কমলাক্ষ ভট্টাচার্য: বড় সুন্দর এই যাত্রাপথ। বারবার মনে আসছে জীবনানন্দ দাশের রূপসী বাংলা। কত বছর আগে প্রয়াগের কুম্ভমেলায় এক সাধুবাবা বলেছিলেন, নিজের দেশকে ভাল ভাবে জানলেই ভগবানকে জানা হয়ে যায়। কোনও একটা বিশ্বাসে আটকে যাওয়াই মৃত্যু। দেখতে দেখতে আর ভাবতে ভাবতে পৌঁছে যাওয়া লাভপুর। হেমন্তের আলোয় ঝলমল করছে শক্তিপীঠ ফুল্লরা। চারদিক গাছপালায় ঘেরা। বেশ একটা ছায়াময় পরিবেশ। লোকালয় থেকে একটু দূরে। ঢুকতেই প্রথমে পড়বে পাকা সিঁড়ি বাঁধানো সরোবর। তার পাশ দিয়ে একটু এগোলেই দেবী ফুল্লরার মন্দির। 


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

তন্ত্রচূড়ামণিতে একান্ন পীঠের ৪৯ তম পীঠ লাভপুরের ফুল্লরা। দেবীপুরাণ মতে, সতীর অধরোষ্ঠ পড়েছিল এখানে। মন্দির চত্বরে পঞ্চমুন্ডির আসন এখনও বিদ্যমান। এখন তাতেও লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। ৬৬ বিঘা জমি নিয়ে ফুল্লরা মহাপীঠ। মাতৃমন্দিরে প্রাচীনত্বের ছাপ নেই, সংস্কার হয়েছে। ১৩০২ বঙ্গাব্দে স্থানীয় জমিদার যাদবলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, এই মন্দির নির্মাণ করেন। 


মূল মন্দিরের সামনে রয়েছে সুবিশাল নাটমন্দির। হোম যজ্ঞ থেকে মাতৃ আরাধনার নানা পর্ব এখানে অনুষ্ঠিত হয়। নাটমন্দিরের অদূরে রয়েছে এই জলাশয়। নাম দেবীদহ। দেবীদহকে কেন্দ্র করে যুগ যুগ ধরে যে লোকশ্রুতি রয়েছে, তার সঙ্গে জড়িয়ে রামায়ণের কাহিনি। পবনপুত্র হনুমান রামচন্দ্রের দেবী দুর্গার অকাল বোধনের জন্য এই জলাশয় থেকেই একশো আটটি নীলপদ্ম সংগ্রহ করেছিলেন। অধ্যাত্মভূমি ভারতে ধর্ম আর সংস্কৃতির সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছে বহু মন্দির। এমন দেবালয় দর্শনের একটা আলাদা অনুভূতি থাকে। বেলার দিকে ভিড় কমতেই আবার যাওয়া দেবীগৃহে। 



শান্তিনিকেতন থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই জায়গায় মূলত মন্দির কেন্দ্রিক জনপদ। শক্তিপীঠ ফুল্লরা অট্টহাস নামেও পরিচিত। বীরভূমের প্রাচীন ফুল্লরাপীঠ এক সময় ছিল তান্ত্রিকদের আভিচারিক ক্রিয়াক্ষেত্র। নির্জনতার কারণে, দেশের নানা প্রান্ত থেকে সাধকরা এসে, এখানে আসন পেতেছেন। তন্ত্র সাধনার উত্তম স্থান হিসেবে প্রসিদ্ধ ফুল্লরায় আগে নিয়মিত শিবাভোগের চল ছিল। 


প্রতিদিন এখানে অন্নভোগের ব্যবস্থা আছে। দেবীকে রোজ মাছের টক নিবেদন করা হয়। সামান্য প্রণামীর বিনিময়ে যে কেউ প্রসাদ পেতে পারেন। আমিষ ও নিরামিষ, দুরকম ভোগই হয়। প্রতি অমাবস্যায় বিশেষ পুজো হয় ফুল্লরায়। মাঘী পূর্ণিমাতে বিরাট মেলা বসে। ১৫ দিন ধরে চলে উত্‍সব। শেষ হয় শিবরাত্রিতে। আউল বাউল পীর দরবেশের গানে মুখর হয়ে ওঠে মন্দির প্রাঙ্গন। 


পীঠভূমি বীরভূম। প্রাচীন ঋষিদের আরাধ্যদেবী গৌরীর দেশ। তন্ত্রসাধকদের পরমপথ সন্ধানের সাধনক্ষেত্র। চৈতন্য মহাপ্রভুর সময়ে বীরভূমে শাক্ত ধর্মের প্রভাব এতটাই প্রবল ছিল, যে বীরাচারী সন্ন্যাসীরা গৌরীকে পরিত্যাগ করে গৌরের অনুগামী হতে পারেননি। চৈতন্য লীলা কীর্তনকারী বৃন্দাবন দাসের লেখা পদে তার প্রমাণ মেলে। বীরভূম সম্পর্কে মহাপ্রভুর মুখ দিয়ে সেখানে বলানো হয়েছে, "ভক্তিশূন্য সর্ব্বদেশ না জানে কীর্তন, কারো মুখে নাহি কৃষ্ণনাম উচ্চারণ। " 


বীরভূমের বীরচন্দ্রপুরে জন্মগ্রহণ করেও, বৈষ্ণব প্রভু নিত্যানন্দ ভক্তিরসের জোয়ারে শাক্তদের ভাসাতে পারেননি। লাল মাটির পীঠস্থানগুলিতে বৈষ্ণবদের প্রবেশাধিকার অতীতে সেভাবে ছিল না। কিন্তু এখন আর সেসব নেই। মহাবৈষ্ণবী ফুল্লরার দরবারে ওঠে হরিনামের বোল।


এই লাভপুরেই কথা সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম। এটা হল তাঁর  পৈর্তৃক ভিটে, যেখানে তিনি বেশিরভাগ সময় সাহিত্যকর্মে অতিবাহিত করেছেন। বরেণ্য কথা সাহিত্যিকের স্মৃতি বিজড়িত বাড়িতে গড়ে ওঠেছে সংগ্রহশালা। ফুল্লরা মন্দিরের অদূরেই রয়েছে তারাশঙ্করের জন্মভিটে। 


বিয়ের পর কয়েক বছর নিঃসন্তান থাকায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মা শ্রীরামজি গোসাই নামে এক মহাসাধকের কাছে যান। তাঁর নির্দেশে, দুর্গাপুজোর পর চতুর্দশীতে তারাপীঠে পুজো দিয়ে, দেবী ফুল্লরার কাছে ব্রত উদযাপন করেন। তারপরই গর্ভবতী হন এবং এক পুত্রসন্তানের জন্ম দেন। মা তারার নামে সন্তানের নাম রাখা হয় তারাশঙ্কর। বৈচিত্র্যে ভরা এক পীঠভূমি। যাঁকে ঘিরে সব কিছু আবর্তিত হচ্ছে, তিনি হলেন দেবী ফুল্লরা।