Bhasha Diwas: `২১ ফেব্রুয়ারি` `একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ` বা `বরাকের ভাষা-আন্দোলনে`র চেয়ে ঢের আগের আলো...
Bhasha Diwas: জীবনযাপনের ক্ষেত্রে আজকের বাঙালি তার খাঁটি বাঙালিয়ানা বর্জন করে বহুদিনই এক মিশ্র যাপনধর্মের পন্থী হয়ে পড়েছে। কিন্তু তবুও প্রতি বছর ভাষাদিবস এলেই সে বাংলা ভাষার প্রতি গভীর আবেগে কেঁদে-কঁকিয়ে ওঠে। কিন্তু একদিন এই গ্রহে ভাষাগত অধিকারের জন্য রক্ত ঝরেছিল। এই গ্রহে ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিল ক`টি তাজা প্রাণ। সেই প্রথম ভাষার বেদিতে এত তাপ, এত আগুন, এত দীপ্তি, এত সংকল্প ফুটে উঠেছিল!
সৌমিত্র সেন
নিজের ভাষা-সংস্কৃতিকে অগ্রাধিকার দেওয়ার বিষয়টা বহুদিনই ভুলেছে বাঙালি। সে তার বাচ্চাদের ইংরেজি মাধ্যমে পড়ায়, সে মাতৃভাষার সঙ্গে ইংরেজি-হিন্দি মিশিয়ে এক আশ্চর্য বিজাতীয় ভাষায় কথা বলতে পছন্দ করে, অফিশিয়াল ক্ষেত্রে সে সর্বত্র ইংরেজিরই পক্ষপাতী, জীবনযাপনের ক্ষেত্রেও সে খাঁটি বাঙালিয়ানাকে বর্জন করে বহুদিনই এক মিশ্র যাপননীতি ও আচারধর্মের পন্থী হয়ে পড়েছে। কিন্তু তবুও প্রতি বছর ভাষাদিবস এলেই সে বাংলা ভাষার প্রতি গভীর আবেগে একেবারে কেঁদে-কঁকিয়ে ওঠে।
আর এই ভাষাদিবস নিয়ে ভাবতে-ভাবতেই আমরা কখনও মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সেটাকে গুলিয়ে ফেলি, কখনও অসমের বরাক উপত্যকার ভাষা-আন্দোলনের সঙ্গে তাকে এক করে ফেলি (অধিকাংশ বাঙালি অবশ্য বরাক উপত্যকার ভাষা-আন্দোলনকে সম্পূর্ণ ভুলেও থাকে)। সব মিলিয়ে একটা ধোঁয়াশা তৈরি হয়ে যায়।
তাহলে একটু তাকানো যাক ২১ ফেব্রুয়ারির ইতিহাসের দিকে। স্বাধীনতালাভের ঠিক পরেই পূর্ব বঙ্গের বঙ্গসমাজে বাংলা ভাষার অবস্থান নিয়ে ভাষাচেতনার যে-উন্মেষ ঘটে, তার সূত্র ধরেই ঢাকায় ১৯৪৭ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরে ভাষা-বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল। ১৯৪৮ সালের মার্চে এ নিয়ে ছোট আকারে একটা আন্দোলন হয়। তবে তা ক্রমশ বড় আকার ধারণ করতে থাকে এবং ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি তার চরম প্রকাশ ঘটে।
১৯৫২ সালে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক ছিলেন বাঙালি (সেখানকার মোট নাগরিকের প্রায় ৫৪ শতাংশ)। শুধুমাত্র উর্দুকেই জাতীয় ভাষা হিসেবে ঘোষণার প্রতিবাদে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি (৮ ফাল্গুন ১৩৫৮) বাঙালি ছাত্রেরা সেখানে সরকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। সকাল ন'টায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে জড়ো হতে শুরু করেন তাঁরা। সশস্ত্র পুলিসবেষ্টিত ক্যাম্পাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং অন্যান্য কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন। বেলা একটু গড়ালে ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন। উপাচার্য ছাত্রদের এলাকা ছেড়ে চলে যেতে বলেন। সেই সময়ে ১৪৪ ধারা লঙ্ঘনের জন্য পুলিস কয়েকজন ছাত্রকে গ্রেফতারও করে। এই খবর পেয়ে আর একদল বিক্ষুব্ধ ছাত্র পূর্ববাংলা গণপরিষদ অবরোধ করে। কিছু ছাত্র বিল্ডিংয়ের মধ্যে ঢোকার চেষ্টা করলে পুলিস গুলি চালাতে শুরু করে। আর সেই গুলিতেই নিহত হন সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার-- ৫টি তাজা প্রাণ। ভাষার জন্য বিরল অ-ভূতপূর্ব সেই আত্মবলিদানকে স্মরণ করেই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের শুরু। যদিও মূল ঘটনার অনেকগুলি বছর পরে। এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস (International Mother Language Day) পালিত হয় পৃথিবী জুড়ে। ১৯৯৯ সালের নভেম্বরে ইউনেস্কো (unesco) '২১ ফেব্রুয়ারি' দিনটিকে স্বীকৃতি দেওয়ার, শ্রদ্ধা জানানোর সিদ্ধান্ত নেয়। তার পর থেকে প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি দুনিয়া জুড়ে পালিত হয়ে আসছে।
