সৌমিত্র সেন


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

করোনার সেকেন্ড ওয়েভ চলছে, না সেটা আসন্ন, এ নিয়ে তর্ক আছে; কিন্তু এ কথা ঠিক, করোনার প্রকোপ আপাতত নিয়ন্ত্রণে এবং ঘোর করোনামেঘের ফোকর দিয়ে জনজীবনে আলো ক্রমে আসিতেছে। 


আজ, ঠিক এই মুহূর্তেই কী ভাবছেন পর্যটনপ্রেমী আমবাঙালি?


ঘর হতে কবে দুই পা ফেলিয়া বেরিয়ে পড়ে সে একটি ধানের শিষের ওপর একটি শিশিরবিন্দু দেখবে-- সেটাই এক মনে ভেবে চলেছে। ভাববে নাই-বা কেন! 


পয়লা অক্টেবর থেকে আনলক-৫ শুরু হয়ে যাবে। বেশ কিছু ক্ষেত্রে ইতিমধ্যেই ছাড় এসে গিয়েছে। আরও কিছু জিনিসে ছাড় ঘোষিত হবে হয়তো। জীবন আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হচ্ছে। ক্রমে আরও-আরও স্বাভাবিক হবে। 


কিন্তু তবুও যেন কোথায় একটা বাধা রয়ে গিয়েছে। ট্রেন চলছে না। কিছু কিছু দূরপাল্লার ট্রেনের ক্ষেত্রে ছাড় মিলেছে ঠিকই। কিন্তু সমস্ত রুটের সব ধরনের ট্রেন এখনই নয়। সব চেয়ে বড় কথা, লোকাল ট্রেন যতক্ষণ না চলছে, ততক্ষণ ভারতের মতো দেশের জনজীবন স্বাভাবিক হবে না। হয়ওনি। আর বাস চললেও তা সর্বত্র স্বাভাবিক নয়। গাড়ি পেতেও অনেক জায়গায় সমস্যা হচ্ছে। অনেক জায়গায় আবার পর্যটনশিল্পের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নন এমন স্থানীয় মানুষই বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছেন পর্যটকদের। পর্যটকদের তাঁরা এলাকায় ঢুকতে দিচ্ছেন না। সব মিলিয়ে বেশ নেতিবাচক আবহ।   


আর যতক্ষণ না মানুষ সাতপাঁচ না-ভেবেই পিঠে ব্যাগ বেঁধে একছুটে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়তে পারছে, ততক্ষণ তার শান্তি নেই, স্বস্তি নেই, তৃপ্তি নেই। করোনার শাসনে লকডাউনের তর্জনে সেটা সত্যিই সম্ভব হচ্ছে না। ঘোরতর শ্বাসবন্দি অবস্থা সাধারণ মানুষের। আর ঠিক এই প্রেক্ষিতেই তার সামনে এসে দেখা দিল এ বছরের বিশ্ব পর্যটন দিবসটি।


তার মানে, এই নয় যে, পাঁজি দেখে বেরিয়ে পড়ার মতো করে বাঙালিসন্তান বছর-বছর এই ২৭ সেপ্টেম্বর তারিখেই তার যাবতীয় ট্যুর-পরিকল্পনা সেরে রাখে বা ব্যাগ অ্যান্ড ব্যাগেজ নিয়ে সপরিবারায়ৈঃ কিংবা সবান্ধব পাড়ি দেয় বনে-পাহাড়ে, সমুদ্রে-মরুতে। কিন্তু ব্যাপারটা হল, যেহেতু ঠিক পুজোর আগে-আগেই এই দিনটি ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে উঁকি দেয়, তাই একটু দিন-তারিখের খেয়াল রাখা ট্রেন্ডি বাঙালি এই বিশ্ব পর্যটন দিবসটিকে নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে উপভোগ করে। কেননা, তার ছুটি ততদিনে তাকে শরৎমেঘের আলাড় থেকে ডাক দিয়ে গিয়েছে। মেঘের ভ্রুকুটি ততদিনে 'আউট' আর আশ্বিনের মধুমাধুর্য 'ইন'। কাশ ফুল ফুটুক না ফুটুক তার মনের নদীতটে আলো করে ফুটে থাকে তন্বী কাশমঞ্জরী। তার অবসরের ভিজে মাটিতে ঝরে থাকে নিভৃত নরম শিউলি। সে জানে, ছুটি আসছে, দেবীপক্ষ আসছে, মা আসছেন। সেই আনন্দ-অনুভূতির সঙ্গেই মিলেমিশে যায় তার আসন্ন কোনও বেড়ানোর আনন্দও। তখন আপনা থেকেই অজান্তেই পর্যটন দিবসটা কী ভাবে যেন একটা অন্য রকম মাত্রা পেয়ে যায়। 



