নিজস্ব প্রতিবেদন: জিভে জল আনা ফুচকার স্বাদ নেয় নি এমন রসিক বাঙালি বোধহয় নেই। শুধু বাংলা নয়, ফুচকার স্বাদ সমান আস্বাদন করে ভিনরাজ্যের মানুষদেরও। সেটা  যে কোনও অনুষ্ঠান হোক অথবা রাস্তার ধারে  লাইন দিয়ে। কিন্তু কোথায়, কিভাবে তৈরি হয় ফুচকা? প্রায় একমাস ধরে চলা লকডাউনে কেমন আছেন ফুচকার কারিগররা? সেই সন্ধানে নেমে এক কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি হতে হয়েছিল জি় ২৪ ঘণ্টার প্রতিনিধিকে।


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING


নদিয়ার রানাঘাট থানার অন্তর্গত পুলিননগর গ্রাম। এই গ্রামটিকে বলা এ রাজ্যের ফুচকার আঁতুড়ঘর। সারা বাংলায় সব জেলাতে যত ফুচকা বিক্রি হয় তার সিংহভাগ ফুচকা সরবরাহ হয় নদিয়ার এই গ্রাম থেকেই। এই গ্রামের দুশোটি পরিবার এই ফুচকা তৈরি করার সঙ্গে জড়িত। এদের বংশপরম্পরায় এই ব্যবসা। এই দুশোটি পরিবারের একমাত্র আয়ের পথ ফুচকা বানানো। কিন্তু প্রায় একমাস ধরে চলা লকডাউনে পরিবারগুলির জীবনযাত্রা একদম বদলে গেছে। সারাদিনের চরম ব্যস্ততায় আজ শুধু শূন্যতা। কারখানায় ঝুলছে তালা। ফুচকার কারিগরের পরিবারের প্রত্যেকের মাথায় হাত। চোখে মুখে অনিশ্চয়তার আতঙ্ক। যা ছাপিয়ে গেছে করোনা আতঙ্ককেও।



ক্ষতির মুখে লকডাউনে ক্ষুদ্র মাঝারি সব ব্যবসায়ীরা। লকডাউন উঠে গেলে হয়ত তাঁরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন। ক্ষতি সামলে নিয়ে লাভের মুখ দেখবেন কয়েকমাস পর। কারণ তাঁরা হারিয়েছেন সময়। কিন্তু  ফুচকার কারিগররা? সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে ফেলেছেন অর্থ আর শ্রম। একটু বিশদে ব্যাখা করলেই বোঝা যাবে অন্য ব্যবসার সঙ্গে ফুচকার কারিগরদের ব্যবসার পার্থক্য কোথায়? কেমন আছেন ফুচকার কারিগররা? এটা জানতে যখন পুলিননগর গ্রামে  পৌঁছানো গেল, তখন এক কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়। পুলিননগর পৌঁছতেই দেখা যায়, রাস্তার ধারে লাইন দিয়ে পড়ে আছে লক্ষ লক্ষ   ফুচকা। প্রথমে মনে হয়েছিল এই ভাবে হয়ত ফুচকা শুকোতে দিয়েছে। গ্রামে ঢুকতেই বদলে গেল ছবিটা।



