সব্যসাচী বাগচী: বছর দুয়েক আগের কথা। ইস্টবেঙ্গলের শতবর্ষের অনুষ্ঠানে মজিদ বিসকার আসবেন। ভারতে খেলতে আসা বিদেশিদের মধ্যে মজিদ নাকি সর্বশ্রেষ্ঠ! জোসে র্যমিরেজ ব্যারেটোর স্কিল, নিষ্ঠা ও নিয়মানুবর্তিতাকে মাথায় রেখেও মজিদকে সবার উপরে রাখেন ময়দানের একাধিক প্রাক্তন ফুটবলার। 


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

কেমন ছিলেন আটের দশকের বেতাজ বাদশা? খুব অল্প সময়ে কতটা প্রভাব ফেলেছিলেন? এই সব উত্তরের আশায় সদ্য প্রয়াত সুরজিৎ সেনগুপ্তের কাছে গিয়েছিলাম। স্মৃতির ঝাঁপি উপুড় করে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, "১৯৮০ সাল। ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের তৎকালীন কর্মকর্তারা বাঙালি প্লেয়ারদের দল থেকে তাড়ানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলেন। কিছু প্লেয়ারকে তো বলে দেওয়াও হয়েছিল যে, তাদের আর দরকার নেই। নিরুপায় হয়ে আমরা কয়েকজন প্লেয়ার একসঙ্গে ইস্টবেঙ্গল ছেড়ে মহমেডান স্পোর্টিং–‌এ চলে গিয়েছিলাম। 


আমাদের ছেড়ে আসা জায়গায় কলকাতার কিছু প্লেয়ারকে নিল ইস্টবেঙ্গল। এ ছাড়াও তিনজন বিদেশি এসে ইস্টবেঙ্গলে যোগ দিল। আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে ইরান থেকে পড়তে এসেছিল তিনজন— মজিদ, জামশিদ আর খাবাজি। এই তিনজনই ছিল ফুটবলার। খোঁজ পেয়ে ইস্টবেঙ্গল তিনজনকেই সই করাল। ওরা কেমন প্লেয়ার, সে সম্পর্কে কারওরই কোনও ধারণা ছিল না। দলের সঙ্গে অনুশীলন শুরু করার পর ধীরে ধীরে বোঝা গেল কে কেমন। খাবাজি খেলত মিডফিল্ডে। আর জামশিদ আর মজিদ খেলত স্ট্রাইকারে। কিছুদিন পরে বোঝা গেল খাবাজি আর জামশিদ মোটামুটি সাধারণ মানের ফুটবলার। কিন্তু মজিদের অনুশীলন দেখেই অনুমান করা যাচ্ছিল, সে অসাধারণ। আমি মহমেডানের হয়ে দ্বিতীয় ম্যাচ খেলতে নেমেই হাঁটুতে আঘাত পেলাম। হাঁটুতে অপারেশন করতে হল। আহত অবস্থায় বাড়িতে বসেই শুনতে পাচ্ছিলাম এবং কাগজে পড়ছিলাম মজিদের কথা।" 


আরও পড়ুন: Surajit Sengupta Passed Away: ৭৫-এর ডার্বিতে কোন অপমানের বদলা নিয়েছিলেন 'শিল্পী' সুরজিৎ? স্মৃতিচারণে শ্যাম থাপা, রঞ্জিত মুখোপাধ্যায়


গত ২৩ জানুয়ারি থেকে ওঁর লড়াই শুরু হয়েছিল। তবে এ বার কালের নিয়মে থামলেন। অন্য দিকে মজিদও অনেক বছর আগেই বুড়োদের দলে নাম লিখিয়েছেন। বয়স এখন ৬৫। 


এহেন সুরজিৎ তাঁর পুরোনো বন্ধুর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে যোগ করেছিলেন, "ওর প্রথম দর্শনেই মুগ্ধ হয়ে গেলাম। বল নিয়ে দৌড়বার ভঙ্গি দেখেই বোঝা গেল, মজিদ একজন আন্তর্জাতিক মানের ফুটবলার। বল নিয়ে দৌড়বার স্টাইল, ড্রিবলিং, শুটিং— সবই ছিল অসাধারণ! খুব অল্প দিনের মধ্যেই মজিদ হয়ে উঠল ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের নয়নের মণি। যতই মজিদকে দেখছিলাম তত অনুতাপ হচ্ছিল। শুধু ভাবতাম, যদি ইস্টবেঙ্গল ছাড়তে বাধ্য না হতাম, তাহলে মজিদের সঙ্গে খেলতে পারতাম। মজিদের নিখুঁত পাস করার  দক্ষতা ছিল। সঙ্গে ছিল গতি। সেই সুবাদেই জামশিদ একের পর এক গোল পাচ্ছিল। মনে হত, আমি থাকলে অবশ্যই প্রচুর গোল করতাম ওর পাস থেকে। তাই মজিদের সঙ্গে না খেলতে পারার আফশোসটা থেকেই গিয়েছে।" 


ইরান থেকে আসা এই ফুটবলারের 'বেতাজ বাদশা' তকমা থেকে 'বোহেমিয়ান বাদশা' তকমা পেতে বেশিদিন সময় লাগেনি। মাত্র দুই বছরেই খেই হারিয়ে ফেলেছিলেন মজিদ। সুরজিৎ সেই সব কালোদিনের কথাও তুলে ধরেছিলেন। 


