পিনাকী ভট্টাচার্য


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্সের 737 ম্যাক্স বিমান দুর্ঘটনায় আরও বিপাকে বোয়িং। বিধ্বংস বিমানটির ব্ল্যাক বক্সের তথ্য অনুসারে, বিমানটিকে মাটিতে আছড়ে পড়া রুখতে বোয়িংয়ের নির্দেশিত যাবতীয় পন্থা সঠিকভাবে অবলম্বন করেছিলেন চালকরা। তার পরও রোখা যায়নি দুর্ঘটনা। এর ফলে বোয়িং ৭৩৭ ম্যাক্স বিমানটি কতটা উড্ডয়ক্ষম তা নিয়ে ওঠা প্রশ্ন আরও জোরালো হয়েছে। 



কী ভাবে ঘটেছিল দুর্ঘটনা? 


গত ১০ মার্চ ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবা থেকে ওড়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই ভেঙে পড়ে বোয়িংয়ের আনকোরা ৭৩৭ ম্যাক্স বিমানটি। আদ্দিস আবাবা থেকে কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবিগামী ওই বিমানে ছিলেন ১৫৭ জন আরোহী। দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান প্রত্যেকেই। গত অক্টোবরে বিমানটি প্রথম আকাশে ওড়ে।  



কোন পথে এগোয় তদন্ত?


ইথিওপিয়ান এয়ারলাইনসের বিমান দুর্ঘটনার সঙ্গে পাঁচ মাস আগে ইন্দোনেশিয়ায় ঘটা লায়ন এয়ারের উড়ান ৬১০-এর দুর্ঘটনার মিল পান অনেক বিশেষজ্ঞ। গত ২৯ অক্টোবর ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তা থেকে ওড়ার পর সমুদ্রে আছড়ে পড়েছিল বিমানটি। তদন্ত যত এগোয় ততই আশঙ্কা সত্যি হতে থাকে। জানা যায়, বোয়িং ৭৩৭ ম্যাক্স বিমানে থাকা MCAS নামে একটি ব্যবস্থা খারাপ হয়ে যাওয়ায় আছড়ে পড়েছে দু'টি বিমানই। বিষয়টি প্রকাশ্যে আসতেই যুদ্ধকালীন তত্পরতায় MCAS সিস্টেমের ত্রুটি ঠিক করতে নামেন বোয়িংয়ের ইঞ্জিনিয়াররা। ওদিকে একে একে তাদের বোয়িং 737 ম্যাক্স বিমানগুলি পরিষেবা থেকে সরিয়ে দেয় বিভিন্ন বিমানসংস্থা। ভারত-সহ বিশ্বের একাধিক দেশ তাদের আকাশসীমায় বিমানটিকে নিষিদ্ধ করে। 


ঘটনার তদন্তে এবার উঠে এল আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য। গত অক্টোবরে লায়ন এয়ারের বিমান দুর্ঘটনার পর MCAS কাজ না করলে চালকদের কী করতে হবে তার একটি নির্দেশিকা জারি করেছিল বিমানটির নির্মাতা সংস্থা বোয়িং। ইথিওপিয়ান এয়ারলাইনসের দুর্ঘটনাগ্রস্ত বিমানটির ফ্লাইট ডেটা রেকর্ডার (ব্ল্যাক বক্স)-এর তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা গিয়েছে, সেই সমস্ত পদক্ষেপই পালন করেছিলেন ২ পাইলট। তার পরও বাঁচানো যায়নি বিমানটিকে। এতেই আরও বিপদে পড়েছে বোয়িং।



বোয়িংয়ের প্রাণভোমরা 737 ম্যাক্স 


বিশ্বের সব থেকে জনপ্রিয় বাণিজ্যিক বিমানগুলির অন্যতম বোয়িং ৭৩৭। ২০১৬ সালে তার অত্যাধুনিক ভার্সন বাজারে আনে বোয়িং। নাম দেয় বোয়িং ৭৩৭ ম্যাক্স। মূলক প্রতিদ্বন্দ্বী সংস্থা এয়ারবাসের A320 neo মডেলকে টেক্কা দিতে বাজারে আনা হয় এই বিমান। বিমানটির ইঞ্জিন তৈরি অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে। যা ৩০ শতাংশ পর্যন্ত জ্বালানি সাশ্রয় করে। ফলে একদিকে যেমন কমে উড়ানের খরচ, তেমন দূষণও ছড়ায় কম। বিমানটির উড়ানের সময় শব্দদূষণের মাত্রাও নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে বোয়িং।



MCAS কী?


বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, মাঝ আকাশে বিমান যাতে দাঁড়িয়ে না-পড়ে সেজন্য ৭৩৭ ম্যাক্সে লাগানো হয়েছে MCAS বা ম্যানুভারিং ক্যারেক্টারস্টিক আউগুমেন্টেশন সিস্টেম। অ্যাঙ্গেল অফ অ্যাটাক সেন্সর থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে কাজ করে এই ব্যবস্থা। জানা গিয়েছে, লায়ন এয়ারের উড়ান ৬১০ ও ইথিওপিয়ান এয়ারলাইনসের উড়ান ৩০২-তে বিগড়ে গিয়েছিল ওই সেন্সর। যার ফলে ভুল তথ্যের ভিত্তিতে নিজে থেকেই মাটিতে আছড়ে পড়ে বিমান ২টি।



কেন লাগানো হল MCAS?


বোয়িং ৭৩৭ বিমান আকাশে উড়ছে গত প্রায় ৫০ বছর ধরে। নানা সময় বাজারের চাহিদা অনুসারে বিমানটির একাধিক মডেল লঞ্চ করেছে বোয়িং। কিন্তু 737 Max ছাড়া অন্য কোনও মডেলে নেই MCAS ব্যবস্থা। কারণ, নতুন বিমানে লাগানো ইঞ্জিন আকারে আগের সমস্ত ইঞ্জিনের থেকে বড়। ফলে বিমানের ডানার তলায় ধরছিল না ওই ইঞ্জিন। সমস্যা সমাধানে ইঞ্জিনদু'টিকে সামান্য এগিয়ে উঁচু করে লাগিয়েছে বোয়িং। এতে বিমানের ভরকেন্দ্রের সঙ্গে ইঞ্জিনের অক্ষের ভারসাম্য নড়ে গিয়েছে। এর ফলে বিমানটির ইঞ্জিন জোরে চালালেই বিমানটি ওপরের দিকে বাইতে শুরু করে। এভাবে বিমানের কৌণিক অভিমুখ বায়ুপ্রবাহের অভিমুখের সঙ্গে খুব বেশি হয়ে গেলে মাঝ আকাশেই থেমে যেতে পারে বিমান। আর বিমান উড়তে গেলে যেহেতু ন্যূনতম গতির প্রয়োজন, সেক্ষেত্রে মাটিতে আছড়ে পড়বে বিমান। এই বিপদ এড়ানোর জন্যই বোয়িং 737 ম্যাক্সে লাগানো হয়েছে MCAS. যা অ্যাঙ্গেল অফ অ্যাটাক সেন্সর থেকে বায়ুপ্রবাহের গতি জেনে বিমানের পিছনের ছোট ডানা দু'টির কৌণিক বিক্ষেপ বদলে বিমানের উলম্ব গতি নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু এই গোটা এই বিষয়টিই হয় পাইলটের অলক্ষ্যে।       



কী ভাবে ওড়ে বিমান? 


বিমান উলম্ব গতি (আকাশে বিমান ওপরে উঠবে বা নীচে নামবে) ঠিক করে বিমানের একেবারে পিছনে থাকা ছোট্ট ডানাদু'টি। একটি জ্যাকের মাধ্যমে ওই ডানাদু'টিতে লাগানো থাকে একটি মোটর। পাইলট একটি স্যুইচের মাধ্যমে মোটরটিকে ঘুরিয়ে ডানার কৌণিক বিক্ষেপ বদলে বিমানের অভিমুখ ঠিক করেন। এই মোটরের সঙ্গেই লাগানো থাকে MCAS সিস্টেমও। কোনও ক্ষেত্রে মোটর কাজ না করলে একটি চাকা ঘুরিয়ে ডানার কৌণিক বিক্ষেপ বদলাতে পারেন চালক। চালকের পাশে একটি চাকতিতে পেঁচানো থাকে তারটি। চাকাটিকে ঘুরিয়ে বদলাতে হয় পিছনের ডানার কৌণিক বিক্ষেপ।



