়েছেন। নিজেদের বাড়ি বন্ধক দেওয়া ছাড়া বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়দের কাছ থেকে টাকা ধার করেছেন। তাই এই চ্যানেল জয়গুলো আমাকে আলাদা তৃপ্তি দেয়। 



প্রশ্ন: চারটি চ্যানেলের মধ্যে কোনটা সবচেয়ে কঠিন ছিল? 


সায়নী: দেখুন সব চ্যানেল জয়ই কঠিন। কারণ প্রতিটি চ্যানেলের আবহাওয়া, পরিস্থিতি একেবারে আলাদা। তাছাড়া যে প্রতিযোগী চ্যানেলে নামতে চলেছে তার মানসিক ও শারীরিক অবস্থা সেই সময় কেমন থাকে সেটাও কিন্তু এখানে বড় ফ্যাক্টর। ২০১৭ সালে ইংলিশ চ্যানেলে নামার সময় আমাকে কেউ চিনতেন না। ফলে টাকা জোগাড় করতে কালঘাম ছুটে গিয়েছিল। এরপর বাকি তিনটি চ্যানেলে নামার আগে ইংলিশ চ্যানেল জয় আমাকে অনেকটা সাহায্য করেছিল। তবে পুরোপুরি নয়। কারণ এমন খেলায় অর্থ কিংবা স্পনসর জোগাড় করা খুব কঠিন। সবমিলিয়ে 'ওপেন ওয়াটার সুইমিং' খুবই সাধনার ব্যাপার। কারণ এখানে নিজেকেই সাঁতার কাটতে হয়। আমার হয়ে কেউ পারফরম্যান্স করে দেবে না। 


প্রশ্ন: গঙ্গার জলে থেকে সাঁতার কাটা থেকে একাধিক চ্যানেল জয়, এই সফরটা কেমন? 


সায়নী: আসলে ছোটবেলা থেকে বিশেষ সুযোগ সুবিধা পাইনি বলেই মানসিক ভাবে আমি খুব শক্তিশালী। সেইজন্যই হয়তো একের পর এক হার্ডেল পার করেছি। ছোট থেকে সবকিছু সহজে পেয়ে গেলে এত কম বয়সে চারটি চ্যানেল জয় করতে পারতাম না। আমাদের দেশে 'ওপেন সুইমিং'-এর অনুশীলন করার জন্য সঠিক পরিকাঠামো নেই। সেখানে বিদেশে 'এন্ডলেস পুল'-এ 'ওপেন সুইমিং' অনুশীলন করানো হয়। প্রতিযোগীদের সুস্থ ও ফিট রাখার জন্য বিশেষ ধরনের মাসাজ দেওয়া হয়। সেগুলোর নামই জানি না! 


প্রশ্ন: কলকাতা ফের একবার আপনার অপেক্ষায় রয়েছে। জলকন্যা আপনি কবে ফিরছেন? 


সায়নী: ১ মে আমাদের বিমান ধরার কথা। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ৩ মে সন্ধে ৭:৪০ মিনিট নাগাদ দমদম বিমানবন্দরে নামব। 


আরও পড়ুন: Sayani Das created history: Malokai channel চ্যানেল জয় করে রেকর্ড গড়লেন কালনার জলকন্যা


আরও পড়ুন: Wriddhiman Saha, IPL 2022: ব্যাটেই জবাব দিয়ে 'ব্রাত্য' পাপালির বার্তা, এখনও ফুরিয়ে যাইনি...


(Zee 24 Ghanta App দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির লেটেস্ট খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Zee 24 Ghanta App)