মুক্তিযুদ্ধ এর অনেক পরের ঘটনা। ১৯৭১ সালের। সেই আন্দোলনে পূর্ববঙ্গ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, বিশ্বে 'বাংলাদেশ' নামে পরিচিত হয়। অবশ্যই সেই লড়াইয়ের পিছনে, সেই অর্জনের পিছনে, রাজনৈতিক সেই স্বীকৃতিলাভের পিছনে পূর্ববঙ্গের মানুষের ওই ভাষা-অভিমান, ওই ভাষা-প্রেম, স্বভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে তার ওই প্রগাঢ় সংসক্তির একটা গভীর অবদান ছিলই।
অসমের বরাক উপত্যকার বাংলা ভাষা-আন্দোলন ছিল বিখ্যাত এই দুই ঘটনার ঠিক মাঝখানের ঘটনা। ১৯৬০ সালে অসম সরকার অসমীয়া ভাষাকে রাজ্যের একমাত্র অফিশিয়াল ভাষা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সেই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন সেখানকার বাংলাভাষী। আসলে ওই অঞ্চলের জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই ছিল বাংলাভাষী। ১৯৬১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি 'কাছাড় গণ সংগ্রাম পরিষদ' নামের এক সংগঠনের জন্ম হয়। অসম সরকারের এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে ১৪ এপ্রিল শিলচর, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দির মানুষ 'সংকল্প দিবস' পালন করেন। তবে চূড়ান্ত ঘটনাটি ঘটে ১৯৬১ সালের ১৯ মে। সেদিন ১১ জন প্রতিবাদীকে শিলচর রেলওয়ে স্টেশনে গুলি করে হত্যা করেছিল অসম প্রাদেশিক পুলিস। এই ঘটনার পর অসম সরকার বরাক উপত্যকায় বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসাবে ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। শুধু তাই নয়, প্রতি বছর বরাক উপত্যকা-সহ ভারতের বিভিন্নপ্রান্তে ১৯ মে-কে 'বাংলা ভাষা শহিদ দিবস' হিসেবে পালন করা হয়।
আরও পড়ুন: Shani Surya Yuti: ৩০ বছর পরে শনি-সূর্যের মহাযোগ! কাদের উপর শনির কোপ, কাদের উপর আশীর্বাদ?
''কালো রাত পোহানোর পরের প্রহরে/ শিউলি শৈশবে/ 'পাখী সব করে রব' ব'লে মদনমোহন তর্কালঙ্কার কী ধীরোদাত্ত স্বরে প্রত্যহ দিতেন ডাক।/ তুমি আর আমি, অবিচ্ছিন্ন, পরস্পর মমতায় লীন, ঘুরেছি কাননে তাঁর নেচে নেচে,/ যেখানে কুসুমকলি সবই ফোটে, /জোটে অলি ঋতুর সঙ্কেতে।'' একটা সময়ে এই উপমহাদেশের মাটিতেই বাঙালির চেতনায় ধরা দিয়েছে ভাষার প্রতি তীব্র আবেগ। নিজের ভাষা-সংস্কৃতি নিয়ে সেই সময়ের সেই জায়গার বাঙালি কত বেশি জাগ্রত ছিল! নিশ্চয়ই তাঁদের স্বপ্নে-কল্পনায়-বোধে ফিরে ফিরে ধরা দিত শিউলিশৈশব, পাখি-রব, কুসুমকলি, ঋতুসঙ্কেত। সেই রক্তঝরা ভাষা-দিনই এর পর থেকে প্রতিদিন বাংলা ভাষা-সমাজ-সংস্কৃতির নিকোনো উঠানে রোদ হয়ে ঝরে পড়েছে। সেই আবেগ ও ক্রোধ তার পর থেকেই 'নক্ষত্রপুঞ্জের মতো জ্বলজ্বলে পতাকা উড়িয়ে' নিয়ত জেগে থেকেছে আমাদের সত্তায়। সেই ত্যাগ ও সাহসই ক্রমে বয়েসী বটের ঝিলিমিলি পাতার ছায়া বিছিয়ে দিয়েছে আমাদের ভাষায়। তার পর থেকে এই দিনটি আমাদের অলঙ্কার, আমাদের অহঙ্কার, আমাদের গৌরব, আমাদের সৌরভ হয়ে থেকেছে, হয়তো এই সেদিন পর্যন্তও তা-ই ছিল। আজও যে ঠিক একইরকম আছে, তা কি আর খুব জোর গলায় বলা যাচ্ছে? কেননা, একে তো বাঙালি ঘটনাক্রম গুলিয়ে ফেলছে,তার সঙ্গে হারিয়ে ফেলছে সেই পুরনো আবেগ,সেই উত্তাপ, যা তাকে ফিরে-ফিরে এই দিনটির সমীপে নিয়ে আসে।