FIFA World Cup 2022, BRA vs KOR: হলুদ সাম্বা ঝড়ে গোলের উৎসব, `রেড ড্রাগন`-দের হেলায় উড়িয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে নেইমারের ব্রাজিল
লিগ পর্বের শেষ ম্যাচে পর্তুগালের বিরুদ্ধে ২-১ গোলে দক্ষিণ কোরিয়ার জয়, এবং ক্যামেরুনের অখ্যাত আবুবাকারের হানায় তিতে-র ব্রাজিলের ১-০ গোলে লজ্জার পরাজয়। সঙ্গে তো চোট-আঘাতের জন্য দলের অবস্থা `মিনি হাসপাতাল` হয়ে যাওয়া আছেই। সবমিলিয়ে ব্রাজিল শিবিরে দুটি ব্যক্তি ব্যাপক চাপে ছিলেন।
সব্যসাচী বাগচী
ব্রাজিল: ৪ ('৭ ভিনিসিয়াস জুনিয়র, '১৩ নেইমার-পেনাল্টি, ২৯' রিচার্লিসন, '৩৬ লুকাস পাকুয়েতা)
দক্ষিণ কোরিয়া: ১ ('৭৬ পাইক সেউং-হো)
সাও পাওলোর অ্যালবার্ট আইনস্টাইন হাসপাতাল থেকে কাতারের স্টেডিয়াম ৯৭৪-এর দুরত্ব ১৫, ৪৩৩ কিলোমিটার। অথচ দুই গোলার্ধের দুটি জায়গা একজনের জন্য মিলেমিশে একাকার। নক আউট যুদ্ধের আগে পেলে (Pele) নতুন প্রজন্মের ব্রাজিলকে (Brazil) শুভেচ্ছাবার্তা পাঠিয়েছিলেন। ১৯৫৮ সালের বিশ্বকাপের একটি ছবি ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করে লিখেছিলেন, '১৯৫৮ সালে সুইডেনের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে আমি আমার বাবাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতির কথা ভাবছিলাম। আমি জানি, ব্রাজিল দলের অনেকেই এবার এমন প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। প্রথম বিশ্বকাপের স্বপ্নও দেখছেন।' মাঠে ঢোকার আগে তিতে-র (Tite) দলের কতজন পেলে-র সেই পোস্ট দেখেছেন জানা নেই, তবে এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যে পেলে শুভেচ্ছাবার্তা না দিলেও এই দলটা দক্ষিণ কোরিয়াকে (South Korea) হেলায় ৪-১ ব্যবধানে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে চলে যেত। যদিও এবার নেইমারদের (Neymar Jr) প্রতিপক্ষ লুকা মদ্রিচের (Luka Modric) ক্রোয়েশিয়া (Croatia)। ৯ ডিসেম্বর ভারতীয় সময় রাত ৮:৩০ মিনিটে মুখোমুখি হবে দুই দল। তবে আর একটা 'ফাইনাল' খেলতে নামার আগে তারুণ্যে ভরা ব্রাজিল দল, তাঁদের তিনবারের বিশ্বকাপ জয়ী কিংবদন্তিকে দারুণভাবে শ্রদ্ধা নিবেদন করল। ম্যাচ শেষ হতেই পুরো দল একটা ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। সেই ব্যনারে লেখা, 'পেলে'।
সাম্বা ঝড়ে মাত্র ২৯ মিনিটে খেল খতম। সরি ভুল লিখলাম। ১৩ মিনিটে নেইমারের মাটি ঘেঁষা শট বিপক্ষের জালে ঢুকতেই এশিয়ার 'রেড ড্রাগন'-দের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ একেবারে চুপসে গেল। মাইক হাতে নেওয়া ধারাভাষ্যকার বলেই ফেললেন, 'ম্যাচটা তো এখানেই শেষ। ব্রাজিলকে জয়ী ঘোষণা করে দিলেই তো ল্যাটা চুকে যায়!' এমনিতে ৯০ মিনিটের যুদ্ধে ব্রাজিল ও দক্ষিণ কোরিয়ার তুলনাই চলে না। ব্যাপারটা ইস্টবেঙ্গল ও গয়েসপুর এফসি-র মতো হয়ে যায়। অতীতে দুই দলের লড়াইয়ের ইতিহাসেও সেলেকাওদের জয়জয়কার।
