ঊষসী মুখোপাধ্যায় 


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

ফুল ফুটুক না-ই বা ফুটুক আজ শারদীয়া।
কালও তাই। পরশু, তরশু... রোজই তাই। শারদীয়া।


কাশের বন, শিউলির আবেশ, ছাতিম ফুলের গন্ধের ঘোর কাটিয়ে দিচ্ছে হাঁড়ি হাঁড়ি বিরিয়ানির উগ্র জাফরান। যতদূর চোখ যায় সারিসারি কালো মাথা। সেই তো একই ব্যাপার, ত্রিশূল হাতে মা দুগ্গা আর তার পায়ের কাছে পড়ে থাকা একখানা অসুর! সেই একই জিনিস। তবুও বছর বছর উত্সাহের অন্ত নেই। টালা থেকে টালিগঞ্জ, রাত জেগে, জ্যাম ঠেঙিয়ে, কী এত চোখ সার্থক করছে লোকে?


সহজ প্রশ্ন।
কিন্তু উত্তর হাতড়াতে গিয়ে মনে হল, ব্যপারাটা এতটাও সোজা বোধহয় নয়! এই দুর্গাপুজো ব্যাপারটা ঠিক কী? উত্সব? ধর্ম, রীতি, ঐতিহ্য? নিখাদ হলিডে? আনন্দযাপন? কী?


উত্তর ধরিয়ে দিয়েছিল এক ব্রিটিশ বন্ধু। প্রথমবার কলকাতার দুর্গাপুজো দেখতে এসে চোখ কপালে তুলে বলেছিল,  বলেছিল, এতো পুরো রিও-র মতো! কার্নিভাল!
 
শব্দটা বেশ উত্সবসুলভ বটে। কিন্তু কার্নিভাল মানে কি শুধুই উত্সব? মোটেও না! এর আরও একখানা মানে আছে। কার্নিভাল মানে যা-খুশি-তাই করার ছুট। যে-অপ্রিয় সত্যিকথা রোজ বলতে পারি না, আজ সেটাই গড়গড়িয়ে বলে ফেলার দিন। আজ তো উত্সব!


আস্ত শহর থিমে থিমে থিমাক্কার। ঠাকুর তো পরে মশাই, আগে থিমখানা দেখুন! আলো-সাজ-ঝলমলে আড়ম্বর দেখুন! হাল্লা রাজার দুর্গ থেকে এসকিমোদের ইগলু! থিম যদি রেডি হয়ে যায়, তবে দেবীপক্ষের তিথি-নক্ষত্রকে থোড়াই কেয়ার! পদ্মাবতীর প্রাসাদ কী আর দেবীর জন্য খালি পড়ে থাকবে?  



অগত্যা, কার্নিভালের ঢাকে কাঠি। সেলফি স্টিক হাতে নেমে পড়েছি রাস্তায়। আলো-বাহার, থিমের সাজ একটু একটু করে ভুলিয়ে দিচ্ছে আমার সব না-পাওয়াগুলো। নিয়ে চলে যাচ্ছে অন্য একটা গ্রহে। যেখানে কোনও শোক নেই। কোনও ক্ষোভ নেই। দুঃখ-জরা-জীর্ণ কিচ্ছু নেই! প্রত্যেকদিন বাস্তবের জাঁতাকলে পিষ্ট আমার জীবনের দগদগে ঘায়ে মলম লাগাচ্ছে দুদণ্ডের এই চোখের আরাম। এক মুহূর্তের জন্য ভুলে যাচ্ছি আমার বাড়ির হাঁড়ির হাল। ভুলে যাচ্ছি, গ্র্যাজুয়েট ছেলেটা একটা চাকরির জন্য জুতোর শুকতলা খুইয়ে দরজায় দরজায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওই যে সেই ছেলেটা... চিটফান্ডের এজেন্ট না কি যেন ছিল? আরে যে সুইসাইড করল আগের বার পুজোর মুখে? মাথাকুটেও নামটা মনে করতে পারছি না! আবছা হয়ে আসছে ধার-দেনার হিসেবনিকেশ। ডেডলাইন মিস হলে চাকরিটাও বোধহয় আর থাকবে না, রাতজাগানো সেই ভয়টাও আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ছে। ওই যে কোথায় সেদিন বোমা ফেটে একটা বাচ্চা মারা গেল, টিভিতে দেখেছিলাম। সেই মুখটাও ভুলে যাচ্ছি...। তার ঠিক আগে আগেই কোথায় যেন দুটো ছাত্র মরে গেল.. জায়গাটার নামও আর মনে পড়ছে না। চোখের সামনে এখন শুধু পদ্মাবতীর প্রাসাদ। ম্যাজিকের মতো ভুলিয়ে দিচ্ছে দুঃখ। ম্যাজিক। কার্নিভাল!