বলেছিলেন, "মজিদ ইস্টবেঙ্গলের হয়ে যখন দ্বিতীয় বছর খেলছে, তখন থেকেই অবশ্য ধীরে ধীরে উচ্ছৃঙ্খল হয়ে উঠতে থাকে। বন্ধুবান্ধবের পাল্লায় পড়ে মাদকের অভ্যাস তৈরি হয় ওর। সঙ্গে ছিল এক বিশেষ মহিলার প্রতি ঘনিষ্ঠতা। সেটা ওকে আরও অন্ধকারে ঠেলে দেয়। অবশ্য এইসবের জন্য মজিদকে পুরো দোষ দেওয়া যায় না। কারণ তৎকালীন ক্লাব কর্তা থেকে বেশ কিছু ফুটবলার মজিদকে বিপথগামী হতে উৎসাহী করেছিল। ওরা এত অল্প সময়ে মজিদের উত্থান মেনে নিতে পারেনি! মজিদের এমন অবস্থা দেখে মনে মনে শুধু ভাবতাম, ইস্টবেঙ্গল ছাড়তে বাধ্য না হলে মজিদকে কিছুতেই এত উচ্ছৃঙ্খল হতে দিতাম না।" 


১৯৮১ সালে ইস্টবেঙ্গল থেকে বিতাড়িত হয়ে পাশের সাদা-কালো শিবিরে চলে আসেন মজিদ। কিন্তু সেখানেও সুরজিতের সঙ্গে জুটি বাধা গেল না। কারণ সেই বছরই মহমেডানকে কলকাতা লিগ জিতিয়ে মোহনবাগানে সই করেছিলেন সুরজিৎ। 


এই প্রতিবেদকের সামনে তুলে ধরেছিলেন সেই স্মৃতিও। বলেছিলেন, "জামশিদ বন্ধু হিসেবে মজিদকে অনেকবার সামলাতে চেয়েও ব্যর্থ হয়েছিল। এরপর একসময় ইস্টবেঙ্গল ছেড়ে মহমেডান স্পোর্টিং–‌এ যোগ দেয় মজিদ। আমি যদিও মাত্র এক বছর মহমেডানে খেলেই মোহনবাগানে চলে গিয়েছিলাম। ফলে মজিদের সঙ্গে একই দলে খেলার সুযোগ আর হয়ে ওঠেনি।" 


তবে কেরিয়ারের একেবারে শেষদিকে অবশ্য মাত্র দুটি ম্যাচ মজিদের বিপক্ষে খেলেছিলেন সুরজিৎ। সেটা অবশ্য তাঁর আর পুরোনো সতীর্থ প্রয়াত সুভাষ ভৌমিকের জন্যই। 


বন্ধুকে ধন্যবাদ জানিয়ে সুরজিৎ শেষে যোগ করেছিলেন, "শেষ পর্যন্ত ১৯৮৬ সালে মজিদের বিপক্ষে খেলার সুযোগ ঘটল। পেশাদার ফুটবল থেকে অবসর নিয়ে শুধু অফিসের হয়ে খেলছিলাম। আর মাঝে মধ্যে প্রদর্শনী ম্যাচ। তখন সুভাষ ভৌমিক কোচ হিসেবে কেরিয়ার তৈরির চেষ্টা করছিল। ওর কোচিং জীবনের শুরুটা খুব আশানুরূপ হয়নি। ’‌৮৬ সালে ও কোচ হল জর্জ টেলিগ্রাফের। আর আমায় এসে অনুরোধ করে জর্জের হয়ে খেলার জন্য। প্রাথমিকভাবে খুবই আপত্তি করেছিলাম। কিন্তু সুভাষ নাছোড়বান্দা। রাজি করিয়েই ছাড়ল। সেই বছর জর্জ টেলিগ্রাফ দু’‌বার মহমেডান স্পোর্টিং–‌এর মুখোমুখি হয়— একবার প্রথম লিগে। আরেকবার ফিরতি লিগে। মজিদ তখন খেলছে মহমেডানে। মাদকের কবল থেকে বেরিয়ে এসে আবার খেলায় মন দিয়েছে। প্রথম লিগে যখন মজিদের বিপক্ষে খেলার সুযোগ এল, তখন মনে মনে ভাবলাম, টক্কর হবে সেয়ানে সেয়ানে। সেই ম্যাচটা শেষ হয়েছিল অমীমাংসিত ভাবে। তবে সেকেন্ড হাফে একটা বল বুকে রিসিভ করে ভলি মেরেছিল মজিদ। বলটা ক্রসপিসে লেগে ফিরে এসেছিল। ফিরতি লিগে অবশ্য আমরা মহমেডানকে পরাস্ত করতে সক্ষম হই।" 


সেই আটের দশক থেকে কলকাতায় খেলে যাওয়া বিদেশিদের সংখ্যা নেহাত কম নয়। জামশিদ–‌এমেকা–‌চিমা–‌ওকোরো–‌ব্যারেটো-ওডাফাদের কথা মাথায় রেখেও সুরজিতের মতো দিকপালের দাবি মজিদ–‌ই 'সেরার সেরা'।   


ইরানিয়ানকে প্রাপ্য সম্মান আজীবন দিয়েছেন। তাঁর খেলা কাছ থেকে দেখে। এবং মজিদের বিরুদ্ধে মাত্র দুটি ম্যাচ খেলে! কারণ সদ্য প্রয়াত যে শুধু ভারতের সর্বকালের সেরা উইঙ্গার ছিলেন না, তাঁর মধ্যে ছিল একজন দক্ষ ক্রীড়া সাংবাদিকের গুন। তাই তো জহুরী আসল হিরে চিনতে ভুল করেননি। তবে মজিদের সঙ্গে অনেকটা সময় মাঠে না কাটানোর আফশোসটা কিন্তু রয়েই গেল।


(Zee 24 Ghanta App দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির লেটেস্ট খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Zee 24 Ghanta App)