সৌমিত্র সেন: তাঁর রচনা থেকে উঁকি দিত কচি সবুজ পাতা, তাঁর অক্ষর-পল্লবের ফাঁক থেকে ডেকে উঠত পাখি, তাঁর বাক্য থেকে ভেসে আসত অরণ্যের আঘ্রাণ। চলে গেলেন 'বৃক্ষমানব' সেই কমল চক্রবর্তী।


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

আরও পড়ুন: INS Arighat: 'অরিহন্তে'র পরে 'অরিঘাত'! পরমাণুশক্তির জোড়া ফলায় ভারত এবার মহাসমুদ্রেও মহাশক্তিধর...


বেশ কিছুদিন ধরে ভুগছিলেন কবি ও কথাকার কমল চক্রবর্তী। ২০ অগাস্ট রাতে তাঁর একবার মাথা ঘোরে। ২১ অগাস্ট বিকেল তিনটে নাগাদ আবার মাথা ঘোরে। সঙ্গে সঙ্গে ব্ল্যাক আউট। উল্টে পড়ে যান। মাথার পিছনে মারাত্মক আঘাত লাগে। রক্তপাত হয়। বমিও। ভর্তি করা হয় জামশেদপুরে টাটা মেইন হাসপাতালে। ২১ আগস্ট বিকেল থেকেই সংজ্ঞাহীন। গত আটদিন কোমায় ছিলেন। শারীরিক অবস্থা আশঙ্কাজনকই ছিল। মস্তিষ্কে রক্ত জমাট বেঁধেছিল। ভেন্টিলেশনই চলছিল। পরে ভেন্টিলেশনে স্টেপ ডাউন করে ডাক্তারেরা দেখছিলেন, সেই ব্যবস্থা তাঁর শরীর নিতে পারে কি না। অপারেশন না করার সিদ্ধান্তই নিয়েছিলেন তাঁরা। সব মিলিয়ে ব্রেনডেথের অনেকটা কাছাকাছি অবস্থা। অবশেষে ৩০ অগাস্ট, শুক্রবার চলে গেলেন বাংলা সাহিত্যের রঙিন-কথক কমল চক্রবর্তী।



লৌহনগরী জামশেদপুরের সিটিস্কেপে কমল ছিলেন এক মূর্তিমান বিপ্লব-- একটা 'পোয়েটিক রিলিফ'! 'ভালোপাহাড়ে'র মানুষ, সেখানকার প্রকৃতি, আকাশ-মাটি-জল-- সবটা নিয়েই তিনি যেন ধীরে ধীরে এই শহরসভ্যতার, এই আধুনিকতার বিপ্রতীপে একটা অন্য জগৎ তৈরি করছিলেন; আর, তাঁর সেই 'অপর'কে জড়িয়েই ফুলের মতো ফুটে উঠছিল সেই নির্জন জনপদের বিলোল আত্মা, যা আদতে 'অপর' নয়, 'মেইন স্ট্রিম'ই।


'কৌরব' নাটক এবং 'কৌরব' পত্রিকা-- এই ছিল কমল চক্রবর্তীর প্রাথমিক পরিচয়। সেখানেই আটকে থাকেননি। শহর থেকে, শহুরে সভ্যতা থেকে, শহুরে বোল-চাল থেকে ক্রমশ সরে-সরে পাহাড়ের কাছে গিয়েছেন, গাছের কাছে গিয়েছেন, ঝরনার কাছে গিয়েছেন, পাখির কাছে গিয়েছেন।


