FIFA World Cup 2022, BRA vs CAM: আফ্রিকার সিংহের গর্জনে চূর্ণ সাম্বার দম্ভ, মূক দর্শক নেইমার, এবার সামনে দক্ষিণ কোরিয়া
তারকা ট্যাগ লাগানো মানুষরা তো এমনই হন। তাঁরা মঞ্চে পা রাখলেই সব আলো নিজের দিকে শুষে নেই। নেইমার তো এই ব্রাজিল দলের শুধু `তারা` নন। তিনি তো তিতে-র দলের `মহাতারকা`। এই সেলেকাওদের স্কোয়াডে নেইমার ছাড়া আরও আট স্ট্রাইকার আছেন। ওঁরা সবাই নিজেদের দিনে ম্যাচ জিতিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। তবে রুক্ষ ও সত্য বাস্তব হল, বাকিরা কেউ নেইমার নন।
সব্যসাচী বাগচী
ক্য়ামেরুন: ১ ('৯২ ভিনসেন্ট আবুবাকার)
ব্রাজিল: ০
ভিনসেন্ট আবুবাকার (Vincent Aboubakar) । এই নামটা অনেকদিন মনে রাখবেন তিতে (Tite)। ভিনসেন্ট আবুবাকার। এই নামটা কোনওদিন ভুলতে পারবেন না নেইমার জুনিয়র (Neymar Jr)। খেলা ৯০ মিনিট পর্যন্ত গোলশূন্য। মনে করা হচ্ছিল ঘুমপাড়ানি ড্র ম্যাচের একমাত্র আকর্ষণ তাহলে নেইমারই হতে চলেছেন। ঠিক এমন মোক্ষম সময় দুরন্ত ছন্দে এগিয়ে গেল ক্যামেরুন (Cameroon)। ক্যামেরুনের হয়ে হেড করে গোল করেন আবুবাকার। সুন্দর বল ইন এবং আবুবকরের দুর্দান্ত প্রচেষ্টা। জার্সি খুলে সেলিব্রেট করতে গিয়ে দ্বিতীয় হলুদকার্ড দেখেন তিনি। লালকার্ড হয়ে যাওয়ায় মাঠের বাইরে বের হয়ে যেতে হয় তাঁকে। তবে তাতে কি। তাঁর গোলের জন্য ব্রাজিলকে (Brazil) ০-১ গোলে হারিয়ে মাঠ ছাড়ল ক্যামেরুন। তবে তাতে ব্রাজিলের কোনও অসুবিধা হয়নি। আগামি ৬ ডিসেম্বর দক্ষিণ কোরিয়ার (South Korea) বিরুদ্ধে প্রি কোয়ার্টার ফাইনালের যুদ্ধে নামবে সেলেকাওরা।
একাধিক চোট ও অজানা জ্বরে আক্রান্ত হওয়া ম্যাচ উইনারদের বিশ্রাম দিয়েছিলেন তিতে। নতুন ১০জনকে নামিয়ে দিয়েছিলেন ক্য়ামেরুনের বিরুদ্ধে। আগেই নক আউটের টিকিট হাতে চলে এসেছিল। তাই বাড়তি ঝুঁকি নিতে রাজি ছিলেন না ব্রাজিলের 'বস'। তবে এমন একটা দল নামিয়ে তেমন লাভ হল না। গোটা ম্যাচে দানি আলেভেজের দলে সেই দর্শনীয় ফুটবলের দেখা মিলল না। ১০টি কর্নার পেয়েও কাজে লাগাতে ব্যর্থ ফ্রেড, গ্য়াব্রিয়েল জেসুসরা। আপাতদৃষ্টিতে ম্যাচটা একেবারে ঘুমপাড়ানি বলে মনে হলেও, লুসেল স্টেডিয়ামে নিজের সেরা তারকা নেইমার জুনিয়রকে নিয়ে এসে নক আউটের লড়াইয়ের আগে বিপক্ষ দলগুলোকে বড় স্টেটমেন্ট দিলেন তিতে। তাই স্কোরলাইন ব্রাজিলের বিপক্ষে গেলেও, এই ম্যাচ দেখতে আসা অগণিত মানুষদের কিন্তু 'পয়সা ওয়াসুল'। কারণ সেলেকাওদের হার্টথ্রব স্বমহিমায় ফেরার জন্য একেবারে তৈরি হয়ে আছেন।