তবুও লিগ পর্বের শেষ ম্যাচে পর্তুগালের বিরুদ্ধে ২-১ গোলে দক্ষিণ কোরিয়ার জয়, এবং ক্যামেরুনের অখ্যাত আবুবাকারের হানায় তিতে-র ব্রাজিলের ১-০ গোলে লজ্জার পরাজয়। সঙ্গে তো চোট-আঘাতের জন্য দলের অবস্থা 'মিনি হাসপাতাল' হয়ে যাওয়া আছেই। সবমিলিয়ে ব্রাজিল শিবিরে দুটি ব্যক্তি ব্যাপক চাপে ছিলেন। প্রথমজন হেড কোচ তিতে হলে, দ্বিতীয় ব্যাক্তির নাম এক ও অদ্বিতীয় নেইমার। স্টেডিয়াম ৯৭৪-এর ফলাফল উলটো হলে তিতে এবং তাঁর সেরা ফুটবলারের যে গর্দান দেশজ মিডিয়া নিয়ে নিত, সেটা আর লেখার অপেক্ষা রাখে না। তবে প্রি কোয়ার্টার ফাইনালের ম্যাচে তেমন কিছু ঘটেনি। বরং বিপক্ষকে হেলায় হারিয়ে এবং প্রতিটি গোলের জন্য আলাদা রকমের স্টাইলে নেচে হলুদ রঙে ভরে ওঠা গ্যালারিকে চরম আনন্দ দিল সেলেকাওরা।
সার্বিয়ার বিরুদ্ধে গোল এসেছিল ৬২ মিনিটে। সুইৎজারল্যান্ডের বিরুদ্ধে গোলের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল ৮৩ মিনিট পর্যন্ত। এবার গোল এল মাত্র সাত মিনিটে। ডান দিক থেকে বিপক্ষের ডিফেন্ডারকে অনায়াসে ভাঁজ দিয়ে রাফিনহার একটি দুর্দান্ত পাস দেন ভিনিসিয়াস জুনিয়রকে। সেই বলকে জালে ঢুকিয়ে দিতে ভুল করেননি রিয়াল মাদ্রিদের তারকা। ১-০ গোলে এগিয়ে যায় ব্রাজিল।
সেই গোলের ধাক্কা থেকে বেরোনোর আগেই ফের ধাক্কা খেল দক্ষিণ কোরিয়া। জাঙ উইয়ং-এর ভুলের জন্য। বক্সের মধ্যে রিচার্লিসনকে ফাউল করলেই পেনাল্টি দেয় রেফারি। অতি সাধারণ পেনাল্টি থেকে গোল করার তো অনেকেই ছিলেন। তবে অধিনায়ক থিয়াগো সিলভা তাঁর সবচেয়ে বড় যোদ্ধা নেইমারকে ডেকে নেন। বলে চুমু খেয়ে শট মারতেই বাকিটা ইতিহাস। ব্রাজিল তখন ২-০ ব্যবধানে এগিয়ে গিয়েছে।
নেইমারের এই পেনাল্টি থেকে গোল তো নিছক তাঁর ঝুলিতে গোলের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া নয়। এই গোলটা করে অনেক নিন্দুকদের জবাব দিলেন তিনি। এই তো কয়েকদিন আগে ব্রাজিলের একাধিক সংবাদমাধ্যম লিখেই দিয়েছিল যে, 'নেইমারের বিশ্বকাপ অভিযান শেষ!' খবরটা যে কত বড় ভুয়ো সেটা বারবার প্রমাণ করে দিলেন 'পোস্টার বয়'। আর তাই তো গোল করেই ছুটে গিয়েছিলেন গ্যালারিতে। কারণে সেখানে যে বসে ছিল তাঁর অভিন্নহৃদয় বন্ধু আলেক্স টেলেস। এই আলেক্স টেলেস যে হাঁটুর চোটের জন্য ইতিমধ্যেই কাপ যুদ্ধ থেকে ছিটকে গিয়েছেন। চোটের জন্য বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে যাওয়ার যন্ত্রণা তাঁর থেকে ভালো আর কে জানেন। চার বছর আগে তাঁরও যে এমনই পরিণতি হয়েছিল।
