#উৎসব: শিউরে উঠে স্বামীজি বললেন, `আহা, দেবীর তৃতীয় নয়নে আঘাত লাগেনি তো!`
বেলুড়ের কুমারীপুজোর প্রেক্ষিত নিছক আনুষ্ঠানিকতার চেয়ে অনেক বড়।
সৌমিত্র সেন
বাঙালির দুর্গোৎসবের নানা অভিমুখ, নানা বাঁকবদল। পলাশির যুদ্ধের পরে শোভাবাজারের দেব পরিবারের ইংরেজতোষণের উদ্দেশ্যে শুরু করা পুজোর একটা বড় প্রভাব নব্য কলকাতার পুজো-সংস্কৃতির উপর পড়েছিলই। এর মধ্যে খ্যাত-অখ্যাত বিভিন্ন বাড়ির পুজোর ঐতিহ্য তো ছিলই। ছিল রানি রাসমণির পুজো। আবার উনিশ শতকের নবজাগরণের সমাজে-সংস্কৃতিতেও দুর্গাপুজো নানা ভাবে ও ভঙ্গিতে দেখা গিয়েছে। সেখানে কখনও বঙ্কিমচন্দ্রের ভাবদৃষ্টির আত্মিকপুজোর অনুষঙ্গ, কখনও আবার মহর্ষির ব্যক্তিগত প্রত্যাখ্যানের মধ্যে দিয়ে বর্ণিল ভাবে বেড়ে ওঠা জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির পুজো। ঋষি অরবিন্দও দুর্গাপুজোর ভাব নিয়ে ভেবেছিলেন। তবে এই সময়-পর্বের মধ্যে স্বামী বিবেকানন্দের দুর্গাপুজো-ভাবনা বাঙালির ধর্ম-সংস্কৃতিতে বিশেষ ছাপ রেখেছে। যাকে আজ আমরা বেলুড় মঠের পুজো বলে জানি ১৯০১ সালে সেই পুজো শুরু হয়েছিল স্বয়ং বিবেকানন্দের হাতে।
আজ বাঙালির অন্যতম দ্রষ্টব্য বেলুড়ের এই পুজো। সব বাঙালিই চেষ্টা করেন অন্তত একটি দিন বেলুড়ের পুজো দেখতে। বিশেষত অষ্টমীর দিনে বেলুড়ের কুমারীপুজোর এক বিশেষ টান অনুভব করেন বাঙালি। বেলুড়ের পুজোর নানা বৈশিষ্ট্য। সব চেয়ে বড় কথা, সেই প্রথম বছর থেকে এই পুজো মা সারদার নামে সঙ্কল্পিত হয়ে আসছে। এই পুজোয় হাজির থাকতেন স্বয়ং মা সারদাও। এই পুজোয় কুমারীপুজোর শুরুও একেবারে প্রথম বছরেই, স্বামীজির হাতেই।
আরও পড়ুন: Durga Puja 2021: জল থেকে উঠে শ্রীমন্তের হাতটি ধরলেন 'ছেলে-ধরা দুর্গা'!
