WTC Final 2023, IND vs AUS: ওভালে ব্যাটিং ভরাডুবি! আইপিএল কাঁপানো নক্ষত্রদের `বিরাট` পতন ঘটিয়ে অজিদের রাজত্ব
পুরনো রোগ আর সারল না! চাপের মুখে বারবার চুপসে যাওয়ার সেই বদভ্যাসের আর বদল ঘটল কোথায়! এমনিতে ওভাল নিয়ে ভারতীয় দলের বাড়তি মাতামাতি করার মতো পারফরম্যান্স নেই। এখনও পর্যন্ত ১৪টি টেস্ট খেলে জয় এসেছে মাত্র দু`বার। প্রথমবার ভারত জিতেছিল সেই ১৯৭১ সালে। এক ইনিংস ও ৮ রানে এসেছিল সেই ঐতিহাসিক জয়।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
দ্বিতীয় দিনের খেলার শেষে
ভারত টসে জিতে বোলিং
অস্ট্রেলিয়া, প্রথম ইনিংস: ১২১.৩ ওভারে ৪৬৯ রান
(ট্রাভিস হেড: ১৬৩, স্টিভ স্মিথ: ১২১, মহম্মদ সিরাজ: ১০৮/৪)
ভারত, প্রথম ইনিংস: ৩৮ ওভারে ১৫০ রানে ৫ উইকেট
(জাদেজা: ৪৮, রাহানে: ২৯*, কেএস ভরত: ৫*, লিও: ৫/১, ক্যামেরুন গ্রিন: ২২/১)'
অস্ট্রেলিয়া ৩১৮ রানে এগিয়ে
সব্যসাচী বাগচী
টসে জিতে বোলিং নেওয়ার পর রবিচন্দ্রন অশ্বিনকে (Ravichandran Ashwin) বাইরে রেখে দেওয়া। চলতি বিশ্ব টেস্ট ফাইনালের (ICC World Test Championship Final 2023) প্রথম দিন থেকেই সবার টার্গেটে ছিলেন রোহিত শর্মা (Rohit Sharma) ও হেড কোচ রাহুল দ্রাবিড় (Rahul Dravid)। কিন্তু কে জানত এই ওভালের (The Oval) বাইশ গজেই একরাশ লজ্জা উপহার দেবে 'তারকাখচিত' ব্যাটিং লাইন-আপ। যে সবুজ পিচে ভারতীয় বোলাররা ডুবিয়েছে, সেই বাইশ গজেই ৪৬৯ রানের বোঝা কাঁধে নিয়ে বিরাট কোহলি (Virat Kohli) থেকে রোহিত, শুভমন গিল (Shubman Gill) থেকে চেতেশ্বর পূজারাদের (Cheteshwar Pujara) 'ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি' অবস্থা। পাটা পিচে আইপিএল-এর (IPL 2023) মঞ্চ কাঁপানো নক্ষত্ররা রানের পর রান করলেও, ঘাসে ভরা সবুজে পিচে একেবারে কেঁপে গেলেন। স্বভাবতই কেঁপে গেল ভারতীয় দলের সাজঘর। দ্বিতীয় দিনের শেষে ভারতের স্কোরবোর্ড বলছে ১৫০ রানে ৫ উইকেট। যদিও বড় ধাক্কা কাটিয়ে অজিঙ্কা রাহানে (Ajinkya Rahane) ও রবীন্দ্র জাদেজা (Ravindra Jadeja) লড়লেন। কিন্তু তাঁদের লড়াইয়ে কি ভারত ম্যাচে ফিরবে বলে মনে হয় না। তাই আরও একটা ফাইনালে হার যে শুধু সময়ের অপেক্ষা। কারণ অস্ট্রেলিয়া যে ৩১৮ রানে এগিয়ে রয়েছে।
