WTC Final 2023, IND vs AUS: `সেন্ট্রাল কনট্র্যাক্ট` হারানো ব্রাত্য রাহানে লড়লেও, বিশ্ব টেস্ট জয়ী হওয়ার দিকে এগোচ্ছে অস্ট্রেলিয়া
ভারতীয় ক্রিকেটে প্রত্যাবর্তনের রাজা হিসেবে মহিন্দর অমরনাথ, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে যুবরাজ সিংয়ের নাম নেওয়া হয়। এবার সেই তালিকায় নিজের নামটা রাহানে জুড়ে দিলেন। থিঙ্কট্যাঙ্ককে বার্তা দিয়ে মারলেন ১১টি চার ও ১টি ছক্কা। প্রতিটা বাউন্ডারির মধ্যে যেন হত্যাকত্তাদের প্রতি বিশেষ বার্তা লেখা ছিল। কেরিয়ার শেষ। বয়স হয়ে গিয়েছে।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
তৃতীয় দিনের খেলার শেষে
অস্ট্রেলিয়া, প্রথম ইনিংস: ১২১.৩ ওভারে ৪৬৯ রান
(হেড: ১৬৩, স্মিথ: ১২১, সিরাজ: ১০৮/৪)
ভারত, প্রথম ইনিংস: ৬৯.৪ ওভারে ২৯৬ রান
(রাহানে: ৮৯, শার্দূল: ৫১, জাদেজা: ৪৮, কামিন্স: ৮৩/৩, গ্রিন: ৪৪/২)
অস্ট্রেলিয়া, দ্বিতীয় ইনিংস: ৪৪ ওভারে ৪ উইকেটে ১২৩ রান
( লাবুশানে:৪১*, স্মিথ: ৩৪, জাদেজা: ২৫/২)
অস্ট্রেলিয়া ২৯৬ রানে এগিয়ে
সব্যসাচী বাগচী
সময় কত দ্রুত বদলে যায়। দগদগে ঘা সময়ের সঙ্গে যায় শুকিয়ে। কিন্তু তাই বলে সেই ক্ষতের যন্ত্রণা কি আদৌ ভোলা যায়? সব যন্ত্রণা ভোলা যায় না। তবে অজিঙ্কা রাহানের (Ajinkya Rahane) মতো লড়াকুরা এমন দগদগে বুকে বয়ে বেড়ান। মুখ খোলেন না। আস্ফালন দেখান না। বরং 'লো প্রোফাইল'-এ থেকে দলের স্বার্থে 'নীরব যোদ্ধা'-র দলের সেবা করে যান। ব্যাট হাতে জবাব দেন প্রতিটি অপমানের। ঠিক যেমন এই কাজটা বছরের পর বছর করতেন টিম ইন্ডিয়ার (Team India) বর্তমান কোচ। তবে ব্যাটার ও কোচ রাহুল দ্রাবিড়ের (Rahul Dravid) মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ। তাই তো 'জুনিয়র তত্ব'-র স্লোগান তুলে মুম্বইকরকে ছেঁটে ফেলেছিলেন। তবে ক্রিকেট দেবতার 'পোয়েটিক জাস্টিস' দেখুন, সেই রাহানেই ওভালের (The Oval) বাইশ গজে বুক চিতিয়ে, প্যাট কামিন্স (Pat Cummins)-মিচেল স্টার্কদের (Mitchell Strac) গোলাগুলি হজম করেও লড়লেন। চলতি বিশ্ব টেস্ট ফাইনালে (ICC World Test Championship Final 2023) একটা সময় হারিয়ে যাওয়া ভারতীয় দলকে কিছুটা হলেও অক্সিজেন জোগালেন। তবে এতে তেমন লাভ হল না। শার্দুল ঠাকুরকে (Shardul Thakur) নিয়ে লড়াই করলেও, ২৯৬ রানে গুটিয়ে গেল ভারতের প্রথম ইনিংস। ফলে ১৭৩ রানের লিড পায় অস্ট্রেলিয়া (Australia)। তৃতীয় দিনের শেষে ৩ উইকেটে ১২৩ রান তুলে দেওয়ার সুবাদে সেই লিড বেড়ে হল ২৯৬ রানের। সৌজন্যে ৪১ রানে অপরাজিত থেকে মার্নাস লাবুশানে (Marnus Labuschagne) পালটা লড়াই।
