Israel-Palestine Conflict: কেন প্যালেস্টাইনের পাশ থেকে নীরবে সরে গেল ভারত?
প্রায় ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষেত্রে ভারতের নেওয়া কূটনৈতিক অবস্থানকে এক লহমায় সম্পূর্ণ নাকচ করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। হামাসের ইজরায়েলের উপর আক্রমণের মাত্র কয়েক ঘন্টা পরেই, মোদী নিরপেক্ষতার সব পথ পরিত্যাগ করে ভারতের পক্ষ স্পষ্ট করে দিয়েছেন।
অনুষ্টুপ রায় বর্মণ: যুদ্ধে ধ্বস্ত মধ্যপ্রাচ্য। দুই পক্ষের একের পর এক রকেট হামলায় নিহতের সংখ্যা পার হয়ে গিয়েছে ১০০০। হামাসের আক্রমণের প্রত্যুত্তরে ইতিমধ্যেই ইজরায়েলের মন্ত্রী ঘোষণা করেছেন গাজাকে এমনভাবে ধ্বংস করা হবে যাতে আগামী ৫০ বছরে সে উঠে দাঁড়াতে না পারে। এই ভয়াবহ যুদ্ধের আবহে ভারতে বসে ঠিক কতটা নিশ্চিন্ত আপনি? কার দিকে আপনার সমর্থন? হামলা তো করল হামাস তাহলে ইজরায়েলই ভালো, নাকি কিছু দোষ তাদরও ছিল?
এই প্রশ্নই এই মুহুর্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে ভারতের রাজনৈতিক মহলের অন্দরে। যুদ্ধের শুরুতেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ট্যুইট করেছেন এবং সরাসরি জানিয়েছেন দেশের সরকারি অবস্থান। প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন ভারত এই যুদ্ধে ইজরায়েলের পক্ষে রয়েছে। অন্যদিকে নিজেদের কর্মসমিতির বৈঠকে বিরোধী দল কংগ্রেস সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাদের সমর্থন থাকবে প্যালেস্টাইনের প্রতি। এই দুইয়ের মাঝে দাঁড়িয়ে কার প্রতি থাকবে আপনার সমর্থন এই নিয়েই তোলপাড় চায়ের দোকানের আড্ডা থেকে শুরু করে মধ্যবিত্তের ড্রয়িংরুম।
ভারত প্যালেস্টাইন সম্পর্কের ইতিহাস
প্যালেস্টাইনের প্রতি ভারতের সমর্থন দেশের বিদেশ নীতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। ১৯৭৪ সালে, ভারত ছিল প্রথম অ-আরব দেশ যারা প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (PLO) কে প্যালেস্টিনীয় জনগণের একমাত্র এবং বৈধ প্রতিনিধি হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। ১৯৮৮ সালে, প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়া প্রথম দেশগুলির মধ্যে একটি ছিল ভারত। ১৯৯৬ সালে, ভারত গাজায় তার প্রতিনিধি অফিস খোলে, যা পরে ২০০৩ সালে রামাল্লায় স্থানান্তরিত হয়।
ভারত বিভিন্ন বহুপাক্ষিক ফোরামে প্যালেস্টাইনের জন্য সমর্থন দেওয়ার ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। ভারত রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ পরিষদের (ইউএনজিএ) ৫৩তম অধিবেশনের সময় ‘প্যালেস্টিনীয়দের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার’ সম্পর্কিত খসড়া প্রস্তাব স্পনসর করেছিল এবং এর পক্ষে ভোট দিয়েছে। ভারত ২০০৩ সালের অক্টোবরে ইসরায়েল তৈরি ‘বিচ্ছিন্নতা প্রাচীর’ নির্মাণের বিরুদ্ধে ইউএনজিএ রেজোলিউশনের পক্ষে ভোট দেয়। ২০১১ সালে, ভারত প্যালেস্টাইনকে ইউনেস্কোর পূর্ণ সদস্য করার পক্ষে ভোট দেয়।
ভারত ২৯ নভেম্বর, ২০১২ তারিখে ইউএনজিএ রেজোলিউশনের কো-স্পনসর ছিল এবং এর পক্ষে ভোট দেয় যা ভোটাধিকার ছাড়াই প্যালেস্টাইনকে জাতিসংঘে 'অ-সদস্য পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র' করে। ভারত এপ্রিল ২০১৫ সালে এশিয়ান আফ্রিকান মেমোরেটিভ কনফারেন্সে প্যালেস্টাইনের বিষয়ে বান্দুং ঘোষণাকে সমর্থন করেছিল এবং সেই সঙ্গে সেপ্টেম্বর ২০১৫ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জের অফিসে প্যালেস্টাইনের পতাকা স্থাপনকে সমর্থন করেছিল।
আরও পড়ুন: Israel-Palestine Conflict: যুদ্ধে ধ্বস্ত মধ্যপ্রাচ্যে এবার 'অপারেশন অজয়' ভারতের...
ইজরায়েলের সমর্থনে কী বললেন প্রধানমন্ত্রী?