শোনা যায়, তখনও বেলুড়ে পুজো শুরু হয়নি। বেলুড়ের বিল্ববৃক্ষতলে বসে স্বামীজী নাকি প্রায়ই গাইতেন তাঁর এক প্রিয় আগমনীগান-- ''গিরি গণেশ আমার শুভকারী/ পূজে গণপতি পেলাম হৈমবতী/চাঁদের মালা যেন চাঁদ সারি সারি/ বিল্ববৃক্ষতলে পাতিয়া বোধন/ গণেশের কল্যাণে গৌরীর আগমন/ ঘরে আনব চণ্ডী, কর্ণে শুনব চণ্ডী/ আসবে কত দণ্ডী জটাজুটধারী''। তাঁর মনে মঠে পুজো করার গভীর ইচ্ছে জেগেছিল। (১৯০১ সালেই) একবার তিনি তাঁর এক শিষ্যকে রঘুনন্দনের 'অষ্টাবিংশতি তত্ত্ব' আনতে বললেন। স্মৃতিশাস্ত্রবিহিত পুজো করার বাসনাই ছিল স্বামীজির মনে। তাছাড়া গুরুভাইদের মধ্যেও কাউকে কাউকে তিনি জানিয়েছিলেন, তিনি 'জ্যান্ত দুর্গা'র পুজো করবেন। স্বামীজি মা সারদাকে 'জ্যান্ত দুর্গা' বলতেন। স্বামীজি ঠিক করেছিলেন 'নবম্যাং পূজয়েৎ দেবীং কৃত্বা রুধিরকর্দমম' অনুসারে বুকের রক্ত দিয়েই শক্তিপুজো করবেন, হবে বলিদানও। তবে মা সারদার আপত্তিতে পরে বলিদানকর্ম বাতিল হয়। অনাড়ম্বর ভাবে হলেও গভীর ভাবগাম্ভীর্যে ও শ্রদ্ধাভক্তিতে যথারীতি সম্পন্ন হয়েছিল বেলুড় মঠের প্রথম দুর্গাপুজো। দেবীর বিসর্জনেও এখানে আচার-অনুষ্ঠানের দর্শন ভিন্ন। মা সেদিন তাঁর বাপের বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়ি ফেরেন, তাঁর সেদিন মন খারাপ থাকে। বিদায়োন্মুখ বিষণ্ণ মাকে সেদিন বিদায়কালে একটু আনন্দ দেওয়ার লক্ষ্যেই সন্ন্যাসী-ভক্তদল নেচে-গেয়ে বাজি পুড়িয়ে আনন্দের আবহ তৈরি করেন। সব মিলিয়ে ঐতিহ্যের ধারক-বাহক হয়েও বেলুড়ের প্রথম পুজোই বাঙালির দুর্গাপুজো সংস্কৃতিতে ভিন্ন মাত্রাও যোগ করেছিল।
আর এই পুজোতেই পূজিতা হয়েছিলেন ন'জন কুমারী। স্বামীজিরই অনুরোধে শ্রীরামকৃষ্ণ শিষ্যা গৌরী মা কুমারী পূজার আয়োজন করেছিলেন। অষ্টমীর দিন পুজোর যথালগ্নে প্রত্যেকের পায়ে ফুলবিল্বপত্র অঞ্জলি দিয়েছিলেন স্বামীজি। একজন কুমারী ছিলেন খুবই ছোট্ট। সেদিন পুজোর আসনে বসে স্বামীজি এতই আবিষ্ট হয়ে পড়েছিলেন যে, অতি অল্পবয়স্কা সেই কুমারীকন্যার কপালে রক্তচন্দনের তিলক পরাতে পরাতে শিউরে উঠে তিনি বলেছিলেন-- 'আহা, দেবীর তৃতীয় নয়নে আঘাত লাগেনি তো!' তাঁর কাছে তখন প্রতীকমূর্তি ও প্রকৃত দেবীমূর্তি আসলে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। এ হেন এক গভীর নিষ্ঠাপূর্ণ ও উচ্চাঙ্গ ভাবের পুজোর ঐতিহ্যই আজও বহন করে চলেছে বেলুড় মঠ।
প্রসঙ্গত, স্বামীজি অবশ্য বেলুড়ে দুর্গাপুজোর আগেও কুমারী পূজা করেছিলেন। কাশ্মীর ভ্রমণকালে এক মুসলমান মাঝির কন্যাকে তিনি কুমারীরূপে পূজা করেছিলেন বছর তিন-চার আগেই! স্বামীজির সুউচ্চ ভাবদৃষ্টিতে মানুষে-মানুষে, ধর্মে-সম্প্রদায়ে কোনও ভেদ ছিল না। ফলে, সেই হিসেবে দেখতে গেলে বেলুড়ের কুমারীপুজোর প্রেক্ষিত নিছক আনুষ্ঠানিকতার চেয়ে অনেক বড়। আজ যা মঠ-চত্বরেই রীতি-সীমায়িত তার প্রকৃত পরিসর আসলে অনুষ্ঠানের সীমানা ছাড়িয়ে বিপুল ও গভীর। আর বাঙালিও এই পুজোয় অংশ নিয়ে সেই ঐতিহ্যেরই শরিক হয়ে পড়েছে।
(Zee 24 Ghanta App : দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির লেটেস্ট খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Zee 24 Ghanta App)
আরও পড়ুন: #উৎসব: মহাসপ্তমীর কলাবউ পুজো আসলে কৃষিসভ্যতারই উদযাপন