পুরনো রোগ আর সারল না! চাপের মুখে বারবার চুপসে যাওয়ার সেই বদভ্যাসের আর বদল ঘটল কোথায়! এমনিতে ওভাল নিয়ে ভারতীয় দলের বাড়তি মাতামাতি করার মতো পারফরম্যান্স নেই। এখনও পর্যন্ত ১৪টি টেস্ট খেলে জয় এসেছে মাত্র দু'বার। প্রথমবার ভারত জিতেছিল সেই ১৯৭১ সালে। এক ইনিংস ও ৮ রানে এসেছিল সেই ঐতিহাসিক জয়। প্রয়াত অজিত ওয়াদেকরের নেতৃত্বে ইংল্যান্ডকে এই ওভালেই হারিয়ে সিরিজ জিতেছিল ভারত। এরপর জয়ের মুখ দেখতে লেগে গিয়েছিল দীর্ঘ ৫০ বছর। ২০২১ সালে বিরাটের অধিনায়কত্বে ভারত জিতেছিল ১৫৭ রানে। সেই টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে ১২৭ রান করেছিলেন রোহিত। হয়েছিলেন ম্যাচের সেরা। ২০২১ সালে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে বিরাটের ভারত জিততে পারেনি। দুই বছর পর রোহিতের ভারতীয় দলেরও একই অবস্থা। দুই বছরের ব্যবধান ও ভেন্যুর বদল ঘটলেও, ভারতীয় ব্যাটারদের ভঙ্গুর মানসিকতার বদল ঘটল না। তাই আরও একবার আইসিসি ইভেন্ট থেকে খালি হাতে ফেরার অপেক্ষায় 'মেন ইন ব্লু' ব্রিগেড।
এদিন ৩ উইকেটে ৩২৭ রানে ক্রিজে এসেছিলেন ট্রভিস হেড ও স্টিভ স্মিথ। দিনের প্রথম ওভারের প্রথম বলেই সিঙ্গলস নিয়ে স্মিথকে স্ট্রাইক দেন ট্রাভিস হেড। স্টান্স নিয়েই মহম্মদ সিরাজের প্রথম ডেলিভারিকে ফ্লিক করেন। বল বাউন্ডারির বাইরে যেতেই ৯৯ রানে পৌঁছে যান তিনি। এর পরের বলেও মারলেন ফের চার। আর এই বাউন্ডারির সাহায্যে অজিদের ইতিহাসে তৃতীয় ব্যাটার হিসেবে ৩১টি শতরান সেরে ফেলেন। ৪১টি শতরান করে এই তালিকার শীর্ষে রয়েছেন পন্টিং। ৩২টি শতরান করে দুই নম্বরে আছেন আর এক প্রাক্তন অধিনায়ক স্টিভ ওয়া। একইসঙ্গে ওভালে টেস্ট কেরিয়ারের তৃতীয় শতরানের দেখা পেলেন স্মিথ। অজি ইনিংসের বয়স যখন ৯৮.১ ওভার, তখন শার্দূল ঠাকুরের বাইরের ডেলিভারিতে ব্যাটের কানা লাগিয়ে বোল্ড হলেন অজি তারকা। ২৬৮ বলে ১২১ রানে থামলেন স্মিথ। মারলেন ১৯টি চার। তবে শার্দূলের বলে স্মিথ আউট হওয়ার আগে, ১৭৪ রানে ১৬৩ রানে ফিরে গিয়েছিলেন ভারতের 'মাথাব্যথা' বাড়িয়ে দেওয়া ট্রাভিস হেড। ম্যাচ উইনিং ইনিংস সাজানো ছিল ২৫টি চার ও ১টি ছয়ের উপর ভর করে। তবে ৩৮৭ রানের মাথায় দুই শতরানকারী সাজঘরে চলে গেলেও, অজিদের থামানো যায়নি। কারণ অ্যালেক্স ক্যারি ৪৮ রান করে দলের রানকে নিয়ে গেলেন ৪৬৯-এ। সিরাজ কিছুটা লড়াই করলেও বাকিরা একেবারেই দাগ কাটতে পারলেন না। ১০৮ রানে ৪ উইকেট পাওয়া সিরাজের পাশে শামি, উমেশরা বড্ড বেমামান ছিলেন।
