#উৎসব: বণিকবাবুদের হাত ধরে কার্তিকপুজো কাটোয়ায় হয়ে দাঁড়াল রংদার `কার্তিক লড়াই`
মাতৃত্বের ব্যাকুল বেদনার মধ্যেই শুরু হল কার্তিক পুজো।
সন্দীপ ঘোষচৌধুরী
সারাবাংলার কার্তিক পুজো কাটোয়ায় 'কার্তিক লড়াই' নামে খ্যাত। আর কোথাও কার্তিক পুজো এরকম ভিন্ন নাম পায়নি। কার্তিক পুজো তথা কার্তিক লড়াই ঘিরে অনেকদিন থেকেই সেজে উঠছে কাটোয়া শহর। কিন্তু কী ভাবে এখানে শুরু হল কার্তিক লড়াই? এর একটা ইতিহাস আছে।
তখন কাটোয়া মুর্শিদাবাদের প্রবেশদ্বার ছিল। ব্যবসা-বাণিজ্য বেশ জমজমাট হয়ে উঠছিল কাটোয়ায়। ব্যবসা বাণিজ্যকে কেন্দ্র করেই এখানে ক্রমশ গড়ে উঠছিল এক বাবুসমাজ। এই বাবুদের মনোরঞ্জনের জন্য ক্রমে এখানে গড়ে উঠতে শুরু করল নিষিদ্ধপল্লীও।
সন্ধ্যা ঘনালেই সে সময়ে কাটোয়ার চুনারিপাড়া, লবণগোলা পাড়ার নিষিদ্ধপল্লীর ঘরগুলিতে জ্বলে উঠত বাহারি আলো। রংদার পোশাকে বাবুরা পৌঁছে যেতেন বারবণিতাদের পাড়ায়। আর ততোধিক ঝলমলে পোশাকে বাবুদের কাছ নিজেদের মোহময়ী করে তুলতেন বারবণিতারা। বাবুদের খুশি করে মিলত অর্থ, বিলাসবহুল জীবনযাপনের প্রতিশ্রুতি। কিন্তু এর পরেও কোথাও একটা খামতি থেকে যেত বারবণিতাদের জীবনে। কোনও দুর্বল মুহূর্তে মাতৃত্বের আকাঙ্ক্ষায় ব্যাকুল হয়ে পড়তেন তাঁরা। সেই আকুল বেদনা থেকেই এখানে শুরু হল কার্তিক পুজো। কার্তিক তাঁদের কাছে সন্তানসম।
স্থানীয় ইতিহাস বিশেষজ্ঞদের মতে, কাটোয়া শহরের ঐতিহ্যবাহী এই কার্তিক পুজোর সূচনা হয়েছিল কাটোয়ার নিষিদ্ধপল্লী থেকেই। জানা যায়, কাটোয়া শহরের প্রাচীন নাম ছিল 'কণ্টকনগর'। কাটোয়ার উপর দিয়ে বয়ে চলা ভাগীরথী নদী তখন ছিল বাণিজ্যের জরুরি মাধ্যম। দেশ বিদেশের ব্যবসায়ীরা নদীপথে কাটোয়ায় বাণিজ্য করতে আসতেন। এই সব বণিকবাবুদের হাত ধরে দেশ বিদেশের হরেক মালপত্রও আসত কাটোয়ায়। আর কাটোয়া থেকে সেসব যেত দূর দূরান্তে। এই বণিকবাবুদের অনেককেই ব্যবসার প্রয়োজেন রাত কাটাতে হত কাটোয়ায়। আর তাঁরা রাত্রিবাসের জন্য বিশেষ করে বেছে নিতেন কাটোয়ার সদ্য গড়ে উঠতে থাকা নিষিদ্ধপল্লীগুলি। এখানকার সংস্কৃতির সঙ্গে তাঁরা জড়িয়েও পড়তে শুরু করলেন। এক সময় এই বণিকবাবুরা জড়িয়ে পড়ল এখানকার কার্তিকপুজোর সঙ্গেও। নিজের বারবণিতাটির দুঃখ ঘোচাতে তাঁকে খুশিতে রাখতে এই বাবুরা কার্তিক পুজোয় অঢেল টাকা খরচ করতেন। তাঁদের টাকাতেই কার্তিকপুজোর বিপুল আয়োজন হত। আলো, ভোজ, গানবাজনা, শোভাযাত্রার বিপুল জৌলস। আর চলত এসব নিয়ে ঘোরতর প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতা চলত এক বারবণিতার সঙ্গে অন্য বারবণিতার। কিন্তু তা আসলে এক বাবুর সঙ্গে অন্যবাবুর। কার্তিকপুজোকে ঘিরে এই যে লড়াই সেই থেকেই এখানে সূচনা হল কার্তিক লড়াইয়ের।
কাটোয়ার গঙ্গাতীরে বর্তমান হরিসভাপাড়ার প্রাচীন নাম ছিল চুনারিপাড়া। এই পাড়াতেই বাবুদের আশ্রয়ে ছিল পতিতালয়। এখানকার পতিতাদের পূজিত ন্যাংটো শিশু কার্তিকের উপাসনা থেকেই শুরু হয়েছিল কাটোয়ার কার্তিক পুজো। সময়ের সঙ্গে অনেক কিছুর পরিবর্তন হলেও সেই ন্যাংটো কার্তিকের পুজো আজও কাটোয়ার প্রাচীন সাংস্কৃতিক উদযাপনগুলির অন্যতম। কাটোয়া শহরে পতিতাপল্লী আর নেই। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভাগীরথী দিয়ে বয়ে গেছে অনেক জল। কিন্তু কাটোয়ার কার্তিক লড়াইয়ের ঐতিহ্য এখনও স্বমহিমায় বর্তমান। কাটোয়ার কার্তিক লড়াই ক্রমশ কাটোয়ার গর্বে পরিণত হয়েছে।
আরও পড়ুন: Kartikeya: কোথাও 'সুব্রহ্মণ্যম' কোথাও তিনি 'মুরুগান'- কী ভাবে জন্ম কার্তিক ঠাকুরের?