নিজস্ব প্রতিবেদন: দল তাঁকে দূরে সরিয়ে দিলেও বামপন্থায় বিশ্বাস হারাননি। আবার বামপন্থী হয়েও পার্টির সংবিধানের ওপরে রেখেছিলেন দেশের সংবিধানকে। চার দশকের সম্পর্ক মুহূর্তে মুছে যাবে বুঝেও দলকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন, স্পিকারের চেয়ারে বসার পর নিরপেক্ষতা বিসর্জন অসম্ভব। নিজে আইনজীবী হয়েও আইনসভার কাজে বিচারবিভাগের হস্তক্ষেপ মেনে নেননি। স্বাধীন ভারতে সংসদীয় রাজনীতির আঙিনায় অনন্য স্বাক্ষর রেখে গেলেন সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। 


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

সিপিএম তাঁকে বহিষ্কার করেছিল। কিন্তু বাংলার কমরেডদের সঙ্গে ভালো সম্পর্কটা ছিল অটুট।আলিমুদ্দিনের নেতারা অনেকেই চেয়েছেন, সোমনাথদা আবার দলে ফিরে আসুন। কিন্তু,ভুল স্বীকার করে দলে ফেরার আর্জি যে তিনি জানাবেন না, সেকথা স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন সোমনাথদা। তাই পুনর্মিলন আর হয়নি। সিপিএমের প্রাক্তনী হয়েই চলে গেলেন সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। 


প্রয়াত সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়


১৯২৯ সালে অসমের তেজপুরে আইনজীবী পরিবারে জন্ম। বাবা হিন্দু মহাসভার নেতা নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ থাকার সময় তিনি জ্যোতি বসুর কাছাকাছিআসেন। ১৯৬৮ সালে ছেলে সোমনাথ সিপিএমে যোগ দেওয়ার পর থেকে সেই জ্যোতি বসুই ছিলেন তাঁর আজীবনের মেন্টর। ১৯৭১ এ বাবার মৃত্যুর পর তাঁর বর্ধমান লোকসভা কেন্দ্র থেকে জিতে প্রথমবার লোকসভায় যান সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। 


১৯৭১ থেকে ২০০৯। ১০ বার সাংসদ নির্বাচিত হন তিনি। চুরাশি সালে যাদবপুরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে হেরে যাওয়ার পর কেন্দ্র বদলে চলে যান বোলপুরে। '৮৯ থেকে ২০০৪। ছিলেন লোকসভায় সিপিএমের দলনেতা। ২০০৪ থেকে ২০০৯। লোকসভার ত্রয়োদশ স্পিকারের দায়িত্ব সামলান সোমনাথ। আস্থা ভোটে স্পিকারের চেয়ার ছেড়ে সরকারের বিপক্ষে ভোট দিতে না চাওয়ায় ২০০৮ সালে তাঁকে বহিষ্কার করে সিপিএম।  


বাংলার কমরেডদের অনেকেই মনে করেন মনমোহন সিং সরকারের ওপর থেকে প্রকাশ  কারাট সমর্থন না তুললে, বাংলায় পালাবদল হতো না। স্পিকারের নিরপেক্ষতা ছেড়ে যে তিনি কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ভোট দিয়ে, বিজেপির হাত শক্ত করবেন না, সেকথা কারাটদের স্পষ্ট জানিয়ে দেন সোমনাথ। পার্টি লাইন অমান্য করায় সিপিএম তাঁকে বহিষ্কার করে। 


সোমনাথের প্রয়াণে শোকস্তব্ধ রাজনৈতিক মহল, শোকবার্তা রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীর


প্রকাশ কারাটের সঙ্গে সংঘাতে পার্টিছাড়া। অভিমান আজীবন সঙ্গী ছিল সোমনাথদার। কিন্তু, মাথা নোয়াননি। নিজের সিদ্ধান্তে বরাবর অনড় ছিলেন কেমব্রিজের ব্যারিস্টার। সেরা সাংসদের সম্মান পেয়েছেন। কড়া হাতে সামলেছেন লোকসভা। প্রখর সংবিধান-বোধেই দলকে বুঝিয়ে দেন, একবার স্পিকার হওয়ার পর নিরপেক্ষতা বিসর্জন অসম্ভব। আইনসভার স্বাধিকার নিয়ে বিচারবিভাগের সঙ্গেও সংঘাতে জড়িয়েছেন সোমনাথ। 


২০০৫-এ সুপ্রিম কোর্ট ঝাড়খণ্ড বিধানসভায় আস্থা ভোটের দিন এগিয়ে আনার নির্দেশ দিলে, আদালত লক্ষ্মণ রেখা অতিক্রম করছে বলে মন্তব্য করেন সোমনাথ। ওই বছরই টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন কেলেঙ্কারিতে সংসদ থেকে বহিষ্কৃত হন এগারো সাংসদ। বহিষ্কৃত সাংসদরা সুপ্রিম কোর্টে মামলা করলে আইনসভার অধিকারে হস্তক্ষেপের যুক্তিতে শীর্ষ আদালতের নোটিস গ্রহণ করেননি সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়।


দল তাঁকে বহিষ্কার করার পর সেই দলকেই বাংলা থেকে ক্ষমতা হারাতে দেখেছেন। দুঃখ পেয়েছেন। তবে, নতুন মুখ্যমন্ত্রীর কাছে বারবার পেয়েছেন সম্মান। স্পিকারের চেয়ারে থেকে লোকসভার সাংসদ পদ ছাড়তে চেয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইস্তফা গ্রহণ করেননি তিনি।  দু-হাজার এগারোয় জয়ের পর সেই সোমনাথেরই বাড়ি যান মমতা। বিধানসভার ৭৫ বছরের অনুষ্ঠানেও তাঁকে আমন্ত্রণ জানান। তবে, বরাবরের স্পষ্টভাষী মানুষটি এই সেদিনও পঞ্চায়েত ভোটের আগে বাংলার গণতন্ত্র নিয়ে সরব হয়েছিলেন। নিজের মুখেইবারবার বলেছেন, দল তাঁকে ত্যাগ করলেও ক্ষয়িষ্ণু সিপিএমকে দেখে তাঁর কষ্ট হয়।


মাথায় রাখুন, গোটা দেশ আপনাদের দেখছে। লোকসভার হট্টগোলে তাঁর এই ব্যারিটোন ছিল সাংসদদের কাছে খুবই পরিচিত। নিজেকে বলতেন ছোট মানুষ। যাঁর চেহারাটাই শুধু বড়। সংসদের ইতিহাস কিন্তু বলছে, দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে গণতন্ত্রের পীঠস্থানকে ঋদ্ধকরেছেন তিনি। সংসদের গরিমাকে দিয়ে গেছেন সর্বোচ্চ স্থান।