তবে তাই বলে রাহানের ৮৯ রানের ইনিংসকে খাটো করা উচিত নয়। সময়ের দাবিতে ১২৯ বলের এই ইনিংস শতরানের সমান। দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে নিজের সেরা পারফরম্যান্স করতে পারেননি। দল থেকে বাদ গিয়েছিলেন রাহানে। এরমধ্যে চলতি বছরের ২৭ মার্চ তাঁর জীবনে নেমে এসেছিল অন্ধকার। বিসিসিআই 'সেন্ট্রাল কনট্র্যাক্ট' থেকে তাঁকে বাদ দেওয়া হয়। সেই রাহানেই কিনা ৯ জুন রোহিত শর্মা-রাহুল দ্রাবিড়ের টিম ম্যানেজমেন্টকে কড়া জবাব দিলেন।
ভারতীয় ক্রিকেটে প্রত্যাবর্তনের রাজা হিসেবে মহিন্দর অমরনাথ, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে যুবরাজ সিংয়ের নাম নেওয়া হয়। এবার সেই তালিকায় নিজের নামটা রাহানে জুড়ে দিলেন। থিঙ্কট্যাঙ্ককে বার্তা দিয়ে মারলেন ১১টি চার ও ১টি ছক্কা। প্রতিটা বাউন্ডারির মধ্যে যেন হত্যাকত্তাদের প্রতি বিশেষ বার্তা লেখা ছিল। কেরিয়ার শেষ। বয়স হয়ে গিয়েছে। তরুণ প্রজন্মের দিকে তাকানো দরকার। এ সবই গত ১৮ মাসে বারবার শোনা গিয়েছে। তিনি বোধহয় অন্যভাবে প্রত্যাবর্তনে মঞ্চ সাজানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন। বিদেশের কোনও মাঠ হবে, বড় কোনও মঞ্চ হবে, উপচে পড়া গ্যালারি হবে, সবুজ ঘাসে একাকার বাইশ গজ হবে। আর তিনি অসম্ভব লড়াই করবেন। রাহানে বরাবর বিদেশে ভারতের ভরসা। ওভালের তৃতীয় দিন এই রাহানের নামেই লেখা হয়ে থাকল।
ডান হাতের বুড়ো আঙুলে, পাঁজরে বল লাগল একাধিকবার। তাতেও ভয়ে সিঁটিয়ে গেলেন না। বরং পরের বলেই ডিফেন্স করলেন অনায়াসে। আত্মবিশ্বাস দেখে মুগ্ধ সৌরভ-রবি শাস্ত্রীরা। দলকে ম্যাচে টিকিয়ে রাখার লড়াই শুরু হয়েছিল দ্বিতীয় দিন থেকেই। তৃতীয় দিনের প্রথমেই ফেরেন কেএস ভরত। এরপর শার্দুলকে সঙ্গে নিয়ে চোয়ালচাপা লড়াই রাহানের। দ্বিতীয় দিনেই সাজঘরে ফিরেছিলেন পাঁচ ব্যাটার। তৃতীয় দিন কত তাড়াতাড়ি রোহিতরা গুটিয়ে যাবেন? লাঞ্চ পার হবে তো? ভারত-অস্ট্রেলিয়ার আশা-আশঙ্কার মাঝে দেওয়াল হয়ে দাঁড়ালেন রাহানে। মধ্যাহ্নভোজ বিরতিতে শার্দুলের সঙ্গে ষষ্ঠ উইকেটে ১০৯ রানের পার্টনারশিপ। প্রমাদ গুণেছে অজি শিবির। শতরান হাতছাড়া হল অল্পের জন্য। শেষমেশ ৮৯ রানে থামেন। ৫১২ দিন পর জাতীয় দলে ফিরে টেস্ট ফরম্যাটে ৫০০০ রানের গণ্ডি পার করলেন।