তারকা ট্যাগ লাগানো মানুষরা তো এমনই হন। তাঁরা মঞ্চে পা রাখলেই সব আলো নিজের দিকে শুষে নেই। নেইমার তো এই ব্রাজিল দলের শুধু 'তারা' নন। তিনি তো তিতে-র দলের 'মহাতারকা'। এই সেলেকাওদের স্কোয়াডে নেইমার ছাড়া আরও আট স্ট্রাইকার আছেন। ওঁরা সবাই নিজেদের দিনে ম্যাচ জিতিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। তবে রুক্ষ ও সত্য বাস্তব হল, বাকিরা কেউ নেইমার নন। নেইমার হতেও পারবেন না। তাই তো ক্য়ামেরুনের ম্যাড়ম্যাড়ে বিরুদ্ধে ম্যাচে মাঠে থাকা ব্রাজিলের ফুটবলাররা নন, সাইডলাইনের ধারে দাঁড়িয়ে ঠাট্টা করা, বল পায়ে একটু-আধটু স্কিল দেখানো এবং গ্যালারির সিটে মাথায় টুপি পরে বসে থাকা ৩০ বছরের ছেলেটাই লুসেল স্টেডিয়ামে আসল নায়ক।
২০১৪ সালে বিশ্বকাপ খেলতে শুরু করেছিলেন নেইমার। সেবার নিজের দেশ ব্রাজিলে কাপ যুদ্ধ আয়োজন করা হয়েছিল। কেরিয়ারে তৃতীয় এবং সম্ভবত শেষ বিশ্বকাপ খেলছেন এবার কাতারে। এরমধ্যে শুধুই বিশ্বকাপে মোট ৫৩ ফাউলের শিকার হয়েছেন। বিপক্ষ ডিফেন্ডারদের এমন নির্দয় মারের শিকার হতে হয়নি লিওনেল মেসি-ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোকেও সর্বোচ্চ আসরে। যদিও নেইমারকে দ্রুত ফিট করে তোলার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল অ্যারোনটিক্স অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের প্রযুক্তির সাহায্য নিয়েছে তিতে-র মেডিক্যাল স্টাফরা।
সার্বিয়া খুব সুপরিকল্পিতভাবে নেইমারের বিরুদ্ধে 'মাত্র' ১২ বার ফাউল করেছিল! যেখানে ব্রাজিলের বিরুদ্ধে মোট ফাউলের সংখ্যাই ছিল ১৫! বিশেষ বিশেষ ফুটবলারকে বেছে বেছে ফাউলের সেরা নিদর্শন। ২০১৪ বিশ্বকাপে যেমন ছিলেন কলম্বিয়ার (Colombia) জুয়ান জুনিগা (Juan Zuniga), ২০২২-এ সেই ভূমিকায় সার্বিয়ার (Serbia) নিকোলা মিলেনকোভিচ (Nikola Milenkovic)। তাঁর ফাউলেই আপাতত অনিশ্চিত হয়ে নেইমারের কাতার-ভবিষ্যৎ। জুনিগা সেবার কোয়ার্টার ফাইনালে নেইমারকে বিচ্ছিরিভাবে ফাউল করেছিলেন। নেইমারের ভার্টিব্রা ভেঙে যায়। কাপ যুদ্ধ থেকে ছিটকে যান তিনি। তবে এবার আর তেমন মন খারাপ করে দেওয়া ঘটনা ঘটতে দেখা গেল না।
অবশ্য সব লড়াই জেতার নেপথ্যে পার্শ্ব নায়করা থাকেন। সার্বিয়ার ডিফেন্ডারদের ১২টি ফাউল হজম করে নেইমারের গোড়ালি যখন 'ঢোল' হয়ে ফুলে আছে, তখন তাঁকে মাঠে ফিরিয়ে আনার জন্য দিনরাত লড়ছিল দলের মেডিক্যাল টিম। নেইমারের প্রতিটা পদক্ষেপের উপর কড়া 'মার্কিং' রাখছিলেন তাঁর পিতৃসম কোচ তিতে। সুইৎজারল্যান্ডের বিরুদ্ধে দল খেলতে নামার সময় তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, নেইমার