নিজস্ব প্রতিবেদন: সময়টা সতেরো শতকের শেষভাগ। দেবীদাস ভট্টাচার্য নামে এক ভদ্রলোকের বাস ছিল (এখনকার বাংলাদেশের) রাজশাহী জেলার নাটোর মহকুমার মাঝের গ্রামে। দেবীদাস অত্যন্ত সাদাসিধে আটপৌরে সাধক প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। পৈতৃক বিষয়-আশয়ের প্রতি তাঁর কোনও লোভ ছিল না। তাই হয়তো তিনি স্ব-বাসস্থান ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন। এসেছিলেন নদিয়ার কালীগঞ্জের জুরানপুর গ্রামের নিকটবর্তী শ্রীরামপুরে। প্রাচীনকালে জুরানপুরের নাম ছিল বারবাকপুর। জুরানপুরে দেবী দুর্গার ধাতব মূর্তি, পঞ্চমুণ্ডির আসন ও ক্রোধীশ ভৈরবের মন্দির অবস্থিত। 


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

আরও পড়ুন: #উৎসব: আসছে ভূত চতুর্দশী! সন্ধেবেলা দরজায় এসে দাঁড়াবে নানা ভূত


এই নাটোরের শ্রীরামপুর গ্রামের রানি ভবানী বসবাস করার জন্য দেবীদাসকে কিছু নিষ্কর জমি দান করেছিলেন। দেবীদাসের সঙ্গে থাকতেন তাঁর সহধর্মিণী ও ছেলে নৃসিংহ। নৃসিংহের জন্মের প্রায় ১২ বছর পরে জন্মগ্রহণ করেন দেবীদাসের কনিষ্ঠপুত্র রাজারাম সিদ্ধান্ত। রাজারামের যখন পাঁচ বছর বয়স তখন তার মাতৃবিয়োগ হয়, আট বছর বয়সে ঘটে তার পিতৃবিয়োগ। কথিত আছে, দেবীদাসের পুত্র রাজারাম শ্রীরামপুরে এক বটগাছের নীচে মাতৃসাধনায় রত ছিলেন। তিনি সর্বশক্তিমান জগন্মাতাকে তাঁর স্ত্রী-রূপে লাভ করতে সাধনা করেছিলেন। তাঁর সাধনায় সন্তুষ্ট দেবী আদ্যাশক্তি রাজারামকে বলেছিলেন, তিনি দেবীকে স্ত্রী-রূপে পাওয়ার পরে বিস্ময়কর কোনো কিছু ঘটনা ঘটতেই পারে। আর তা দেখে যদি রাজারামের মনে কোনও রকম প্রশ্ন জাগে, তা হলে কিন্তু দেবী সঙ্গে সঙ্গে রাজারামকে পরিত্যাগ করবেন! রাজারাম দেবীর এই প্রস্তাবে সম্মত হলেন। 


রাজারাম আদেশ পেয়েছিলেন, মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে নিকটতম ভাবতা-মহুলা গ্রামে বিবাহযোগ্যা এক কন্যা আছে, নাম তার শচীদেবী। যথাকালে তার সঙ্গেই রাজারামের বিবাহ ঠিক হল। বৌভাতের দিন অতিথিদের অন্য পঞ্চব্যঞ্জন পরিবেশন করছিলেন রাজারামের নববিবাহিত স্ত্রী। সেই সময়ে হঠাৎই নববধূর মাথার ঘোমটা সরে যায়, তখন লজ্জা নিবারণের জন্য শচীদেবীর পিঠের দিক থেকে আরও দুটি হাত বেরিয়ে এসে মাথার উপর ঘোমটা তুলে দিল। আশ্চর্যজনক এই ঘটনা দেখে আমন্ত্রিত অতিথিরা বিস্ময়ে শঙ্কায় হতবাক হয়ে পড়লেন। এই ঘটনায় অনুষ্ঠানবাড়িতে চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ল। গোলমালও শুরু হল। পরিস্থিতি কিছুক্ষণ পর স্বাভাবিক হলে দেখা গেল শচীদেবী বাড়িতে নেই! তাঁকে আশেপাশেও কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। 