পাইলটদের অভিযোগ


অক্টোবরে লায়ন এয়ারের বিমান দুর্ঘটনার পর বোয়িং বিমানচালকরা জানান, MCAS-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যবস্থা সম্পর্কে তাদের কিছুই জানায়নি বোয়িং। ফলে পুরনো 737 ওড়ানোর অভিজ্ঞতা দিয়েই 737 Max ওড়াচ্ছিলেন তাঁরা। এমনকী নতুন বিমান ওড়ানোর জন্য চালকদের কোনও প্রশিক্ষণও দেয়নি বোয়িং। 



লায়ন এয়ার দুর্ঘটনার পর পাইলটদের কী নির্দেশিকা দিয়েছিল বোয়িং?


লায়ন এয়ারের উড়ান ৬১০ দুর্ঘটনার পর প্রথম জানা যায় MCAS ব্যবস্থার কথা। বোয়িংয়ের তরফে জানানো হয়, কোনও বিমান আকাশে থাকা অবস্থায় MCAS ব্যবস্থা বিগড়ে গেলে কী করে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে বিমানকে। সেজন্য বিশেষ করে ২টি স্যুইচের উল্লেখ করে বোয়িং। জানানো হয়, অটোপাইলট বন্ধ করে স্যুইচ দু'টি বন্ধ করলে বন্ধ হয়ে যাবে বিমানের পিছনে ছোট ডানা দুটির সঙ্গে লাগানো মোটরটি। এর পর ম্যানুয়ালি ওড়াতে হবে বিমানকে। 


বয়স মাত্র ১৪ বছর, ভিডিয়ো গেম খেলে বছরে আয় ১.৪ কোটি টাকা!


কী বলছে ইথিওপিয়ানের উড়ান ৩০২-এর ব্ল্যাক বক্স


তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, ইথিওপিয়ানের উড়ান ৩০২-এর চালক ও ফার্স্ট অফিসার বোয়িংয়ের যাবতীয় নির্দেশ মেনে চলেছিলেন। আদ্দিস আবাবা থেকে ওড়ার পরেই তাঁরা টের পান বিমানটি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। সঙ্গে সঙ্গে অটোপাইলট বন্ধ করে নির্দিষ্ট স্যুইচদু্'টি বন্ধ করেন তাঁরা। কিন্তু তার পর হাতে চাকা ঘুরিয়ে পিছনের ডানার কৌনিক বিক্ষেপ পরিবর্তন করে বিমানের ভারসাম্য ফেরাতে পারেননি তাঁরা। 


বর্তমানে গোটা বিশ্বের বিভিন্ন বিমানসংস্থার কাছে প্রায় ৩৫০টি বোয়িং ৭৩৭ ম্যাক্স বিমান রয়েছে। আরও ৫,০০০টি ৭৩৭ ম্যাক্স বিমান তৈরির বরাত রয়েছে বোয়িংয়ের কাছে। এই পরিস্থিতিতে ফের এই বিমান কবে আকাশে উড়বে জানা নেই কারও। বিশ্বের বিভিন্ন বিমান সংস্থা অন্তত জুলাই পর্যন্ত বিমান আকাশে ওড়ানো যাবে না ধরে নিয়ে এগোচ্ছে। কী করে তাদের ছাড়পত্র দেওয়া বিমানে এমন মূলত ত্রুটি রইল তা নিয়ে ব্যাপক চাপে মার্কিন অসামরিক বিমান চলাচল দফতর FAA. ইতিমধ্যে তাদের বেশ কয়েকজন আধিকারিকের বিরুদ্ধে তদন্ত হবে বলে জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে শেষ পর্যন্ত যদি কোনও দিনই এই বিমান আর আকাশে না ওড়ে তাহলে উড়ানশিল্পের থেকে বেশি ক্ষতি বোয়িংয়ের।