ফিরবেন? ইউরোপীয়দের পরিকল্পিত ফাউলের বিরুদ্ধে একরাশ ক্ষোভ দেখিয়েছিলেন। এমনকি ফিফা-র হস্তক্ষেপও দাবি করে সাংবাদিক বৈঠকে বলেছিলেন, 'অবিলম্বে নেইমারকে ফাউল করা বন্ধ হোক। যদি ফুটবল উৎসব হিসাবে উদযাপিত হয়, সবার আগে এমন বিচ্ছিরি ফাউল বন্ধ করতে হবে। এভাবে চলতে পারে না।' যদিও নেইমার এবং রাইট ব্যাক দানিলোর বিশ্বকাপ ভবিষ্যৎ নিয়ে আদৌ চিন্তিত নন তিতে। সেটাও জানাতে ভোলেননি। তাঁর ফের প্রতিক্রিয়া, 'মেডিক্যালি বা ক্লিনিকালি কিছু বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। জানিই না। কিন্তু যা জেনেছি বা দেখছি, দুজনেই ফিরে আসার চেষ্টায় আন্তরিক। এবং এই বিশ্বকাপেই ওদের আবার খেলতে দেখব, নিশ্চিত।'
ব্রাজিল কাপ জয়ের হেক্সা দেশে ফিরবে কিনা সেটা বলার সময় এখনও আসেনি। তবে নেইমার এদিন লুসেল স্টেডিয়ামে নামিয়ে দিয়ে তিতে ও তাঁর টিম ম্যানেজমেন্ট বিপক্ষদের একটা বড় স্টেটমেন্ট দিলেন। কারণ তিতে-এর থেকে ভালো কে জানতেন যে নেইমার ফিরে আসবেন। ক্য়ামেরুন ম্যাচের আগে ব্রাজিলের প্রচারমাধ্যম বাজারে ছড়িয়ে দিয়েছিল একটা খবর। 'নেইমারের বিশ্বকাপ অভিযান শেষ!' তিতে প্রতিবাদ করেননি। বরং বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে নেইমারের ফিটনেস ট্রেনিং করার ভিডিয়ো সোশ্যাল মিডিয়াতে ছেড়ে দেন। ম্যাচের কয়েক ঘন্টা আগে ব্রাজিল ফুটবল ফেডারেশনের তরফে একটি ভিডিয়ো প্রকাশ করা হয়েছিল। নেইমার হালকা ট্রেনিং শুরু করেছেন। ব্যস পুরো ব্যাপারটা ঘুরে যায়। ফের একবার নেইমারের কামব্যাকের প্রহর গুনতে শুরু করে দিল সবাই। দ্বিতীয় রাউন্ডেই ব্রাজিলের 'নাম্বার টেন' মাঠে নেমে যাবেন? সেই মুহূর্ত দেখার অপক্ষায় রয়েছে ফুটবল দুনিয়া।
২০১৪ সালের বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে কলম্বিয়ার বিরুদ্ধে খেলার সময় চোট পেয়েছিলেন নেইমার। ভার্টিব্রাতে গুরুতর চোট লাগার জন্য তাঁকে স্ট্রেচারে শুয়ে মাঠ ছাড়তে হয়েছিল। এরপর নিজের দেশে সেমি ফাইনালে জার্মানির বিরুদ্ধে ১-৭ গোলে হারের লজ্জা হজম করেছিল ব্রাজিল। সেই হারের যন্ত্রণা এখনও ভোলেননি অগণিত সেলেকাও সমর্থক। অনেকেই মনে করেছিলেন এবারও নেইমারের তেমনই পরিণতি হবে! তবে নেইমার বুঝিয়ে দিলেন তিনি শেষ হয়ে যাননি। এবার দক্ষিণ কোরিয়ার বিরুদ্ধে তাঁকে তিতে নামিয়ে দেন কিনা সেটাই দেখার।
(Zee 24 Ghanta App দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির লেটেস্ট খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Zee 24 Ghanta App)