সৌমিত্র সেন


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

অন্ধকার দূরীভূত হয়ে আলোর রেখা দেখা দিচ্ছে আশ্বিনের স্নিগ্ধ দিগন্তে। দিনের প্রথম আলো। ষষ্ঠী শেষ হয়ে আজ, মঙ্গলবার শুভ দুর্গাসপ্তমী। আজ নবপত্রিকা স্নান। সপ্তমীর এই আলোড়িত ভোরেই তো গঙ্গাতীরে বা অন্যত্র অন্য কোনও নদীঘাটে বা জলাশয়ে নবপত্রিকা স্নান বা কলাবউ স্নান সমাপন হয়। যা দুর্গাপুজোর এক অপরিহার্য অঙ্গ। আপাতদৃষ্টিতে দেখে মনে হয়, যেন একটি কলাগাছকে কাঁধে করে স্নান করাতে নিয়ে যাওয়া হয়। সঙ্গে বাজতে থাকে ঢাক। আর সপ্তমীর ভোরের এই ঢাকবাদ্যই পুজোর সুরটাকে বেঁধে দেয়। আধো ঘুমে আধো জাগরণে সেই ঢাকের মিঠে বাজনার ঢেউ এসে হিল্লোল তোলে মনে।


কলাবউকে সাধারণত গণেশের বউ বলা হয়। তা কিন্তু নয়। কলাবউ দুর্গারই এক রূপ, সেই হিসেবে কলাবউ গণেশের মাতৃস্থানীয়া। কলাবউ আসলে ন'টি উদ্ভিদের এক গুচ্ছ। এতে থাকে কলাগাছ, কচু বা কালকচু গাছ, হলুদ গাছ, জয়ন্তী গাছ, বেল, ডালিম, অশোক, মানকচুগাছ, ধানগাছ। এই ন'টি উদ্ভিদ শ্বেত অপরাজিতা লতা ও লাল সুতো দিয়ে পরস্পর বাঁধা থাকে। কলাগাছটিই আকারে-আকৃতিতে বড় থাকে বলে পুরো ব্যাপারটিকে 'কলাবউ' বলে আখ্যা দেওয়া হয়। প্রসঙ্গত, প্রতিটি উদ্ভিদই বিভিন্ন দেবীর প্রতীক।



কিন্তু কেন হঠাৎ দুর্গাপুজোয় এই উদ্ভিদপুজো?


বলা হয়, দুর্গাপুজোর সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়া এই আচারে আসলে বাংলার কৃষিসভ্যতারই নীরব উদযাপন। এই সময়ে নতুন ফসল ওঠে, সেই ফসলই সারা বছর ধরে সাধারণ মানুষের ক্ষুণ্ণিবৃত্তি করে। শস্যই সম্পদ। তাই বাংলার সাধারণ কৃষিজীবী মানুষ উদ্ভিদকেই পুজো করেন।


আরও পড়ুন: #উৎসব: জালে উঠে এলেন কষ্টিপাথরের 'রাজবল্লভী', চুরি করতে পারল না ডাকাতদল


ভাগবতের দশম স্কন্ধের বিংশ অধ্যায়ের ৪৮ নম্বর শ্লোকে আছে-- 
''পুরগ্রামেষ্বাগ্রয়ণৈরৈন্দ্রিয়ৈশ্চ মহোৎসবৈঃ।
বভৌ ভূঃ পক্কশস্যাঢ্যা কলাভ্যাং নিতরাং হরেঃ।।'' এর অর্থ-- শরৎ এলে নগরে গ্রামে উৎসব শুরু হয়ে যায়। দু'রকমের উৎসব-- নবান্ন ভোজনের জন্য বৈদিক যাগযজ্ঞ এবং সঙ্গে কিছু লৌকিক উৎসব। এই শ্লোকের উল্লেখ এখানে একটাই কারণে। তা হল, ওই 'পক্কশস্যাঢ্যা ভূঃ'; যেখানে শরতে পক্বশস্যপূর্ণ ধরিত্রীর কথা বলা আছে।


অর্থাৎ, বোঝা যাচ্ছে, শরতে শস্যপূর্ণ বসুন্ধরার ঐতিহ্য আজকের নয়। আর উদ্ভিদের মাধ্যমে শস্যস্নাত শরৎ ঋতুকে পুজো করার ঐতিহ্যও অতি প্রাচীন। স্বয়ং হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় তাঁর দুর্গাপুজোর সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়া নবপত্রিকার ব্যাখ্যায় এই তত্ত্বের উল্লেখ করেছেন।


ফলত, ঢাক বাজিয়ে নবপত্রিকা বা কলাবউ স্নান কিংবা দুর্গাপুজোর চারদিন ধরে গণেশমূর্তির পাশে তাঁকে রেখে পুজো করার মধ্যে দিয়ে আসলে ধরিত্রীমাতার আদিতম প্রাণের স্ফুরণকেই শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। শুধু শ্রদ্ধা নয়, এর মধ্যে প্রার্থনাও থাকে। শস্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর কাছে প্রার্থনা-- যেন প্রতি বছরই বিপুল শস্য উৎপাদিত হয়, তাঁদের দুঃখ-দুর্দশা কমে, সংসারে শ্রী ও লাবণ্য বিরাজ করে। 


পুরাকালে বসন্তে দুর্গাপুজো হত। সেই বাসন্তী দুর্গার আরাধনার সঙ্গে এই উদ্ভিদপুজোর কোনও যোগ ছিল না। কিন্তু রামচন্দ্রের অকালবোধনে যেদিন থেকে শরতে দুর্গাপুজো শুরু হল তখন থেকেই আবহমান কাল থেকে চলে আসা উদ্ভিদপুজোও এই দুর্গাপুজোর সঙ্গে জুড়ে গেল। আর দুর্গাসপ্তমীর এক অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে দাঁড়াল আজকের এই 'কলাবউ'।


ভোরের আলোয় ভরে উঠুক সপ্তমীর দিগন্ত, শস্যের আলোয় ভরে উঠুক ধরিত্রী, উৎসবের আলোয় ভরে উঠুক প্রাণ।  


(Zee 24 Ghanta App : দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির লেটেস্ট খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Zee 24 Ghanta App)


আরও পড়ুন: #উৎসব: অষ্টমী-নবমীতে বৃষ্টির আশঙ্কা! আগেই দেখে নিন এমন কিছু পুজো, যে-রাস্তা দ্রুত জলমগ্ন হয়