যে যা বলে বলুক! রাত রাত জেগে, ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছি বেশ। এটাই তো আমার ইচ্ছে। এটাই তো আমার স্বাধীনতা। এটাই তো করতে চাই। বচ্ছরকার দিনটা আমার ইচ্ছেযাপনের দিন। উড়ানের দিন। 
  
আহা, সত্যিই তো! রাজার যদি দশদিন থাকে, প্রজারই বা একটা দিন থাকবে না কেন? আলবাত থাকবে। সেই জন্যই তো প্রতিবছর একটু একটু করে লম্বা হচ্ছে পুজো। পাঁচ দিনে কী হবে? আরও নাও। আরও আরও আরও। আরও একটু জিরিয়ে নাও। আরও একটু ভুলে যাও। কার্নিভাল তো প্রজারই দিন!
 
মধ্যযুগে ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় এমনই সব কার্নিভালের আয়োজন করা হতো। একদিকে গির্জা আর অন্যদিকে রাষ্ট্রযন্ত্রের চোখরাঙানিতে ক্লিষ্ট জনসাধারণ রাজার মুখোশ পরে বিভিন্ন সাধারনোচিত কাণ্ডকারখানায় মেতে উঠত।  মূল উদ্দেশ্যটা ছিল, রাজার মুখোশ পরে রাজাকে ভেঙচি কাটা। এর তত্ত্বটা কিন্তু অনেক গভীর। এই কার্নিভালে একদিকে যেমন শোষিত সাধারণের গায়ের ঝাল খানিকটা মিটত। তেমনই আবার সমাজের নীচুতলায় জমে থাকা রাগ এভাবে বেরিয়ে যাওয়ায় রাজাও খানিক হাঁপ ছেড়ে বাঁচতেন। এই জন—সাধারণের উত্সবের তত্ত্বকে মিখাইল বাখতিন ‘কার্নিভালেক্স’ এর তকমা দিয়েছিলেন। যেখানে আসলে উদযাপনের আড়ালে রাজনীতির একটা সেফটি-ভালভ কাজ করে। 


ইউরোপের মতো আমরা অবশ্য রাজার মুখোশ পরি না। বরং, রাজা নিজেই আমাদের সঙ্গে মঞ্চ ছেড়ে মাঠে নেমে আসেন। আমার পাশে এসে বসেন। আমার পাড়ার পুজো উদ্বোধন করতে আকাশছোঁয়া বাড়িটার চোদ্দ তলা থেকে নামেন। আমি বুঝতে পারি, উনি আসলে আমাদেরই লোক। একদম আমারই মতো। সাধারণ। দেখেছ, এতকিছু সামলেও পুজোর সময়টা কাউকে হতাশ করেননি! ছোট্ট একটা ফিতে কাটা আর হাসিমুখের প্রতীকে অক্লেশে তিনি আমাদেরই একজন হয়ে ওঠেন। 


এ কার্নিভালে রাজা অবশ্য একা নন। শহরের যে প্রান্তেই তাকাই না কেন, রাজা-রাজরার তারকাখচিত থিম ছাড়া আর কি কিছু চোখে পড়ার জো আছে? পুব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ সবই তো মন্ত্রীসান্ত্রীদের ঘরের পুজো! পাটভাঙা পাঞ্জাবীতে সকাল বিকেল হাসিমুখে তাঁরা দেখা দিচ্ছেন। ঢাক বাজাচ্ছেন, ধুনুচি হাতে শরীর দোলাচ্ছেন, ভোগ বিলি করছেন। ঠিক আমার পাড়ার সেই জ্যাঠা-কাকা-দাদাদের মতো! একদম বাড়ির লোক। যাকে বিশ্বাস করতে একটুও অসুবিধে নেই। একফোঁটাও না।


রাজা-রাজরারাও ভক্তিভরে অষ্টমিতে অঞ্জলি দেন। তাঁদেরও বুঝি আমার মতো অনেকখানি না-পাওয়া রয়ে গেছে! 



বাখতিন যে নজরে কার্নিভালকে পড়তে চেয়েছিলেন, তা একটা সমীকরণের কথা বলে। আদতে যার মোড়ক আনন্দযাপন, কিন্তু তলে তলে যার মধ্যে ক্ষমতার অভ্যাসের বীজ রয়েছে। সেই কোনকালে বসে এতটাই ভেবেছিলেন বাখতিন! যে রাজা আমার উত্সবে মঞ্চ ছেড়ে নেমে আসেন, তিনি কি সত্যিই আমার সঙ্গে মিশে যান? যেতে পারেন? নাকি আমার মতো হয়ে ওঠার এই চেষ্টায় তাঁর আধিপত্য বিস্তারের একটা তাড়নাও আছে? আমার পাশের চেয়ারটায় বসা মানেই কি আমার মতো হয়ে যাওয়া? তাত্ত্বিকরা বলেন, মোটেও তা নয়। আসলে এটা ক্ষমতা বিস্তারের একটা প্র্যাকটিস। কেন? আমার ক্ষোভের, রোষের সেফটি ভালভেই তো রাজার জয়! আমার চোখের সামনে প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া হাজার হাজার অন্ধকারের দগদগে ঘায়ে শাসকেরই তো মলম দেওয়ার কথা! আমার তো শুধু দুটো দিন সবকিছু ভুলে থাকার আকাঙ্খা। রাজাকে আমার কাছের মানুষ ভাবার কোনও দায় নেই। আমাকে সে কথা বিশ্বাস করানোর দায় তো রাজারই! কুর্সির চারটে পা শক্ত মাটিতে দাঁড় করিয়ে রাখার মস্ত দায়! 



