পার্থ চৌধুরী: প্যাঁচার কলোনি গড়ে উঠলে নাকি সেই এলাকায় কোভিডের প্রকোপ কমে। অন্তত তেমনই দাবি পূর্ব বর্ধমানের কাঞ্চনগর ডি এন দাস হাইস্কুলের প্রধানশিক্ষক সুভাষচন্দ্র দত্তের। শুধু 'দাবি' বললে অবশ্য কম বলা হয়। তিনি এ নিয়ে রীতিমতো গবেষণাও করেছেন। তাঁর এই গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে বিদেশি জার্নালে। এজন্য স্বীকৃতিও পেয়েছেন। 'জাতীয় শিক্ষক সম্মান', 'শিক্ষারত্ন' পুরস্কার।


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

আরও পড়ুন: Bengal Weather Update: ক্রমশ নামছে পারদ, মরসুমের শুরুতেই তাপমাত্রায় রেকর্ড কলকাতার! ঝঞ্ঝা উড়িয়ে শীত কি প্রবল হবে?


শুনে চমক লাগতে পারে। ২০১৫ সালে একটি বার্ন আউল একদিন উড়ে এসে বসে সুভাষচন্দ্রের স্কুলের কুলুঙ্গিতে। তারপর তাঁর ভালবাসায় জড়িয়ে পড়ে পাখিটি। সেই শুরু। তারপর ক্রমে লক্ষ্মী প্যাঁচা, হুতোম প্যাঁচা, কাল প্যাঁচা মিলিয়ে সুভাষের এখন বিরাট সংসার। গাছের ডালে ডালে ঝুলন্ত বাসা থেকে সব সময় মাজা গলা চাঁচা স্বরে প্যাঁচাদের তীক্ষ্ণ চিৎকার ভেসে যায় বাতাসে, ডানা ঝাপটায় পাখির দল, খেলা করে কাঠবিড়ালি-বেজি।


কিন্তু কীভাবে হল কোভিড সংক্রান্ত  এই চমকপ্রদ আবিষ্কার?


সুভাষচন্দ্র দত্ত জানান, তাঁরা প্যাঁচাদের ভুক্তাবশিষ্ট পিলেট নমুনা হিসেবে রাখেন। কোভিডের শুরুতে লক্ষ্য করেন, নিশাচরদের খাদ্যাভ্যাস পালটে গিয়েছে। ইঁদুর, ছুঁচো, বেজি নয়-- তারা 'ডিনার' সারছে বাদুড় আর চামচিকে দিয়ে। চারপাশে যা পাওয়াই যায়। এরপর গোটা কোভিডপর্বে বিস্তীর্ণ কাঞ্চননগর বা রথতলায় মাত্র দু'জন মারা গিয়েছেন। একজন হৃদরোগে, অন্যজন কো-মরবিডির জেরে। যাঁদের কোভিড হয়েছিল, তাঁরা দ্রুত সেরে উঠেছিলেন। বর্ধমান শহরেও কাছাকাছি এলাকাগুলিতে কোভিডের থাবা কিছুদিন পর আলগা হয়ে যায়।


সুভাষচন্দ্র জানাচ্ছেন, বিভিন্ন জার্নাল ঘেঁটে তিনি জানতে পারেন, বাদুড় এবং চামচিকেরা কোভিডের প্রত্যক্ষ বাহক। এর জেরে তাঁর প্রতীতী জন্মায়, এই অঞ্চলে সেই কোভিড-বাহকদের খেয়ে কোভিডের বিপদকেই আদতে লঘু করে দিয়েছে অবহেলিত এই পাখিবাহিনী।
তিনি আরও জানাচ্ছেন, আগেকার দিনে গ্রামের বাইরে প্যাঁচার জন্য বাসা বানানো হত। প্যাঁচা সতর্ক করতে পারে অজানা বিপদ থেকে। সামাজিক প্রতিষেধক হিসেবেও এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। শস্যের পক্ষে ক্ষতিকর প্রাণীদের মেরে মানুষের অনেক উপকার করে প্যাঁচা। এহেন প্যাঁচার বন্ধু এখন এই প্রধানশিক্ষক। প্যাঁচারা তাঁর ডাকে সাড়া দেয়, কথা শোনে, খায়-দায়, বাচ্চা দেয়। স্কুলে এখন গোটা ত্রিশেক প্যাঁচার সংসার। আগস্ট থেকে শুরু হয়েছে তাদের প্রজননকাল। কাঞ্চননগর এক কালে ছুরি-কাঁচির জন্য বিখ্যাত ছিল। এখন পেঁচারাই এখানকার অন্যতম আকর্ষণ।


