সৌমিত্র সেন


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

তিনি ভাঙলেন। কিন্তু তেমন  শব্দ হল না। সব কিছু গেল-গেল হল না। আসলে তাঁর লেখার এবং যাপনের, ভাবনার এবং আখ্যানের ধরনটাই এরকম-- বাহ্যত প্রায়-কোনও বিপ্লব নেই; কিন্তু এক গভীর অন্তর্ঘাত ভেতর থেকে নতুন করে সব কিছু গড়ে দেয়।


যেমন দিয়েছিল বাংলা উপন্যাসকে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (Bibhutibhushan Bandyopadhyay) যে সময় লিখতে শুরু করলেন তখন বাংলা গদ্যসাহিত্যে রবীন্দ্র-শরতের দোর্দণ্ডপ্রতাপ। বঙ্কিমের পথ ধরে এবং বঙ্কিমকে কিছুটা অস্বীকার করেই তত্‍কালীন যে-গদ্যভাষাটি ক্রমান্বয়ে গড়ে উঠছিল, সেটাই তখন এত বড় হয়ে দেখা দিয়েছে যে, লিখতে এসে প্রায়শই তার খাপ থেকে বেরনো যাচ্ছিল না। বিশেষত আদলটাকে অস্বীকার করা কঠিন হচ্ছিল। বিভূতিভূষণ সেই দারুণ কঠিন কাজটাকে সহজ করে দিলেন।


আরও পড়ুন: Rajnarayan Basu: একাল আর সেকালকে গেঁথে দিয়েছিলেন উনিশ শতকের এই বিশিষ্ট বাঙালি


'পথের পাঁচালী'র মতো সহজ জাতের সহজাত  সাহিত্য-বিপ্লব সম্ভবত বাংলা সাহিত্যে দু'বার ঘটেনি। এই লেখাতেই ঠিক সেই অর্থে কোন প্লট নেই, কোনও সুনির্দিষ্ট ন্যারেটিভ নেই (যা ক্রমে চূড়ান্ত রূপ পরিগ্রহ করবে 'আরণ্যক'-য়ে), কাহিনির কঠিন গ্রন্থনার ভিতর দিয়ে কোনও ক্ল্য়াইম্যাক্সে পৌঁছনোর আকূতি নেই; বরং একটা আদিগন্ত বিচ্ছুরিত প্রবাহ আছে, প্রাণের আবেগের একটা প্রথাগত টান, যা মূহূর্তে-মুহূর্তে অচেনাকে চেনার অজানাকে জানার উদ্বেলতার মীড়ে চেনা রাগকেও অচেনা করে তোলে; আর জীবনকে ঘিরে একটা জমাট রসের আবহ তৈরি হয়, যা মধুময়  পৃথিবীর ধূলির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে পাঠককে স্তব্ধ রাখে, তার মন এক উত্তুঙ্গে বেঁধে দেয় এবং পুরোটাই হয় খুব সাধারণ ভাষাভঙ্গির সাধারণ প্রকরণের খোপকাটা চৌহদ্দির মধ্য়েই।  



মার্টিন সেমোর-স্মিথ (Martin Seymour-Smith) সাধে তাঁর বহুচর্চিত Guide to Modern World Literature শীর্ষক  সন্দর্ভে 'পথের পাঁচালী'কে গোটা বিশ শতকের ভারতীয় গদ্য ও কাব্য সাহিত্যে এক তুলানহীন সৃষ্টি বলে চিহ্নিত  করেন! 'পথের পাঁচালী' যেন এই সময়-পর্বের সমগ্র ভারতীয় সাহিত্যে মাথা উঁচু করে একেবারে একা দাঁড়িয়ে আছে! মার্টিন অবশ্য শুধু সৃষ্টি নিয়েই বলেননি, স্রষ্টার বিষয়েও মন্তব্য করেছেন। কোনওরকম রাখ-ঢাক না-করেই শুধু একটি ছোট্ট 'হয়তো' সহযোগে তিনি বিভূতিভূষণকে সমস্ত আধুনিক ভারতীয় ঔপন্যাসিকের মধ্যে শ্রেষ্টতম বলে উল্লেখ করেছেন (perhaps the best of all modern Indian novelists)!