মানুষের কাছেও গিয়েছেন। ভালোপাহাড়ে দীর্ঘ সময় ধরে বৃক্ষরোপণ করেছেন কমল। বৃক্ষহীন প্রকৃতিকে ক্রমশ বৃক্ষময় করে তোলেন তিনি। কী নেই সেই সৃজিত অরণ্যতলে-- অশ্বত্থ, পাকুড়, শিমুল, সপ্তপর্ণী, গামার, মহুয়া, হরিতকী, অর্জুন, শাল, শিরীষ, মেহগনি, সোনাঝুরি, পলাশ, আম, কাঁঠাল, হিজল, শিশু, কেয়া, ছাতিম, ঝাউ, দেবদারু, বাঁদরলাঠি, বহেড়া, কেঁদ, মুচকুন্দ, জামরুল, জাম-- নাম যেন শেষ করা যায় না! আর এই গহন অরণ্যেই সকাল-সন্ধ্যা ডেকে চলত টিয়া, ঘুঘু, বুলবুলি, বসন্তবৌরি, ইষ্টিকুটুম, কোকিল, শালিক, কাক, চড়াই, টুনটুনি, হাড়িচাঁচা, মুনিয়া, বক, বেনেবউয়ের কাকলি। অনুর্বর জমিতে শুরু করান আবাদ, শুরু হয় দেশি ধানের চাষ, খামারে গরু। আর এই চাষ-আবাদ, পশুপালন, এই বৃক্ষসংসার-পাখিসংসারের সঙ্গেই খোলেন স্কুলও। আদিবাসী-অধ্যুষিত এলাকার ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে সেখানে একটা অন্যরকম যাত্রাও শুরু হয় তাঁর।


আর এই সব কাজের ফাঁকেই তাঁকে ভর করে লিখনও। লিখনে কী ঘটে, কে জানে! কিন্তু কিছু তো ঘটে! তাঁর কলম থেকে বাংলা সাহিত্য পায় একটা অন্যরকম ভাষাশৈলী, অন্যরকম বিষয়-- গদ্যে-পদ্যে, কিছুটা স্মৃতিচারণাতেও। সুনীল-শক্তির সাহিত্যসঙ্গী, হাংরির সঙ্গেও একটা যোগ বিরচিত ছিল, সুখ-পর্যটন, বোহেমিয়ান জীবনের উত্তেজনা-যাপন, পাশাপাশি লৌকিক জীবন ও সংস্কৃতির সান্নিধ্য আর প্রকৃতির অলৌকিকে অবগাহন-- এই ছিল দশকের পর দশক ধরে কমল-কথা। গত শতকের সাতের দশকের দুরন্ত কবি ও কথাকার কমল চক্রবর্তী তাঁর 'জল', 'চার নম্বর ফার্নেস চার্জড' ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থের জন্য, 'কৌরব' পত্রিকার জন্য এবং বেশ কিছু উপন্যাসের জন্য সাহিত্যপ্রেমীদের কাছে স্মরণীয় থেকে যাবেন। 'হে বৃক্ষনাথ' নামে একটি চমৎকার পুস্তিকাও রচনা করেছিলেন, বৃক্ষবন্দনাই ছিল যার মুখ্য বিষয়। 


কমল চক্রবর্তী যান্ত্রিক নাগরিকতা থেকে এভাবেই এক কোলাহলহীন অযান্ত্রিক সবুজের মধ্যে খুঁজে নিয়েছিলেন নিজের প্রস্থানবিন্দু। তাঁর একহাতে ছিল কলম, অন্য হাতে নিড়ানি; এক হাতে লিখছেন, অন্য হাতে ছড়িয়েছেন বীজ। সেই বীজ অঙ্কুর হয়েছে, অঙকুর ক্রমে গাছ হয়েছে, গাছ বৃক্ষ। তিনি সেই গাছপুরাণ আর পাখিপুরাণের ভিতরে যেন এক আদি মানুষ হয়ে রয়ে গিয়েছিলেন স্মৃতি ও সভ্যতার চেনা ছকের বাইরে-দূরে। 


আরও পড়ুন: Typhoon Shanshan: প্রবল বাতাস, সমুদ্রে জলের দেওয়াল, মুষলধারে বৃষ্টি, ভূমিধস! ভয়াবহ পরিস্থিতি...


আর কি সেখান থেকে কখনও 'হে বৃক্ষনাথ, হে বৃক্ষনাথ' বলে গভীর রাতে ভেসে আসবে কোনও কান্নার কাব্য? আর কি সেখানে, সেই আঁধার-লগ্ন ছায়াচ্ছন্নতায় কোনও দিন দেখা যাবে দু'হাত দিয়ে গাছ জড়িয়ে ধরে বিহ্বল দাঁড়িয়ে আছেন এক গাছপুরুষ?


(দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির টাটকা খবর, আপডেট এবং ভিডিয়ো পেতে ডাউনলোড-লাইক-ফলো-সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের AppFacebookWhatsapp ChannelX (Twitter)YoutubeInstagram পেজ-চ্যানেল)