তবে শুধু প্যাঁচাই নয়, স্কুলের বটগাছকে মাঝে রেখে তৈরি হয়েছে পাখিরালয়। আছে ছাতারে, গোলা পায়রা, শালিখ, চড়ুই-সহ আরও নানা পাখি। আছে কাঠবিড়ালি, মেঠো ইঁদুর,  ছুঁচো, বেজি। নানারকম সাপ। আছে একগাদা বাদুড়, চামচিকে। প্যাঁচারা নাকি এই বাদুড়ই খেয়ে এ এলাকার কোভিড নিয়ন্ত্রণ করেছে। সামাজিক প্রতিষেধক প্যাঁচাদের এই ভূমিকা নিয়ে তাঁর গবেষণাপত্র বিদেশি সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। বাস্তুতন্ত্রেও একেবারে উপরে থাকে প্যাঁচা। প্যাঁচা মোটেই নিরীহ প্রাণী নয়। হিংস্র এই নিশাচর ঘোর মাংশাসী। পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্র রক্ষায় এর গুরুত্ব অসীম, জানাচ্ছেন আদতে বিজ্ঞানের শিক্ষক সুভাষচন্দ্র দত্ত। জানালেন, এ কাজ তিনি একা করেন না। আছেন স্কুলের করণিক, চতুর্থ শ্রেণির কর্মীরাও। আছেন একজন কেয়ারগিভারও। সব চেয়ে বড় কথা প্রায়, ৬০০ ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে এই প্রাণীদের কোনো সংঘাত নেই। শিক্ষার কাজেও লাগছে এই পরিবেশ। প্রধানশিক্ষক জানালেন, এটাই জয় ফুল লার্নিং। আনন্দপাঠ।


জীবনে বহু পুরস্কার পেয়েছেন সুভাষচন্দ্র। ২০১৯-এর শিক্ষক দিবসে দেশের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ তাঁর হাতে জাতীয় পুরস্কার তুলে দেন। সুভাষচন্দ্র স্মৃতিচারণ করেন, তাঁর অভিনব পরিকল্পনার কথা শুনে তাঁকে উৎসাহিত করেছিলেন রাষ্ট্রপতি। সুভাষচন্দ্র বলেন, 'উনি অবাক হয়ে যান আমার উদ্ভাবনী পরিকল্পনা শুনে। প্রায় মিনিট খানেক ধরে আমার সঙ্গে কথা বলেছিলেন। প্রচুর উৎসাহ দিয়েছেন, অভিনন্দন জানিয়েছেন। সব বাধা অতিক্রম করে আমাকে এগিয়ে যেতে বলেছেন। এটাই আমার জীবনের সেরা প্রাপ্তি৷'


কী ভাবে তাঁর স্কুল অভিনবত্ব দেখাচ্ছে, তার বিস্তারিত তথ্য কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের সামনে তুলে ধরেছিলেন সুভাষচন্দ্র। তিনি বলেন, আমি বিজ্ঞানের ছাত্র। বিজ্ঞানের সঙ্গেই ওঠাবসা। পাখি, কাঠবেড়ালির সঙ্গে কথাবার্তা বলা মানে জীববৈচিত্র বজায় রাখা। আমার স্কুলে যে পেঁচারা রয়েছে, তারা পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করছে।


আরও পড়ুন: Lord Shani: শনি-শুক্রের যুতি! বড়ঠাকুরের অশেষ কৃপায় সৌভাগ্যের জোয়ারে ভাসবেন এই রাশির জাতকেরা...


কিন্তু প্যাঁচাদের ভূমিকা কীভাবে জানা গেল? তিনি জানান, মিড-ডে মিলের খাবার রাখার ঘর খুব নোংরা করত ইঁদুর৷ আমরা নাজেহাল হয়ে যেতাম পরিষ্কার করতে গিয়ে। পেঁচা আসার পরে সেই রুমই ঝকঝকে, ইঁদুরের টিকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। যখন-তখন সাপ বেড়িয়ে পড়ত ক্লাসের মাঝে। পেঁচা আসার পরে তাও পুরো বন্ধ। আমি ক্লাস ফাইভ, সিক্স ও সেভেনের ছাত্রদের দায়িত্ব দিয়েছি, পেঁচাদের দেখভাল করার জন্য। ওরাই ক্লাসের একটি পুরনো বেঞ্চ দিয়ে পেঁচার বাসা বানিয়ে দিয়েছে। ব্যস! এভাবেই প্যাঁচাদের সঙ্গে পড়ুয়ারা বিনা সংঘাতে থাকতে শিখে যায়।


 (দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির টাটকা খবর, আপডেট এবং ভিডিয়ো পেতে ডাউনলোড-লাইক-ফলো-সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের AppFacebookWhatsapp ChannelX (Twitter)YoutubeInstagram পেজ-চ্যানেল)