রাস্তার ধারে যে লক্ষ লক্ষ  লাইন দিয়ে ফুচকা দেখা গিয়েছিল আসলে সে গুলো  ফেলে দেওয়া হয়েছে। নষ্ট হয়ে গেছে এই ফুচকাগুলো। এই নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ফুচকার কারিগর বিশ্বজিৎ  বিশ্বাস বলেন, "রাজ্যের অধিকাংশ জেলাতে এই পুলিননগর থেকে ফুচকা যায় । প্রচুর চাহিদা। সেই জন্য আমাদের মাল মজুত করে রাখতে হয় । আর বিয়ে বা কোন অনুষ্ঠানের সিজনে অতিরিক্ত মাল তৈরি করতে হয়। মার্চ এপ্রিল বিয়ের সিজন। তাই প্রত্যেকের ঘরে সাধারণ সময়ের থেকে অতিরিক্ত মাল মজুত ছিল । লকডাউনের আগে  প্রায় দু’মাস ধরে লাখ লাখ মাল প্যাকেট করা  হয়েছে। সেইসব ফুচকা প্যাকেট বন্দি অবস্থায় ঘরে পড়ে আছে। ফুচকা তৈরির পর দশ দিনের বেশি রাখা যায় না। সেখানে প্রায় দেড় মাস ধরে ব্যবসা বন্ধ। যারা মাল নেয় তারা কেউ মাল নেয়নি। যার ফলে লাখ লাখ ফুচকা রাস্তায় ফেলে দিতে হয়েছে  । শুধু রাস্তায় নয়, লাখ লাখ ফুচকা ফেলা হয়েছে নদীতেও। দাদা এমনিতেই খাবারের পয়সা নেই। তাই  গাড়ি ভাড়া করে ফুচকা নদীতে নিয়ে ফেলে আসা সম্ভব হয়নি। জানি এলাকা নোংরা হয়েছে। কিন্তু কোন উপায় নেই আমাদের। "


আরও পড়ুন- কমছে সংক্রমণের হার! দেশে অনেকটাই কমছে ডাবলিং রেট, জানিয়ে দিল কেন্দ্র


এই ফুচকা বানাতে লাগে বি আটা , পাম তেল আর সুজি । প্রচুর টাকার পুঁজি লাগে। তাই মাসখানেকের  লকডাউনের জন্য  ফুচকা কারিগরদের  মূলধন আর শ্রম দুটো রাস্তায় গড়াগড়ি খাচ্ছে। এই লকডাউনের দুশোটি পরিবারের গড়ে লক্ষাধিক টাকা ক্ষতি হয়েছে। শ্রম আর অর্থ দুটোই চলে যাওয়াতে  দুশোটি পরিবারের সামনে ভবিষ্যত অন্ধকার। এলাকার এক গৃহবধূ আন্না বিশ্বাস। তার স্বামী ফুচকার কারিগর। এই ক্ষতির মুখে পড়ে গৃহবধূর স্বামী মানসিক এতটাই বিপর্যস্ত যে কথা বলার শক্তি তার ছিল না । তাই আন্না বিশ্বাস বলেন, "আমাদের এই গ্রামে দুশোটি পরিবার এই পেশার সঙ্গে জড়িত। এটা একমাত্র রোজগারের পথ। পুঁজি  বলতে আর কিছু নেই। সব শেষ হয়ে গেছে। লকডাউন উঠে গেলেও ব্যবসা করার মত আর পুঁজি নেই।  পরিবার নিয়ে না খেতে পেয়ে মরে যাব।" আর কথা বলতে পারলেন না আন্না বিশ্বাস। কান্নায় তার গলা জড়িয়ে  আসে।



একমাসের উপর বন্ধ দুশোটি পরিবারের ব্যবসা। তাদের এখন বেঁচে থাকার রসদ জোগাচ্ছে পরিবার প্রতি রেশনের দু’কেজি চাল আর এক কেজি আটা । সরকারের এই অনুদান  বেশিদিন চলবে না । এটা ভেবেই চোখে অন্ধকার দেখছেন পুলিননগরের দুশোটি পরিবার । লকডাউন যদি আরও  বেশি দিন চলে  তাহলে অনাহারে মৃত্যু ছাড়া আর কোন রাস্তা খোলা নেই এদের সামনে । তাই পুলিননগরের দুশোটি পরিবারের আর্জি , তারা জানে না তাদের ভবিষ্যত কি? সরকার যদি মানবিকতার সঙ্গে এই দুশোটি পরিবারের কথা চিন্তা  করে তাহলে তারা পরিবারের নিয়ে বাঁচতে পারবে । সেই আশায়  বুক বেঁধে দিন গুনছেন  রানাঘাটের পুলিননগর গ্রামে বিশ্বজিৎ, আন্নারা।


তথ্য সংগ্রহে: বিশ্বজিৎ মিত্র