প্রায় ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষেত্রে ভারতের নেওয়া কূটনৈতিক অবস্থানকে এক লহমায় সম্পূর্ণ নাকচ করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। হামাসের ইজরায়েলের উপর আক্রমণের মাত্র কয়েক ঘন্টা পরেই, মোদী নিরপেক্ষতার সব পথ পরিত্যাগ করে ভারতের পক্ষ স্পষ্ট করে দিয়েছেন।
ট্যুইটারে মোদী লিখেছেন, ‘এই কঠিন সময়ে ইজরায়েলের সঙ্গে আমাদের সলিডারিটি রয়েছে’। পাশপাশি হামাসের পদক্ষেপকে তিনি ‘সন্ত্রাসবাদী হামলা’ বলেন। বিদেশ মন্ত্রকের বিবৃতি জারি করার আগেই তিনি ট্যুইটে ভারতের অবস্থান জানিয়ে বলেন, ‘আমাদের ভাবনা এবং প্রার্থনা নির্দোষ ভিকটিম এবং তাদের পরিবারের সঙ্গে রয়েছে’।
প্যালেস্টাইনের সমর্থনে কংগ্রেসের অবস্থান
কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি (সিডব্লিউসি), ৯ অক্টোবর চার ঘন্টার দীর্ঘ আলোচনার পরে, সর্বসম্মতিতে ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন যুদ্ধে প্যালেস্টাইয়েন পক্ষ নেওয়ার কথা জানিয়েছে। প্রস্তাবটিতে সংঘর্ষের বিষয়ে নিজেদের ক্ষোভ প্রকাশ করে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছে তারা। পাশাপাশি প্যালেস্টিনীয় জনগণের অধিকারকে সমর্থন করেছে তাঁরা।
কংগ্রেস একটি ট্যুইটার পোস্টে জানিয়েছে, ‘ভারতের জাতীয় কংগ্রেস সর্বদা বিশ্বাস করে যে প্যালেস্টিনিয় জনগণের সম্মান, সমতা এবং মর্যাদাপূর্ণ জীবনের জন্য বৈধ আকাঙ্ক্ষাগুলি কেবলমাত্র আলোচনার মাধ্যমেই পূর্ণ করতে হবে কিন্তু ইসরায়েলি জনগণের বৈধ জাতীয় নিরাপত্তা স্বার্থও নিশ্চিত করতে হবে। যে কোনও ধরণের হিংসা কখনই সমাধান সূত্র দেয় না এবং অবশ্যই তাকে থামতে হবে’।
হামাসকে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন বলেনি ভারত: থারুর
যদিও এরপরেই কংগ্রেস সাংসদ শশী থারুরকে আসরে নেমে কংগ্রেসের অবস্থানের পক্ষে ব্যাট ধরতে হয়।
সোশ্যাল মিডিয়ায় কংগ্রেস সাংসদ শশী থারুরের হামাস সম্পর্কে বিবৃতি ঝড় তোলার পরে এমন একটি ধারণা তৈরি হয় যে থারুর হামাসকে একটি 'সন্ত্রাসবাদী' গোষ্ঠী বলছেন না। ভারতে ইসরায়েলের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত ড্যানিয়েল কারমন এই বিবৃতিটির নিন্দা করেন। কংগ্রেস এমপি স্পষ্ট করেন যে তিনি কেবল ভারতের সরকারী অবস্থানের কথা বলেছেন যে ভারত কখনই হামাসকে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসাবে মনোনীত করেনি।
থারুর বলেন, ‘আমি শুধু বলেছিলাম যে ভারত এমন একটি নির্দেশ জারি করেনি, যদিও অন্য দেশের সেই নির্দেশ আছে। নিঃসন্দেহে হামাস সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে, যার আমি সর্বাত্মক নিন্দা করেছি’।
আরও পড়ুন: Israel Palestine Conflict: হামাসের ধাক্কা, বিরোধীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে জরুরি সরকার গড়লেন নেতেনিয়াহু
ভারতের ইজরায়েল-বিরোধিতার ইতিহাস
ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে কখনও হামাসকে ‘সন্ত্রাসবাদী’ বলে অভিহিত করেনি। যদিও অতীতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কিছু প্যালেস্টিনীয় গোষ্ঠী বা ব্যক্তিদের সংঘটিত নির্দিষ্ট হিংসার নিন্দা করেছে। একই সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে যে ঐতিহাসিকভাবে ভারত সবসময় ইজরায়েলকেও সমর্থন করেনি। কিন্তু ইজরায়েলের সঙ্গে ভারতের সখ্যও হথাৎ হয়নি। গত বেশ কিছু দশক ধরে ধীরে ধীরে ইজরায়েলের সঙ্গে বন্ধুত্ব বৃদ্ধি করেছে তারা।
