অরূপ লাহা: বিসর্জন নয়, দশমীতে ঘট প্রতিষ্ঠা করা হয় ৪৫০ বছরের পুরনো গুসকরার চোংদার বাড়ির এই পুজোয়। পূর্ব বর্ধমানের ছোট্ট শহর গুসকরা। সেখানকার চোংদার বাড়ির দুর্গাপুজো তর্কাতীত ভাবে বাংলার ঐতিহ্যবাহী পুজোর মধ্যে পড়ে। যার প্রতিটি অনুষঙ্গই ভীষণ ভাবে অন্যরকম। কথিত আছে, সম্রাট শেরশাহের আমলে এই বাড়িতে দুর্গাপুজো শুরু হয়েছিল! প্রায় ৪৫০ বছর ধরে মহাসমারোহে রাজকীয়ভাবেই সম্পন্ন হয়ে চলেছে এই বাড়ির পুজো। বর্তমানে এর জৌলুস কিছুটা কমলেও পরিবারের বর্তমান সদস্যরা ঐতিহ্য ও পরম্পরাকে যতদূর সম্ভব বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন।


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

আরও পড়ুন: Durga Puja 2023: মহাষষ্ঠীতে মহাপূজার শুভসূচনা বেলুড় মঠে, হল কল্পারম্ভ...


চোংদার বাড়ির দুর্গাপুজোর কথা উঠলেই মনে পড়বে এবাড়ির পুজোর বিশেষ রীতি ও প্রথার কথা। যেমন, দশমীতে এখানে ঘট বিসর্জন হয় না, বরং ঘট আহ্বান করা হয়। নিঃসন্দেহে এক অন্যরকম প্রথা। দশমীর দিন যে ঘট প্রতিষ্ঠা করা হয় তা রেখে দেওয়া হয় এক বছর। পরের বছর ষষ্ঠীর দিনে বিসর্জন হয়। বাড়ির এক মহিলা মল্লিকা চোংদার বলেন, দশমীর দিন এই ঘট বিসর্জন করা হয় না। এ ছাড়া সপ্তমী থেকে দশমী-- চারদিনই এখানে প্রদীপ জ্বেলে রাখা হয়। পুজোর চারটে দিন ঢাকের আওয়াজ, উলুধ্বিন ও শঙ্খধ্বনির বুনটে রোমাঞ্চিত থাকে সারা বাড়ির আবহ।


চোঙদার বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে কুনুর নদী। গুসকরার জমিদার চতুর্ভুজ চোংদারের হাত ধরেই এই পুজো শুরু হয়েছিল বলে জানা যায়। জমিদারবাড়ির কেন্দ্রস্থলেই তৈরি হয় বিরাট দুর্গামন্দির। একসময় কলকাতার নামী কোম্পানির নট্টবাবুরা গুসকরার এই বাড়িতে গিয়ে যাত্রাপালার আসর জমাতেন। এখন বারান্দার পলেস্তারা এখন প্রায় খসে পড়েছে। তবুও ধুমধাম করেই পুজোর চারটে দিন মেতে ওঠেন বাড়ির বড় থেকে ছোট সবাই। যাঁরা বাইরে থাকেন, পুজোর সময়ে তাঁরা মোটামুটি সবাই একজোট হন। 


এবাড়ির পুজোয় একসময় কামান দাগা হত। এখন তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এখন বন্দুকে ফায়ারিং করে সন্ধিপুজো শুরু হয়। শাক্তমতে পুজো এবাড়িতে। হত বলি। তবে ১৯৭৮ সালের ভয়াবহ বন্যায় প্রচুর গবাদিপশু মারা যায়। সেই থেকে এখানে মোষ ও ছাগবলি বন্ধ হয়ে যায়। তারপর থেকে চালকুমড়ো বলির প্রথা চালু হয়। ৫১ থালা ভোগ রান্না হয় এখানে। বাড়ির মহিলারাই সাধারণত ভোগ রান্না করেন। এলাকাবাসীদের পাত পেড়ে খাওয়ানো হয় পুজোর দিনগুলিতে।


বাঁশের চোঙে রাজস্ব আসত। তাই পদবি চোঙদার। বর্ধমান রাজের কাছ থেকে এলাকার জমিদারি পাওয়ার পর ত্রিপুরেশ্বর চোঙদার দুর্গা দালান তৈরি করেন। তার আগে তালপাতার ছাউনিতে দুর্গাপুজো হত। এখন সুদৃশ্য দুর্গাদালান আলো দিয়ে সাজানো হয় পুজোর দিনগুলিতে। জমিদারি পাওয়ার পরে পরিবারে আর্থিক সমৃদ্ধি আসে। তখন এই দুর্গা দালান তৈরি হয়। এর পাশাপাশিই জাঁকজমকের সঙ্গে দুর্গাপুজো শুরু হয়। সাতটি গ্রামে বিস্তৃত ছিল জমিদারি। পুজোর দিনগুলিতে সেই সাত গ্রামের বাসিন্দারা জমিদার বাড়ির দুর্গাপুজো দেখতে আসতেন। ভোগ খাওয়ার পর পালাগান, যাত্রা শুনে বাড়ি ফিরতেন তাঁরা। দুর্গাদালানের পাশে রয়েছে ভোগঘর। এলাকা জুড়ে রয়েছে শতাধিক উনানের ভগ্নাংশ। সেইসব উনানেই জমিদারি আমলে অন্নভোগ তৈরি হত। আশপাশের জমিদাররাও নিমন্ত্রণ পেতেন। নামী শিল্পীরা আসতেন। আসতেন বর্ধমানের মহারাজের প্রতিনিধিরাও। এখন সেসব বন্ধ হয়ে গিয়েছে।


কথিত আছে, দশমীতে চর্তুভুজ চোঙদার ও তাঁর স্ত্রী বিদ্যাসুন্দরী দেবী দুর্গামন্দিরে স্বেচ্ছামৃত্যু বরণ করেন। সেই থেকেই দশমীর দিনে মা দুর্গার সামনে চর্তুভুজ ও বিদ্যাসুন্দরীর শ্রাদ্ধ করা হয়। সময় ও অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটলেও এখনও সেই প্রথা চালু। তবে সেইসব পর্ব শেষে দশমীতে সিঁদুর খেলায় মেতে ওঠেন পরিবারের মহিলারা। এখানে মা দুর্গার ছেলেমেয়েদের মধ্যে গণেশ ছাড়া অন্য কোনও কারও বাহন থাকে না। দেবীদুর্গা অষ্টমুখী ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে অধিষ্ঠান করেন এখানে।


আরও পড়ুন: Durga Puja 2023: কালীপুজো করে তারপর দুর্গাপুজো! ৫১৪ বছরের আশ্চর্য শারদোৎসব...


প্রায় ৪৫০ বছরের প্রাচীন এই পুজো ফিসফিস করে কত কথা যে বলে! নিঃশব্দেও কত কথা যে বলে! এবাড়িতে কান পাতলেই শোনা যায় সেই অজানা না-শোনা কথা ও কাহিনি। 


(দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির টাটকা খবর, আপডেট এবং ভিডিয়ো পেতে ডাউনলোড-লাইক-ফলো-সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের AppFacebookWhatsapp ChannelX (Twitter)YoutubeInstagram পেজ-চ্যানেল)