বাঁ পায়ের ঈশ্বর মারাদোনা : অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়
আর যা কিছু লেফট, তা তো সবই আস্তে আস্তে চলে যাচ্ছে, বোধহয় এবার মারাদোনা চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরো একটা বড় বাঁ পায়ের কর্মসূচির অবসান ঘটল।
ফুটবল যে শুধু ফুটবল নয়, ওটা আসলে ম্যাজিক, সেটা আমাকে শিখিয়েছিল দিয়েগো মারাদোনা নামের লোকটা। নীল-সাদা রংয়ের দশ নম্বরের জার্সি। মাঠে যখন দাঁড়িয়ে থাকে, তখন বাকিদের দিকে আর চোখ পড়ে না।
গোটা কলকাতা তখন ব্রাজিল। পাড়ায় পাড়ায় উড়ছে সবুজ-হলুদ রঙের পতাকা। আর তার উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে একটা বেঁটেখাটো লোক, কিন্তু মাঠে যখন সে নামে, সে তখন সত্যিকারের গলিয়াথ। আমরা জানতাম, এই একজন প্লেয়ার আছে, যার পায়ে বল পড়লে কিছু একটা ঘটবে। কোনও এক আশ্চর্য সম্মোহনে সে আমাদের চোখ টেনে নেবে। মারাদোনা সেটা পেরেছিলেন। পেলেকে তো আমরা কখনও চোখের সামনে খেলতে দেখিনি। মারাদোনাকে আমরা চাক্ষুষ করেছিলাম। ফলে ছিয়াশির বিশ্বকাপের সময়ে জানতাম, যতই জিকো, সক্রেটিস বা অন্যান্য খেলোয়াড় থাক,আমাদের মারাদোনা আছে। যে কোনও কিছুকে সে সম্ভব করে তুলতে পারে।
আর্জেন্টিনায় যে প্রদেশে মারাদোনা বড় হয়ে উঠেছিলেন, সেই জায়গাটার ডেমোগ্রাফিটা একটু অন্যরকম। মানে, নেশাভাঙ করা, অন্যরকম জীবন্যাপন করা, মানে নেশা করাটাই ওখানে দস্তুর। ফলে আমাদের সমাজের পরিমাপ দিয়ে, সোশ্যাল নর্মস দিয়ে মারাদোনাকে মাপা বোধহয় ঠিক নয়। ফলে মারাদোনা নানারকম বিতর্কে জড়িয়েছেন। তিনি যত বিতর্কে জড়িয়েছেন, আমার তত তাঁকে ভাল মনে হয়েছে, তত তাঁকে রিয়েল মনে হয়েছে। মনে হয়েছে যে, একটা সত্যিকারের মানুষ। একটা মানুষের জীবনে ওঠানামা, খানাখন্দ, উঁচুনিচু, এসব তো থাকবেই, কিন্তু যাই থাক, সেসবের উর্ধ্বে তাঁর একটা বাঁ পা ছিল। সেই বাঁ পায়ের ঈশ্বর ছিলেন মারাদোনা।
মারাদোনা চলে গেছেন। আর সবার মত আমারও খুব খারাপ লাগছে। কিন্তু সত্যি বলতে কি, এর আগে বেশ কিছু বছর মারাদোনা কেমন আছেন, কিভাবে আছেন, তার খোঁজ নেওয়ার তো চেষ্টা করিনি। তার কারণ, আমার ঈশ্বর আটকে ছিলেন বিরাশি- ছিয়াশির ওই দিনগুলোতে। আমার বেড়ে ওঠার দিনগুলোতে, যেসময়ে আমাকেও গড়ে তুলেছেন মারাদোনা। ফুটবলের প্রতি ভালবাসা গড়ে তুলেছেন মারাদোনা। যখন থেকে মারাদোনা খেলাধূলায় নেই, তখন আমি তাঁর সম্পর্কে বিশেষ জানতাম না। জানতাম কোথাও না কোথাও তিনি আছেন। চলে যাওয়ার পর নতুন করে মনে পড়ল মারাদোনা ছিলেন। কিন্তু এই চলে যাওয়াটা তাঁকে আবার একবার অমরত্ব দিল। মারাদোনা অমর হয়ে রইলেন। আর দেখতে পাবো না সেই লেফট ফুটার, অবিশ্বাস্য সমস্ত শট বা দুরন্ত সব ড্রিবল।
আর যা কিছু লেফট, তা তো সবই আস্তে আস্তে চলে যাচ্ছে, বোধহয় এবার মারাদোনা চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরো একটা বড় বাঁ পায়ের কর্মসূচির অবসান ঘটল।
আরও পড়ুন - "আমার চোখে মারাদোনা সর্বশ্রেষ্ঠ ফুটবলার" স্মৃতিচারণায় সাংবাদিক জি সি দাশ