আর সেই জন্যই বুঝি পুজোর ঐতিহ্যের এ হেন আধুনিকীকরণ! প্রজার জন্য একখানা সেফটি ভালভের বন্দোবস্ত। পুজোআচ্চা থেকে সোজা কার্নিভালের দিকে এগিয়ে চলা। সাবেকিয়ানার ঝকঝকে মর্ডানাইজেশন। পুজো গড়াচ্ছে। পাঁচদিন থেকে দশদিন। বাড়তে বাড়তে দিন পনেরো। কার্নিভালের আনন্দধারা বহিছে ভুবনে। কষ্টগুলো কমে যাচ্ছে, সরে যাচ্ছে, বেশ বুঝতে পারছি। চিতোরের দুর্গ দেখে বিস্ময় লুকোতে পারছি না কিছুতেই! ভুলে যাচ্ছি, এই নকল দুর্গটা তৈরি করতে ঠিক কত টাকা লাগতে পারে? এত টাকার অঙ্ক, একা হাতে কষতে পারব? সেই প্রশ্নটাও ভুলিয়ে দিচ্ছে নিয়ন আলোর ঝলকানি। হাঁ করে দেখছি। গিলছি। ওই যে কোথায় যেন.. এগারো টাকার বিরিয়ানির জন্য কে কাকে খুন করে ফেলল?  কিছুতেই মনে পড়ছে না..। আমার সামনে এখন ম্যাজিক। মগজে, মননে শুধুই আনন্দ।  


কার্নিভালের এটাই মজা। বাখতিন যাকে বলেছিলেন, “ফিস্ট অফ দ্য ফুলস”।


সত্যিই কী আমরা বোকা? নাকি বোকা বনে থাকা ছাড়া আর কোনও রাস্তা নেই? আমাকেও তো নিঃশ্বাস নিতে হয়। আমাকেও তো ভুলে থাকতে হয়। একটু অক্সিজেন তো আমারও চাই। আর তাই, পনেরো দিনের ফ্রি অক্সিজেন! থিম দেখো। কার্নিভাল করো। ভুলে যাও সব। এই তো আমিও তোমার মতো সারাবছর এই পাঁচটা, থুড়ি পনেরোটা দিনের জন্য অপেক্ষা করি। একুশে আইন-গণেশ পাইন, উদ্বোধন থেকে রোড শো, সব তোমাদেরই জন্য!


পদ্মাবতীর ঘোর কাটতে না কাটতেই পরের থিমে যাওয়ার পালা। রাজস্থান থেকে বেরিয়ে পড়তেই আর একটা পুজো-স্পেশ্যালের মুখোমুখি। বাঁশ-দড়ি হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক পুলিস! সকাল থেকে রাত, মাথার ঘাম পায়ে ফেলছে, যাতে আমি শান্তিতে ঠাকুর দেখে বেড়াতে পারি! আহা রে, ওদেরও তো পুজো। দেখো একবার, ঠায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মুখখানা একেবারে শুকিয়ে গেছে! আচ্ছা, সত্যিই ভেবে দেখুন তো.. যে লোকটা আমার জন্য এমন দিনরাত এক করে ফেলছে... সে কি কখনও আমাকে গুলি করতে পারে? ছাত্রদের নির্বিচারে ফেলে ঠেঙাতে পারে?
মেরে ফেলতে পারে কাউকে? ধুস! হতেই পারে না! 


রাজস্থান থেকে বেরিয়ে পড়লাম। পরের থিম হ্যারি পটারের হগওয়ার্টস। কিংবা এলডোরাডো। অজানা এক স্বর্ণরাজ্যের সন্ধান। এটাই তো আমি দেখতে চাই। ঠিক এটাই। কোটি টাকার পুজো। মন্ত্রী-সান্ত্রী-প্রশাসনিক প্রধানের ছোঁয়া পাওয়া এক সোনার স্বর্গ! যেখানে শুধুই সুখ। যেখানে দাঁড়িয়ে একটা মাটন রোল খেলে মোটেও আমার ভাগাড়ের কথা মনে পড়ে না। যেখানে মাথায় হঠাত্ ব্রিজ ভেঙে পড়ার কথা ভাবতেও পারি না। যেখানে আমার পুলিস ভুলেও বন্দুক ছোঁয় না..।


স্বপ্নযাপন। ভয়ে-আতঙ্কে-অবহেলায় মুষড়ে পড়া বাচ্চার কানের সামনে অনবরত ঝুমঝুমির আওয়াজ। ভুলে যাও বাস্তব। আজ, কাল, পরশু, তরশু... শুধুই আনন্দ। মনে রেখো, ফুল ফুটুক নাই বা ফুটুক, শুভ বিজয়া।


 


- এই প্রতিবেদনের যাবতীয় মতামত লেখকের নিজস্ব