শুধু বিদ্রোহী নন, বরং প্রেম ও সুন্দরের সার্থক সাধক নজরুল
কবিপক্ষের শেষ এই নজরুলজয়ন্তী। ১১ জ্যৈষ্ঠ। নজরুল ইসলামের জন্মদিন।
সৌমিত্র সেন
নজরুলের নানা পরিচয়। কিন্তু সব পরিচয় ঢেকে তাঁকে আমরা দাগিয়ে দিয়েছি 'বিদ্রোহী কবি' হিসেবে। বিদ্রোহী তিনি বটেই। এজন্য নয় যে, ওই নামেই তাঁর বহুবিখ্যাত-বহুচর্চিত দীর্ঘ কবিতাটি রয়েছে। তিনি 'বিদ্রোহী' অন্য অনেক কারণেও। যুগোত্তরের সাধনা না করে যুগের যে-চর্চায় তিনি নিজেকে নিঃশেষে দান করেছিলেন, তার তুলনা কমই আছে। কিন্তু অমিত প্রতিভার অধিকারী ছিলেন বলেই তিনি হুজুগের কবি হয়েও নিজের যুগ ছাড়িয়ে আমাদের কালে এসেও ছায়া ফেলেছেন।
মূলত-কবি নজরুল ইসলাম তাঁর বিপুল কাব্যে সাম্যবাদের ধুন তুলেছেন। তাঁর কাব্যে রয়েছে শ্রেণিচেতনা, মানবতা, নিপীড়িতের প্রতি সহমর্মিতা, রয়েছে স্থানিক ও সাময়িক রাজনৈতিকতার সঙ্গে আন্তর্জাতিকতার মিশেলও। তিনি 'মজদুর স্বরাজ পার্টি'র 'লাঙল' পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন, পরে 'ধূমকেতু'। স্বদেশি গান-কবিতা লিখেছেন, জেল খেটেছেন। কিন্তু এই বহুবিচিত্রকর্মা কবিটির ফুটন্ত অন্তরে একটা মর্মরিত বাঁশিও ছিল। সে-বাঁশিতে বাজত সুন্দর ও প্রেমের সুর।
আরও পড়ুন: শুরু করেছিলেন শরৎচন্দ্র, ১৫০ বছর পরেও বলতে হচ্ছে, 'বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও'
যিনি তাঁর বিদ্রোহী-তকমা সৃষ্টিকারী কবিতাতেই এমন চরণ লেখেন-- 'আমি বন্ধনহারা কুমারীর বেণী, তন্বী নয়নে বহ্নি/আমি ষোড়শীর হৃদি সরসিজ প্রেম উদ্দাম, আমি ধন্যি', তাঁর চিত্ততলে যে প্রেম ও সুন্দরের ধ্যানপ্রবাহ ফল্গুর মতোই নিহিত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
'অনামিকা' কবিতায় তিনি লিখছেন-- 'আমারি প্রেমের মাঝে রয়েছে গোপন/বৃথা আমি খুঁজে মরি জন্মে জন্মে করিনু রোদন'। যে-কোনও আত্মমগ্ন আত্মসংবেদী গীতিকবির মতোই নজরুলের কাব্যেও আত্মের উদযাপন আছে, তবে তা একটু আলাদা ধাঁচে ও ধরনে। ওয়াল্ট হুইটম্যান যেমন তাঁর 'Song of Myself' শুরুই করেছিলেন 'I celebrate myself and sing myself' দিয়ে, তেমনই কি নজরুল-কবিতায় শোনা যায়নি এমন উল্লাস-- 'আমি সহসা আমারে চিনিয়া ফেলেছি আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ'?
দেখতে গেলে অবশ্য কবিতায় নয়, গানেই এই-নজরুলের প্রকাশ বেশি। সঙ্গীতের নজরুল অনেক মেদুর ও মধুর, অনেক নিভৃত ও নিবিড়, অনেক গহন ও তন্ময়। দেহাতীত অসীম অনন্তকে পাশ কাটিয়ে তিনি আমাদের চেনা-দেখা জগতের যে ইন্দ্রিয়-সংবেদ্য রূপকল্প রচনা করেন, যেখানে আমরা জুঁইয়ের পাশেই পাই হাসনুহানাকে, গোলাপবাগের পাশেই পাই দ্রাক্ষাবনকে, হেনার পাশেই পাই শেফালিকে; এবং তাঁর গানের সেই রক্তদীপ্ত উষ্ণ স্নিগ্ধ সংরাগললিত মনোবেদনার আশ্লেষমদিরতাই যেন তাঁর কবিমনটিকে সব কিছুর ঊর্ধ্বে তুলে রাখে। এবং আমরা আজও বিস্মিত-আপ্লুত হই।
আরও পড়ুন: শ্রদ্ধাবীজ, জলপাত্র ও এক 'সম্বুদ্ধ' কৃষক'রত্নে'র কাহিনি