অনির্বাণ সিনহা

 

পরপর দু'দিন, দু'টি সাক্ষাৎকার। প্রথমদিন মার্কিন সংবাদসংস্থা সিএনএন-কে। পর দিন ব্রিটিশ সংস্থা বিবিসিকে। এই দু'টি সাক্ষাৎকারে তিনটি বোমা ফাটিয়েছেন পাকিস্তানের বিদেশমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কুরেশি।

 

সিএনএনকে দেওয়া সাক্ষাতকারে কুরেশি জানান, পুলওয়ামায় সন্ত্রাসবাদী হামলার মূলচক্রী বলে অভিযুক্ত মাসুদ আজহার পাকিস্তানেই আছে এবং সে বেশ অসুস্থ। এতটাই যে, বাড়ি থেকে বেরনোর ক্ষমতা নেই তাঁর।

 


বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাতকারে কুরেশির দ্বিতীয় বোমা, মওলানা মাসুদ আজহার ও জইশ-এ-মহম্মদের  নেতাদের সঙ্গে কথা হয়েছে তাঁর। সরাসরি না হলেও, পাক বিদেশমন্ত্রকের আধিকারিকদের মাধ্যমে। কুরেশির প্রথম ও দ্বিতীয় স্বীকারোক্তিতে প্রমাণিত, জইশ-এ-মহম্মদ ও তার প্রধান মওলানা মাসুদ আজহার পাকিস্তানের মাটি থেকে শুধু সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপই চালায় না, পাক সরকারের দায়িত্বশীল আধিকারিকদের সঙ্গে তাদের নিয়মিত ও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে। এতটাই ঘনিষ্ঠ সে যোগ যে, ভিভিআইপি-র মতোই মোস্ট ওয়ান্টেড জঙ্গি নেতার শরীর-স্বাস্থ্যের নিয়মিত এবং খুঁটিনাটি খোঁজ-খবর থাকে পাক বিদেশমন্ত্রী ও প্রশাসনের কাছে। তৃতীয় স্বীকারোক্তি আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছে একটি পুরনো প্রবাদ। মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি। পুলওয়ামার ঘটনার পরেই তার দায় স্বীকার করেছিল জইশ-এ-মহম্মদ। অথচ কুরেশির দাবি, জইশ-এ-মহম্মদ এই হামলা চালায়নি। 

 


 

এর আগেও পাক বিদেশমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন শাহ মাহমুদ কুরেশি। তাঁর পুরনো ট্র্যাক রেকর্ড দেখলে সহজেই চোখে পড়বে মিথ্যাভাষণে পাক বিদেশমন্ত্রীর জুড়ি মেলা ভার। ২৬/১১ মুম্বই জঙ্গি হামলায় হাফিজ সইদের পরিকল্পনা, সক্রিয় যোগ ও দায় নিয়ে ভারত কেন, বিশ্বের প্রায় কোনও দেশেরই কোনও সংশয় ছিল না। শুধু তাই নয়, ইজরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা আইডিএফ, মোসাদ এবং মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-র কোনও সন্দেহ ছিল না যে করাচির কন্ট্রোল রুমে বসে হাফিজ সইদ-ই মুম্বই হামলা পরিচলনা করে। ২৯ নভেম্বর, ২০০৮-এ মুম্বই হামলার ঠিক তিন দিন পর বিবিসি-র মুখোমুখি হন পাকিস্তানের তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কুরেশি। সেই সাক্ষাৎকারে বিশ্বকে হতবাক করে কুরেশি বলেছিলেন, মুম্বই হামলার সঙ্গে পাকিস্তানের কোনও যোগ নেই। পাকিস্তানের মাটি সে কাজে ব্যবহার হয়নি।

 

২০০৯-এর ১ ডিসেম্বর, বিবিসি-কে আরও একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন এই শাহ মাহমুদ কুরেশি-ই। সেবার বিষয় ছিল, ওসামা বিন লাদেনের খোঁজ। ২৫ লক্ষ মার্কিন ডলার যার মাথার দাম, সেই লাদেন কি আসলে পাকিস্তানেই লুকিয়ে আছে? প্রশ্নকর্তাকে ভাবলেশহীন মুখে কুরেশির জবাব ছিল, পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বের পক্ষে লাদেনের তুলনায় অনেক বড় বিপদ মার্কিন ড্রোন। কুরেশির দাবি ছিল, পাকিস্তান না কি ততদিনে ৬০০ আল কায়েদা জঙ্গিকে মেরেছে। লাদেন পাকিস্তানে থাকলে এতদিনে মারা পড়তো। এই সাক্ষাৎকারের প্রায় দেড় বছরের মাথায় পাকিস্তানের মাটিতে ঢুকে লাদেনকে নিকেশ করে মার্কিন নেভি সিল কমান্ডোদের বিশেষ দল। ক্রমশ প্রকাশ্যে আসে পাক মাটিতে লাদেনের নিশ্চিন্ত বসতের ইতিবৃত্ত। ২০০৬ থেকে অ্যাবোটাবাদের মাটিতে লাদেনের বাস। আইএসআই, পাক সেনা এবং অবশ্যই, পাক সরকারের প্রত্যক্ষ মদত ও প্রশ্রয়ে। অথচ, সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার নামে সেই ৯/১১-র হামলার পর থেকেই  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে হাজার হাজার কোটি ডলার অনুদান নিয়ে গেছে পাকিস্তান। 

 


 

৯৪৭ সালের ১৪ অগাস্ট সেই স্বাধীনতার মুহূর্ত থেকে ট্রাম্প পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছিল পাকিস্তানের সময়-অসময়ের নিশ্চিত বন্ধু। জঙ্গি পোষার জল্য সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সঙ্গেও বছরের পর বছর দ্বিচারিতা ও বিশ্বাসঘাতকতা করতে এতটুকু আটকায়নি পাকিস্তানের। পাকিস্তানের মাটিতে লাদেনের খোঁজ মেলা ও তাকে নিকেশের পর থেকেই ইমরান খানের দেশের প্রতি বিশ্বাস কমতে থাকে  হোয়াইট হাউজের। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে ও চিনের দিকে পুরোপুরি ঠেলে দেওয়া আটকাতে এখনও পাকিস্তান নির্ভরতা সম্পূর্ণ ছেড়ে দেওয়া সম্ভব নয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে। কিন্তু, সন্ত্রাসবাদ প্রশ্নে পাকিস্তানের স্বরূপ ইতিমধ্যেই তাদের কাছে স্পষ্ট। লাদেন পর্বে একেবারে কোণঠাসা হয়ে পড়ার সময়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তানের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত হুসেন হাক্কানি কথা দিয়েছিলেন, এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত হবে। সেই তদন্তের রিপোর্ট আজও দিনের আলো দেখেনি। 

 

পাকিস্তানকে দেওয়া ডোসিয়ার, ডিমার্সে-এসবই তাই আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক নিয়ম-কানুনের পালন মাত্র। গীতার বাণীর মতোই এখানে ফলের প্রত্য়াশা না করাই বুদ্ধিমানের কাজ। কূটনীতিক চাপ, বিশেষত এই মুহূর্তে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চাপ বজায় রেখে পাকিস্তানকে কিছু জাগতিক সমস্যায় ফেলা যেতেই পারে। কিন্তু, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠীর দার-উল-ইসলামের স্বপ্ন পূরণের মহাজাগতিক দায় যে রাষ্ট্র স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নিয়েছে তাদের জন্য প্রথা বহির্ভূত কোনও পথেই ভারতের সমস্যার সমাধান হতে পারে।