অথচ, এত বড় যে একটা 'বিপ্লব' বিভূতিভূষণ করলেন, পাকে-চক্রে সেইখানেই থেমে গেলেন না, তাঁর সৃষ্ট চরিত্রের 'চরৈবেতি' যেন তাঁকেও পেয়েছিল; তাই কেবলই পথ ভেঙেছেন, চড়াই-উতরাই অন্তহীন। আটপৌরে বঙ্গজীবন থেকে সটান গিয়ে পড়েছেন ভাগলপুরের আদিগন্ত বিস্মতৃ জ্যোত্‍স্নাবিধৌত অরণ্যে। কোথাও এতটুকু 'জার্ক' লাগেনি। 'অপু'র পাশে 'সত্যচরণ'কে বেমানান লাগেনি। বাংলার বাঁশবাগান ভাঁটফুলের পাশে অনায়াসে চলে এসেছে ফুটন্ত রক্তপলাশের বন, শুভ্রকাণ্ড গোলগোলি ফুল বা ধাতুপফুলের জঙ্গল, নীল-হলদে হিংলাজের কাব্য, রৌদ্রদগ্ধ নিষ্পত্র গুল্মরাজির কথা, বনকুসুমের মৃদুমধুর গন্ধ আর শালিক-চড়াইয়ের পাশাপাশি বনটিয়া, হরটিট, হরিয়ালের ডানার অলৌকিক মুখরতা। সঞ্জীবচন্দ্র চট্টাপাধ্যায় তাঁর 'পালামৌ'তে যেন যা করতে চেয়েছিলেন তাকেই বহুগুণ বর্ধিত করে আরও মর্মবেদনার সঙ্গে আরও নিবিড় কাব্যসুষমার সঙ্গে তৈরি করলেন বিভূতিভূষণ, যে-সৃজন আক্ষরিক অর্থেই সমগ্র বাংলাসাহিত্যেই নয় শুধু, গোটা ভারতীয় সাহিত্যেও একক এক ও অদ্বিতীয়।  


গদ্য়কে গদ্যের চেনা চলনের আঁটে ধরিয়েও তার  মধ্যে যে এতটা কাব্য জমিয়ে তোলা যায়, বিভূতিভূষণ না-থাকলে কেই-বা শেখাত বাঙালিকে, বাংলা গদ্যকে? 


বাংলা উপন্যাস নিয়ে তাঁর অতি-বিখ্যাত ডিসকোর্সে ('উপন্যাস নিয়ে'/চতুর্থ সংস্করণ/'বাংলা উপন্যাস') তাই হয়তো দেবেশ রায় যেমন সহসা বলে ফেলেন 'বিভূতিভূষণের ফর্ম বা টেকনিক বাংলা উপন্যাসের স্থিরীকৃত মডেলকে প্রায় ভেঙে দেয়' এবং এভাবে আলোচনা চালাতে চালাতে দেবেশ এক জায়গায় একটা সাঙ্ঘাতিক কথা লিখে ফেলেন-- '....বিভূতিভূষণ বোধ হয় তাঁর বিবরণে সব চেয়ে নির্মমভাবে পুরাণ ভাঙেন আর সবচেয়ে মমতায় নতুন পুরাণ গড়ার রসদ সাজান'! 'পুরাণ ভাঙা'-- সে-ই তো এক ঘোরতর কঠিন দুর্গম কাজ; পাশাপাশি 'নতুন পুরাণ গড়ার রসদ' জোগানো? সে-ও যে এক অকল্পনীয় সৃষ্টিপ্রতিভা!


হ্যাঁ, কালক্রমে বোঝা যাচ্ছে এবং অনাগত দিনে হয়তো আরও-আরও বোঝা যাবে, বিভূতিভূষণ সত্যিই তাঁর আপাত সারল্য ও সহজতার আটপৌরে মোড়কে এমন এক স্রষ্টা যিনি সুচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরোন!  


(Zee 24 Ghanta App : দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির লেটেস্ট খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Zee 24 Ghanta App)


আরও পড়ুন: Sunil Gangopadhyay: বাংলা গদ্যে ও কাব্যে এনেছিলেন নতুনদিনের ভাষাভঙ্গি