এদিকে বাড়িতে স্ত্রীকে না পেয়ে তিনি বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যেতে পারেন এই আশঙ্কাকায় তাঁকে খুঁজতে রাজারাম অনেক আগেই রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছিলেন। এবং কোথা দিয়ে শচী যেতে পারেন সেই পথ অনুমান করে স্ত্রীর একরকম পিছুই নিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। শচীরূপী দেবী তা বুঝতেও পেরেছেন। তাই পথে তাঁর এক মৎস্যবিক্রেতা মহিলার সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে সেই মহিলাকে তিনি বলেন, তুমি যে এ পথে আমাকে দেখেছ এ কথা অন্য কাউকে বলবে না। মৎস্যবিক্রেতা বেশ আশ্চর্য হলেন। এদিকে কিছুক্ষণের মধ্যেই রাজারাম ওই পথে এসে পড়েন। এবং ওই মৎস্য বিক্রেতা মহিলার সঙ্গে তাঁরও দেখা হল। তিনি তাঁকে জিগ্যেস করেন, এ পথে আগে কোনও স্ত্রীলোককে যেতে দেখেছেন কিনা!মৎস্যবিক্রেতা মহিলা শচীদেবীর নির্দেশ অমান্য করে রাজারামকে তাঁর গমনসংবাদ দিয়ে দেন। পরক্ষণেই ওই মহিলা রক্ত বমন করতে করতে রাজারামের সামনেই মারা গেলেন। এর পরের ঘটনা আর জানা যায় না। সম্ভবত এর পর রাজারাম আর স্ত্রীর খোঁজে এগোননি।


কালীগঞ্জের হরিনাথপুরে সাধক রাজারামের অগ্রজ নৃসিংহের পুত্র দিননাথ তর্কালঙ্কার প্রথম আদ্যাশক্তির পূজা প্রচলন করেন। দিননাথ মায়ের দর্শন পাওয়ার জন্য দীর্ঘদিন কঠোর সাধনা করেন। দিননাথের আশা ছিল, তাঁর খুল্লতাত সাধক রাজারাম সিদ্ধান্ত যখন শক্তিরূপিণী মাকে পেয়েছিলেন তখন তিনিও তপস্যার মাধ্যমে মাকে পাবেন। তাঁর অনুমান সত্য হয়। কঠিন তপস্যার শেষে একদিন দিননাথ নিদ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় জগন্মাতার দর্শন পান এবং মায়ের কাছ থেকে তাঁর পূজা প্রচলনের আদেশ পান। সেই মতো মায়ের পুজো শুরু হয়। এখানে কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ মতে দক্ষিণাকালী রূপে পূজিতা হন দেবী। বিজয়া দশমীতে শুদ্ধাচারে বোধন হয়। খড় বাঁধা হয়। দেবী আদ্যাশক্তি কালীগঞ্জে বুড়ো মা রূপে বিশেষ পরিচিত। কালী পুজোর অমাবস্যা তিথিতে দেবীর আরাধনা করা হয়। সারারাত্রি ব্যাপী ভট্টাচার্য পরিবারের এই পুজোয় পৌরোহিত্য করেন পরিবারের পুরুষ সদস্যরা। শচীদেবীর কাহিনীকে স্মরণে রেখে ভট্টাচার্য পরিবারের বৌমা বা মেয়েরা দেবীর ভোগ রান্না করেন। পুজোয় যিনি পৌরোহিত্য করেন তিনি ছাড়া অন্য কেউ অঞ্জলি দিতে পারেন না। এই নিয়ম চলে আসছে দিননাথ তর্কালঙ্কারের সময় থেকেই।


পুজোর সময়ে বুড়ো মা'র মন্দিরকে ঘিরে মেলা বসে। আগে এই পুজোয় বলি হত। বর্তমানে বুড়ো মার পুজোয় বলিপ্রথা সম্পূর্ণ বন্ধ। এ পুজোয় আজও দূর-দূরান্ত থেকে ভক্তের সমাগম হয়। করোনার কারণে গত বছরের মতোই বুড়ো মা'র পুজো এবারও অবশ্য ঘটে-পটেই অনুষ্ঠিত হবে। 


(Zee 24 Ghanta App: দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির লেটেস্ট খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Zee 24 Ghanta App)


আরও পড়ুন: #উৎসব: ডাকাতরা মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রক্তচক্ষু মা কালীর মুখ দেখতে পেল!