অবশ্য চ্যালেঞ্জ শুধু নেইমারের কাছে ছিল না। তিতে-কেও তো গত নয়-দশ দিনে অনেক কিছু নেতিবাচক মন্তব্য, কটাক্ষ হজম করতে হয়েছে। তবুও ৬১ বছরের মানুষটা শুধু সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করেছেন। নেইমারকে যাতে নক আউটের আগে ফিট করা যায়, সেইজন্য তাঁকে তুলে দিয়েছিলেন দলের মেডিক্যাল বিভাগের কাছে। নেইমারকে দ্রুত ফিট করে তোলার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল অ্যারোনটিক্স অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (NASA) প্রযুক্তির সাহায্য নিয়েছিল তিতে-র মেডিক্যাল স্টাফরা। নেইমারের ফিজিওথেরাপির কাজে 'কমপ্রেশন বুট' (Compression Boot) নামের এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছিল। যা কাজে লেগেছে।
এবার এল রিচার্লিসনের পালা। সেই রিচার্লিসন, যিনি সার্বিয়ার বিরুদ্ধে জোড়া গোল করেছিলেন। এরমধ্যে সেই ম্যাচে দ্বিতীয় গোল এসেছিল সাইড ভলিতে। ২৯ মিনিটে হয়ে যাওয়া এদিনের গোলটাও দেখার মতো। তিনি যে মেজাজে গোলটা করলেন, সেটা সম্ভবত এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপের সেরা গোলই। ক্রসে থেকে পাওয়া বল নিজের মাথায় তিনবার বাউন্স করিয়ে মার্কিনিওসকে পাস দিলেন। মার্কিনিওসের কাছ থেকে থিয়াগো সিলভার পা ঘুরে আবার রিচার্লিসনের পায়ে বল, গোলকিপার রিঅ্যাক্ট করার আগেই 'শট অন টার্গেট'। ব্রাজিল ততক্ষণে ৩ গোলে এগিয়ে গিয়েছে। প্রথম দুটি গোলের মতো এবারও সাইড লাইনের ধারে গিয়ে শুরু হল সাম্বা নাচ। সেই নাচের তালে আবার 'বুড়ো' তিতেও কিছুটা নেচে নিলেন। ওদের দেখে তখন গ্যালারিও নাচছে। গাইছে। নেচেই চলেছে। গেয়েই যাচ্ছে।
তিন গোল কড়ে ব্রাজিল যেন রুপকথার কাহিনী লিখতে শুরু করেছিল! গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে ক্যামরুনের কাচে হেরেছিল যে দল, আর যে টিমটা দক্ষিণ কোরিয়াকে কাঁদিয়ে ছাড়ছে- এর মধ্যে আকাশপাতাল তফাৎ। পাকুয়েতার দুরন্ত একটি গোলে ৪-০ করল ব্রাজিল। ৩৬ মিনিটে ভিনির পাস থেকে দলের চতুর্থ গোলটা করে পাকুয়েতা একেবারে বিধ্বস্ত করে দেন সন হিউং-মিনদের। তারাও বুঝে যান, এই ম্যাচে বাকি সময়টা শুধু নিয়মরক্ষার জন্য খেলে যেতে হবে তাঁদের। সেই গোলটার পর শুধু আলোচনা হচ্ছিল, ব্রাজিল কত ব্যবধানে জিতে শেষ আটে যেতে পারে। তবে ৭৬ মিনিটে ব্যবধান কমান পাইক সেউং-হো। যদিও ম্যাচের ভাগ্য ততক্ষণে নির্ধারিত হয়েই গিয়েছিল।
এই জয়ের মাঝে একটা ছবি বারবার ভসে উঠছিল। একেক গোলের পর একেক ধরণের নাচ। এই রকম দশ রকমের নাচ নিয়ে নাকি সেলেকাওরা তৈরি হয়ে এসেছে। আমরা সাম্বা দেখেছি। কাতারে কার্নিভাল ব্রাজিল কোন পর্যায়ে নিয়ে যান সেটা দেখার অপেক্ষায় থাকব। এবার শেষ আটে প্রতিপক্ষ গতবারের রানার্স ক্রোয়েশিয়া। ৯ ডিসেম্বর ভারতীয় সময় রাত ৮:৩০ মিনিটে মুখোমুখি হবে দুই দল।
(Zee 24 Ghanta App দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির লেটেস্ট খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Zee 24 Ghanta App)