না, দেখতে গেলে পর্যটন দিবস আছে পর্যটন দিবসেই। তা নিশ্চয়ই ভার্চুয়ালি পালিত হচ্ছে। প্রত্যক্ষভাবেও কোথাও কোথাও উদযাপিতও হচ্ছে সমস্ত করোনা সুরক্ষাবিধি মেনেই। হয়তো রঙচঙে ব্রোশিওর প্রকাশিত হচ্ছে। বই বেরোচ্ছে। পোস্টার বিলি হচ্ছে। বিশ্ব পর্যটন দিবস কী এবং কেন-- এ নিয়ে হয়তো বিপুল জ্ঞানচর্চাও কোথাও না কোথাও, কোনও না কোনও প্লাটফর্মে সগৌরবে চলিতেছে। এবং সেখানে নিশ্চয়ই স্মরণ করা হচ্ছে এই মামুলি অথচ চিরাচরিত কথাগুলি যে-- আদিম জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখে ট্যুরিজম; গ্রাম্য জীবনযাপনের খুঁটিনাটিকে জিইয়ে রাখে পর্যটন; পর্যটন মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে প্রকৃতির আন্তঃসম্পর্ককে লালন-পালন করে; বহুস্তরীয় ও বহুমুখী আদান-প্রদানের মাধ্যমে ট্যুরিজম সযত্ন মমতায় রক্ষা করে আঞ্চলিক জনগোষ্ঠীর আবহমান সংস্কতিকে! এবং এরকম আরও আরও নানা কিছু করে চলে, করে চলেছে, করবেও পর্যটনশিল্প। আর সেই সব 'অ্যাচিভমেন্ট' উদযাপনের প্ল্যাটফর্ম হল এই ২৭ সেপ্টেম্বর।



কিন্তু তাতে কী হল? 


আসলে কিছুই হল না! কেননা, এ সবে বাঙালির ভারী বয়ে গেল! সহজাত ভাবে আবেগপ্রবণ হলেও সে সময়ে-সময়ে বড় বাস্তববাদী। সে জানে, এখনও তার সামনে দরজা বন্ধ। এখনও তার পর্যটনপথ সম্পূর্ণ বিপদমুক্ত নয়। নয় মসৃণ। এখনও তার সামনে পথরোধ করে দাঁড়িয়ে করোনা। এখনও তার শয়নে-স্বপনে শুধুই মাস্ক-স্যানিটাইজার-হেডক্যাপ-গ্লাভস-থার্মাল স্ক্রিনিং-ইমিউনিটি-কাঁচাহলুদ-গরমজলের মাপা হাসি চাপা কান্না। এখনও তার পাখির চোখ করোনা ভ্যাকসিন, যা নিয়ে বিশ্বজুড়ে মগজাস্ত্রের ঠান্ডা প্রতিযোগিতা। এখনও তার সামনে রীতিমতো ভয়জাগানো শব্দ হল-- লকডাউন, কন্টেনমেন্ট জোন, সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং। এ সবই তার কাছে প্রতিবন্ধকতা। এগুলিকে একটা-একটা করে পেরোতে হবে। না হলে সে তার ঈপ্সিত 'ধামে' পৌঁছতে পারবে না। 


যেখানে শুধুই অবারিত সখ্য। কোথাও কোনও ডিস্ট্যান্সিং নেই। কোনও সঙ্গরোধী চোখরাঙানিয়া নেই। দূরত্ববিধির প্যাঁচ-পয়জার নেই। পরিচ্ছন্নতার স্নিগ্ধতা আছে, কিন্তু হ্যান্ড স্যানিডাইজারের যান্ত্রিকতা নেই। নিভৃতবাসের মদিরতা আছে, কিন্তু মাস্কের কষ্টকাঠিন্য নেই। নির্জনতার কাব্য আছে, কিন্তু গণ্ডিবন্ধতার ত্রিকোণমিতি নেই। 