ভারত ইজরায়েলের সৃষ্টির বিরোধিতা করেছে এবং ১৯৪৮ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে বাস্তুচ্যুত প্যালেস্টিনীয় শরণার্থীদের অধিকারকে সমর্থন করেছে। ১৯৯২ সাল পর্যন্ত ইজরায়েলের সঙ্গে পূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিলনা ভারতের। ১৯৫৬ সালের সুয়েজ সংকটের সময় ভারত দৃঢ়ভাবে মিশরের পাশে ছিল।
১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধের সময়, ভারত শত্রুতা নিয়ে তার ‘গভীর উদ্বেগ’ প্রকাশকরে এবং প্যালেস্টিনীয়দের ‘বৈধ অধিকার’ সমর্থন করেছিল। ১৯৭৩ সালের ইয়োম কিপ্পুর যুদ্ধে, ভারত হিংসার নিন্দা করেছিল এবং ইজরায়েলের ‘সম্প্রসারণমূলক নীতি’-র নিন্দা করেছিল।
এছাড়াও, ২০০৬ সালের লেবানন যুদ্ধে, ভারত ইসরায়েলকে ‘তার অসামঞ্জস্যপূর্ণ বলপ্রয়োগ’ বন্ধ করার আহ্বান জানায়। ২০১৪ গাজা যুদ্ধে, ভারত ইসরায়েল ও প্যালেস্টাইনের মধ্যে দুই-রাষ্ট্র সমাধানের ভিত্তিতে আলোচনার আহ্বান জানিয়েছিল এবং গাজায় ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডের তদন্তের জন্য রাষ্ট্রপুঞ্জের একটি প্রস্তাবকে সমর্থন করেছিল।
তবুও ‘বিবি’-কে সমর্থন মোদীর
বিজেপি বরাবরই মনে করে ভারত ও ইজরায়েল স্বাভাবিক বন্ধু। যদিও আগের দশকগুলিতে অ-বিজেপি সরকারগুলির যুক্তি ছিল যে ভারতকে তার নিজস্ব মুসলিম জনসংখ্যার কারণেই ইসলামিক দেশগুলির পাশে থাকতে হবে। পাশপাশি এটাও গুরুত্বপূর্ণ যে ভারত এবং ইজরায়েল দুই দেশই মনে করে যে তারা এমন মিত্র যারা সম্ভাব্য শত্রু দ্বারা বেষ্টিত একটি এলাকায় রয়েছে।
প্রতি বছর পরিসংখ্যান বদলে যায় তবে ২০১৭ সালে ইজরায়েল ছিল ভারতের বৃহত্তম অস্ত্র সরবরাহকারী। সেইসময় থেকেই ইজরায়েল ভারতের অন্যতম শীর্ষ রফতানিকারকদের মধ্যে রয়েছে। ভারত চারটি ইজরায়েলের তৈরি হেরন মার্ক-২ ইউএভি লিজ নিয়েছে। এগুলি এখন ভারতের সীমান্তে টহল দিচ্ছে। এই ইউএভিগুলি প্রয়োজনে অস্ত্রও বহন করতে পারে।
অনুপ্রবেশ পরীক্ষা করার জন্য ব্যবহৃত অন্যান্য ইসরায়েলি সরঞ্জামগুলির মধ্যে রয়েছে হ্যান্ডহেল্ড থার্মাল ইমেজিং ডিভাইস এবং নাইট ভিশন সরঞ্জাম। এছাড়াও, একটি ইসরায়েলি কোম্পানি, এলবিট সিস্টেম, আর্টিলারি বন্দুক, গাইডেড যুদ্ধাস্ত্র এবং মর্টার সিস্টেম তৈরি করতে পুনের ভারত ফোর্জের সঙ্গে চুক্তি করেছে। ভারত ও ইজরায়েল বারাক-৮ এয়ার অ্যান্ড মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেমও তৈরি করেছে।
অন্যদিকে নয়াদিল্লি দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করলে অনেকেই মনে করেন যে, ভারত ইজরায়েলের থেকে পেগাসাস স্পাই সফ্টওয়্যার কিনেছে।
বদলে যাওয়া কূটনীতি
সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ভারতের কূটনৈতিক অবস্থান উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। ভারত এখন বিশ্বাস করে যে দেশের প্রধান শত্রু কেবল পাকিস্তান নয় অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী চিনও। এর সঙ্গে ভারতের ৩০০০ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। ফলত ভারত তার ঐতিহাসিক রাশিয়া-নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আশার চেষ্টা করছে।
একই সঙ্গে গত ২৫ বছরে পৃথিবীর অবস্থানও অনেকটা বদলেছে। প্যালস্টাইনের দাবি যুক্তিসংগত হলেও বহু আরব দেশও প্যালেস্টাইনের প্রতি বিভিন্ন কারণে তাঁদের সমর্থন তুলে নিয়েছে।
(দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির টাটকা খবর, আপডেট এবং ভিডিয়ো পেতে ডাউনলোড-লাইক-ফলো-সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের App, Facebook, Whatsapp Channel, X (Twitter), Youtube, Instagram পেজ-চ্যানেল)