প্রবল চাপে প্যাট কামিন্স, মিচেল স্টার্কদের সামনে ভারতীয় ব্যাটাররা কেমন পারফর্ম করেন, সেটা দেখার অপেক্ষায় সবাই উদ্গ্রীব ছিলেন। মেজাজের সঙ্গেই শুরুটা করেছিলেন রোহিত ও শুভমন। এক অধিনায়কের বলে ফিরলেন আর এক অধিনায়ক। কামিন্সের বলে এলবিডব্লিউ হলেন রোহিত। গত দেড় বছর ধরে রোহিতের ব্যাট শান্ত। তাঁর ফিটনেস সমস্যা যত প্রকট হচ্ছে, ঠিক ততটাই রানের খরা জাঁকিয়ে বসেছে রোহিতকে। এবার ফিরলেন ১৫ রানে। রোহিত প্যাভিলিয়নে ফিরতেই সমালোচকেরা কার্যত তাঁর দিকে ধেয়ে আসেন। একটি পরিসংখ্যান বলছে, আইসিসি প্রতিযোগিতায় গত সাত ইনিংসে রোহিতের ব্যাট (১৫, ৩০, ৩৪, ০, ২৯, ৯, ৩০*) থেকে একটিও অর্ধ শতরান নেই। ইতমধ্যেই নেটপাড়ায় শুরু হয়ে গিয়েছে মিমের বন্যা।
আরও পড়ুন: Steve Smith, WTC Final 2023: বিরাট, পন্টিংকে পিছনে ফেলে কোন বিশেষ নজির গড়লেন স্টিভ স্মিথ?
এরপর ফিরলেন 'নেক্সট বিগ থিং ইন ইন্ডিয়ান ক্রিকেট'। চলতি বছর সব ফরম্যাটে ঝুরিঝুরি রান করেছেন শুভমন। একদিনের ক্রিকেটে দ্বিশতরানের পর, জাতীয় দলের হয়ে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে করেছিলেন শতরান। আর আইপিএল, সেখানে তো শুভমন রাজত্ব করেছেন। ১৭ ম্যাচে রান ৮৯০। সঙ্গে তিনটি শতরান! সেখানে এবার লাল বলের সামনে পড়তেই গুটিয়ে গেলেন। স্কট বোল্যান্ডের ভিতরে আসা ডেলিভারিকে জাজমেন্ট দিয়ে বোল্ড হলেন পঞ্জাব তনয়। ফিরলেন ১৩ রানে।
৩০ রানে ২ উইকেট হারাতেই দায়িত্ব সামলানোর জন্য এলেন দুই অভিজ্ঞ বিরাট ও পূজারা। সেই এপ্রিল মাস থেকে ইংল্যান্ডে রয়েছেন পূজারা। সাসেক্সের হয়ে কাউন্টিতে দুটি শতরান করে খুঁজে পেয়েছিলেন হারানো ছন্দ। তবে এতে লাভের লাভ কিছুই হল না। ক্যামেরুন গ্রিনের বল ছাড়তে গিয়ে বোল্ড হলেন ভারতের টেস্ট ব্যাটিংয়ের মেরুদণ্ড।
ক্রিকেটে বলা হয়, তিনটে স্টাম্প যিনি চেনেন, তিনি তত ভালো ব্যাটার। আরও টেকনিক্যালি বললে, যে ব্যাটার নিজের অফস্টাম্প চেনেন বা আগলে রাখতে জানেন, দিনের শেষে তিনিই সাফল্য পান। অন্তত টেস্ট ক্রিকেটে এটাই বেসিক। পূজারার মতো অভিজ্ঞ ব্যাটার বুঝতেই পারলেন না, তাঁর অফস্টাম্প কোথায়? ক্যামেরন গ্রিনের বল পড়ে ভেতরে এসেছিল। পূজারা খেলবেন কি খেলবেন না, রাখবেন কি ছাড়বেন, ভাবতে ভাবতে গ্রিন নিয়ে গেলেন তাঁর অফস্টাম্প। টেস্ট ক্রিকেটে অফস্টাম্প ব্যাটারের অহঙ্কারের জায়গা। সোজা কথায় বললে পূজারার অহংয়ে আঘাত করলেন গ্রিন। এমন বল টেস্টে হয়তো ১ হাজার বার খেলেছেন পূজারা। ভুল এক আধ দিন সবাই করেন। মুশকিল হল, খুব গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে মহা ভুল করে বসলেন পূজারা।