এবং যেখানে কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা! অপরিমিত আলোবাতাসের নৈঃশব্দ্যে রণিত হতে-হতে, অনন্ত জলঝরনার ঠুমরি শুনতে-শুনতে, পাহাড়িয়া বনপথের ঔদাস্যে মথিত হতে-হতে ক্ষণেই ক্ষণেই সঙ্গীজনের সঙ্গে সাবলীল জুড়ে যাওয়া আর মুহূর্তেই আত্ম-কুটিরের দরজায় গিয়ে অনায়াস একাকী দাঁড়িয়ে পড়ার যে রোলার-কোস্টার, যা পর্যটনের প্রাণ, সেই অপূর্ব বৈপরীত্যের মাঝখানটিতে গিয়ে পড়াটার সাহস ও শৌর্যই যে সে করোনার সঙ্গে বিরোধের এই দিনগুলিতে খুইয়ে ফেলতে একরকম বাধ্য হয়েছে।


পরিস্থিতি অবশ্য বদলাচ্ছে। লকডাউনের পরে এ রাজ্যে বেশ কিছু জায়গায় ট্যুরিস্ট লজ খুলে গিয়েছে। খুব দূরে যেতে হবে না, হাতের কাছেই রয়েছে বিষ্ণুপুর, মাইথন, ডায়মন্ড হারবার, বকখালি, ঝাড়গ্রাম। আর একটু দূরে উত্তরের পাহাড়ও তার আগল খুলেছে।  দার্জিলিং-কালিম্পংয়ের মেঘভেজা বনরাস্তায় পর্যটকদের জন্য আহ্বানের নিবিড় গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। অক্টোবরে হয়তো সিকিমও খুলে যাবে।



না খুলে উপায়ই-বা কী? শুধু নান্দনিক দিকের কথা ভাবলেই তো চলবে না। জেলায় জেলায় অসংখ্য  মানুষ এই পর্যটন শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। শুধু দার্জিলিং-অঞ্চলেই স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অন্তত ১৫ শতাংশ মানুষ তাঁদের রুটিরুজির জন্য সম্পূর্ণ ভাবে পর্যটনের উপরই নির্ভরশীল। তাঁদের কী হবে? সুন্দরবনে-নদিয়ায়-মালদায়-মুর্শিদাবাদে-বীরভূমে-বাঁকুড়ায় যে কত মানুষ পর্যটনকে আঁকড়ে বেঁচে থাকেন, তাঁদের কী হবে? ঝাড়গ্রামে-অযোধ্যাপাহাড়ে-ফ্রেজারগঞ্জে-তাজপুরে যে সব মানুষ বেড়ানোপাগল কিছু মানুষের জন্যই নিজের পরিবারের লোকজনের মুখে একটু হাসি ফোটাতে পারেন, তাঁদের কী হবে? ছোট-বড় হোটেল, হোম স্টে, খাবারের দোকান, চায়ের দোকান, গাড়ির জোগান, গাইডের ব্যবস্থা-- কত রকম ভাবেই যে মানুষ জড়িত থাকেন পর্যটন বিষয়টির সঙ্গে তার ইয়ত্তা নেই। সবই বেবাক ধাক্কা খাচ্ছে।


অর্থাৎ, একদল লোক বাড়ি থেকে বেরতে পারছে না, আর অন্য দলটি ওই বাড়ি-থেকে-বেরনো-লোকগুলির অভাবে আঙুল কামড়াচ্ছে-- করোনাকণ্টকিত বাংলায় এ বারে পর্যটন দিবসে পর্যটনের মানচিত্রটা তাই বেশ মনকেমনিয়া, অনুজ্জ্বল।


তবে, বাঙালি হারার পাত্র নয়। চিরদিন পায়ের তলায় তার সর্ষে। মনের ভিতরে অজানার প্রতি অমোঘ টান। বেরিয়ে সে পড়বেই একদিন। পরিস্থিতি আর একটু স্বাভাবিক হলেই সে একটানে সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ভাল-মন্দ ভুলে বেরিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়বে রৌদ্রোজ্জ্বল আকাশশামিয়ানার নীচে, জ্যোৎস্নামদির বনপূর্ণিমায়, অরণ্যগন্ধের অন্ধকারে, সমুদ্রতরঙ্গের লীলামাধুর্যে, উত্তুঙ্গ পাহাড়ের পায়ের কাছে, উদাস বাতাসের অপার চাঞ্চল্যের নির্জনে!