আরও পড়ুন: Ajinkya Rahane, IND vs AUS: 'ভারত কামব্যাক করতেই পারে', রাহানের লড়াই দেখে সৌরভের বার্তা
নামের পাশে 'বাতিল' ট্যাগ জুড়ে দেওয়া হয়েছিল। বাদ পড়েন ২০২২-২৩ বিসিসিআয়ের কেন্দ্রীয় চুক্তি থেকে। গত বছর ঘরের মাঠে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে টেস্ট সিরিজে রাখা হয়নি। নির্বাচকরা জানিয়েছিলেন, নতুনদের সুযোগ দিতে শ্রেয়স আইয়ার-সূর্য কুমার যাদবের মতো গরম রক্তের আমদানি করা হবে। বিশ্রামে গেলেন রাহানে। সেই বিশ্রাম অতিরিক্ত দীর্ঘ হয়েছে! মুম্বইয়ের ব্যাটারকে প্রায় ভুলতে বসেছিল ক্রিকেট দুনিয়া। তবে মনে করিয়ে দেওয়ার তাগিদ ছিল তাঁর নিজের উপরই। মহেন্দ্র সিং ধোনি ভরসা রেখেছিলেন। সেই ভরসারই সুফল পাচ্ছে ভারতীয় দল। ঘরোয়া ক্রিকেটের পর আইপিএল-এ বিধ্বংসী পারফরম্যান্স। চেন্নাই সুপার কিংসের জার্সি গায়ে চাপিয়ে ১৪ ম্যাচে ৩২৬ রান। দুটি অর্ধ শতরানের সঙ্গে গড় ৩২.৬০। স্ট্রাইক রেট ১৭২.৪৯। ধোনির পরামর্শে বিশ্ব টেস্ট ফাইনালের স্কোয়াডে ডাক। আর এরপর রূপকথার কামব্যাক।
কিন্তু এমন অদম্য লড়াইয়ের ভারত বিশেষ ভালো জায়গায় নেই। কারণ রাহানে-শার্দুল প্রতিরোধ গড়ে তুললেও, বাকিরা পারলেন কোথায়! রোহিত, শুভমন গিল, চেতেশ্বর পূজারা, বিরাট কোহলি তো অনেক আগেই ময়দায় ছেড়েছিলেন। ফলে ১৭৩ রানের লিড পায় অজিরা। দিনের শেষে লাবুশান ও প্রথম ইনিংসে শতরানকারী ট্রাভিস হেডের সৌজন্যে সেই লিড আরও বেড়ে দাঁড়াল ...রানের। এবারও বাইশ গজে মহম্মদ সিরাজ উত্তাপ ছড়ালেন। ফেরালেন ডেভিড ওয়ার্নারকে। উসমান খোয়াজা ফের ব্যর্থ। প্রথম ইনিংসে ১২১ রান করা স্টিভ স্মিথ এবারও ভয়ংকর হয়ে ওঠার বার্তা দিচ্ছিলেন। তবে তাঁকে ব্যক্তিগত ৩৪ রানে আটকে দেন রবীন্দ্র জাদেজা। তবে তাতে কি! নখ-দন্তহীন বোলিং ও জঘন্য ফিল্ডিংয়ের সুযোগ নিয়ে মার্নাস লাবুশানে-ট্রাভিস হেড রয়ে গেলেন ক্রিজে। দ্বিতীয় ইনিংসে ৩ উইকেটে ১২৩ রান তোলার সুবাদে ফলে অজিদের লিড দাঁড়াল ২৯৬ রানের।
মেগা ফাইনালের আরও দু'দিন বাকি। ভারতীয় ব্যাটিংয়ের যা ফাটাফুটো অবস্থা, তাতে ন্যাথান লিও না চতুর্থ ইনিংসে একাই বুঝে নেন। আর তাই অস্ট্রেলিয়া যে ট্রফির দিকে একহাত বাড়িয়ে রেখেছে, সেটা বুঝে নিতে অসুবিধা হচ্ছে না। এদিকে ভারতের মান বাঁচানোর জন্য আগামী দু'দিন ওভালের আকাশে বৃষ্টির সম্ভাবনাও নেই। আর তাই লিখে দেওয়া ভালো যে, আইসিসি ট্রফি জেতার ১০ বছরের খরা এখনও কাটল না। বিরাটের পর রোহিতের ভারতও বিশ্ব টেস্ট ফাইনাল থেকে খালি হাতে ফিরছে।