বিরাটও পারলেন না। এমনিতেই আইসিসি ইভেন্টে তাঁর পরিসংখ্যান বিরাট কোহলিসুলভ নয়। এবারও সেটা দেখা গেল। ভারতীয় ব্যাটিং-এর বয়স তখন ১৮.২ ওভার। সবচেয়ে বড় ধাক্কা খেল ভারতীয় শিবিরে। মিচেল স্টার্কের বাইরে যাওয়া একটি ডেলিভারি হঠাৎই লাফিয়ে উঠে। সেই ডেলিভারিকে কিছুতেই ম্যানেজ করতে পারলেন না বিরাট। মাত্র ০.৮ সেকেন্ডের মধ্যে দারুণ ক্যাচ লুফে নেন 'ফ্যাব ফোর'-এর শীর্ষে থাকা স্টিভ স্মিথ। শেষ ২০২১ সালের বিশ্ব টেস্ট ফাইনালে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে দুই ইনিংসে বিরাটের ব্যাট থেকে এসেছিল ১৩২ বলে ৪৪ ও ২৯ বলে ১৩ রান। সেবার কিউয়িরা ট্রফি হাতে তুলেছিল। আর এবার ফেভারিট অস্ট্রেলিয়া।
৭১ রানে চলে গিয়েছিল ৪ উইকেট। ‘একে একে নিবিছে দেউটি’। অনেকেই মনে করেছিলেন ভারতের অল আউট হয়ে যাওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা। তবে প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে বাইশ গজে বুক চিতিয়ে লড়লেন রাহানে ও জাদেজা। তবে দিনের বাকিটা সময় এই জুটি টিকতে পারল না। ন্যাথন লিও বল হাতে নিয়েই ভাঙলেন পঞ্চম উইকেটে ৭১ রানের জুটি। ৫১ বলে ৪৮ রানে ব্যাট করা জাদেজা অজি অফ স্পিনারের বাইরে যাওয়া ডেলিভারিকে বুঝতেই পারলেন না। বলটা একটু লাফাতেই জাদেজার ব্যাটের কানা নিয়ে চলে গেল স্মিথের হাতে। ১৪২ রানে ৫ উইকেট হারায় ভারত। জাদেজা আউট হতেই ক্যামেরা ঘুরে চলে গেল রোহিত ও অশ্বিনের দিকে। বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না যে, কিসের ইঙ্গিত করা হচ্ছে। অশ্বিনের মোট ৪৭৪ উইকেটের মধ্যে ২৪১ উইকেট বাঁহাতি ব্যাটারদের বিরুদ্ধে। গত বর্ডার-গাভাসকর ট্রফি এর জ্বলন্ত প্রমাণ। সেই সিরিজে ২৫ উইকেটের ১৫টি এসেছিল বাঁহাতি ব্যাটারদের বিরুদ্ধে। এমন ক্রিকেটারকে কীভাবে দলের বাইরে রাখতে পারে!
দিনের শেষে ২৯ রানে লড়ছেন রাহানে। কিন্তু এতে লাভ বলে মনে হয় না। কারণ ভারতীয় দল যে এখনও ৩১৮ রানে পিছিয়ে। কিন্তু তাঁদের লড়াইয়ে কি ভারত ম্যাচে ফিরবে বলে মনে হয় না। তাই আরও একটা ফাইনালে হার যে শুধু সময়ের অপেক্ষা।
(Zee 24 Ghanta App দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির লেটেস্ট খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Zee 24 Ghanta App)