'তিস্তা' একটি লড়াইয়ের নাম
সুদেষ্ণা পাল
তির গতিতে বয়ে চলা খরস্রোতা একটি নদী। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে গতির আপন ছন্দে সে বয়ে চলে। বাঁক খুঁজে নেয় তিস্তা। তিস্তা লড়াই করে, বয়ে চলার লড়াই। বেঁচে থাকার লড়াই। নিজের মত করে বাঁচার লড়াই। আত্মমুক্তির লড়াই। অধিকারের লড়াই। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে তীব্র বেগে বয়ে চলা সেই নদীটার সঙ্গে কখন যেন মিলে যায় তাঁর নিজের জীবনটা। তিস্তা নিজেকে খুঁজে পায় দশভুজার মৃণ্ময়ী রূপের মধ্যে। তিস্তা বলে, "এই সমাজে একটা মেয়েকেই কত লড়াই লড়তে হয়। আর সেখানে আমার মত মেয়ে....? লড়াইটা আরও কঠিন। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমারও বোধহয় অদৃশ্য দশটা হাত রয়েছে। সেই হাতগুলোও আমাকে শক্তি যোগায়। লড়াই করার। নিজের মত করে বাঁচার।"
তিস্তা, 'নারীত্ব'কে অর্জন করা এক নারী। প্রথম যখন লড়াইটা শুরু করেছিলেন, তখন কেউই সেভাবে পাশে ছিলেন না। অনেকেই ভেবেছিলেন, বিকৃতি বুঝি! তিস্তা অবশ্য বলে, "না, আমি কাউকে দোষ দিই না। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ তো! একটা মেয়েই যেখানে কোনও স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। সেখানে আমি তো....ছেলে থেকে মেয়ে হতে চেয়েছি।" তথাকথিত ভদ্র সমাজের গোঁড়ামি, রক্ষণশীলতার মূলে আঘাত হেনেছিলেন তিস্তা। নিজে যা বিশ্বাস করেন, সেটাই হতে চেয়েছিলেন। একজন পুরুষের শরীরে খাঁচাবন্দি নারী অস্তিত্ব নয়। মুক্তি দিতে চেয়েছিলেন তাঁর নারীসত্তাকে। তিস্তা বলছিলেন, "নিজেকে মাঝে মাঝে বেহুলার সঙ্গে আইডেন্টিফাই করতাম। আমার শরীরটাই যেন ছিল একটা শবদেহ। আর সেই শবদেহ নিয়ে আমি কোথায় যাব জানি না।"
বাড়ির লোককে তাঁর জন্য বিড়ম্বনার শিকার হতে হচ্ছিল। বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন অন্যত্র। অতীতে হারিয়ে যেতে যেতে তিস্তা বলেন, "অপারেশন নিয়ে তত্কালীন বাম সরকারে প্রশাসনের দরজায় বার বার ঘুরেছি। চূড়ান্ত হয়রান করা হয়েছে। ভুল বোঝানো হয়েছে। একটা সময় তো বাঁচার আশাটাই ছেড়ে দিয়েছিলাম। এমনকী কোনও অভিযোগে পাশে পাইনি রাজ্য মানবাধিকার কমিশনকেও।"
তবে সেই পরিস্থিতি যে এখনও বদলেছে এমনটা নয়। "বছর আড়াই আগে যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনের সভায় স্থির হয় ট্রান্সজেন্ডারদের জন্য সরকারের তরফে সদর্থক কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হবে। অথবা কোনও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে সেই দায়িত্ব দেওয়া হবে। কিন্তু বছরের চাকা ঘুরে গেলেও পরিস্থিতি এখনও যে তিমিরে সেই তিমিরেই। সরকার একটা ট্রান্সজেন্ডার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড গঠন করেছে, ঠিকই। কিন্তু সেই বোর্ডের কাজকর্ম কী হচ্ছে, ভবিষ্যতে কী করা হবে, তা নিয়ে স্পষ্ট কোনও দিশা নেই। মিটিংয়েও ডাকা হয় না," আক্ষেপ ঝরে পড়ে তিস্তার গলায়। "সত্যিই কি সরকার তাঁদের জন্য কিছু করতে চায়?" প্রশ্ন তোলেন তিস্তা। "রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী একজন মহিলা। কিন্তু তিনিও কেন এব্যাপারে এতটা চুপ....?" উত্তরটা হাতড়ে বেড়ান তিস্তা।
কথায় কথায় জানালেন, 'মানবীদি' যেদিন প্রিন্সিপ্যাল হলেন, সেদিন খুব আনন্দ হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানকালে রূপান্তরকামীরা 'বড় অধৈর্য্য' বলেও মনে হয় তাঁর। বললেন, "আজকের দিনে রূপান্তরকামীদের আন্দোলন অনেকটাই গতি পেয়েছে। কিন্তু তাও যেন তাঁরা সব একবারে পেতে চান। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।"
নারী হয়ে ওঠার পর তিস্তার শুরু হয় এক নতুন লড়াই। সমাজে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার লড়াই। সেই লড়াইতেও সফল হয়েছেন তিনি। অভিনয়ে সফল কেরিয়ার গড়েছেন। তাঁর অভিনীত ছবি প্রশংসা কুড়িয়েছে বিভিন্ন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে। অভিনেত্রী হিসেবে পেয়েছেন সুনাম, সমাদর। এই মুহূর্তে কলকাতা ও ঢাকা, দুজায়গায় দুটো বিগ ব্যানারের ছবির সঙ্গে কথা চলছে। শুধু কি তাই?
নিজের অস্তিত্ব, নিজের অপারেশন নিয়ে বহু বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। আর সেখান থেকেই তিস্তার মনে হয়েছিল, তাঁর উত্তরসূরিদের জন্য এবার কিছু একটা করতে হবে। সেই ভাবনা থেকেই রূপ পায়, এস আর এস সলিউশনস কলকাতা। চার বছর পেরিয়েছে সেই সংস্থা। এই চার বছরে ১০টা সফল অস্ত্রোপচারও হয়েছে। কিন্তু সবটাই বেসরকারি উদ্যোগে বেসরকারি নার্সিংহোমে। সরকারি সাহায্য? মুচকি হেসে তিস্তা উত্তর দিলেন, "না।" দশভুজার মত একা হাতেই সব সামলাচ্ছেন। কাউন্সেলিং থেকে ডাক্তারদের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট স্থির। তিস্তার কথায়, "সার্জারিটা যেন ঠিক অসুর বধ করে দেবী জন্মের মত।"
তিস্তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, "প্রেম, সম্পর্ক, বিয়ে, সংসার?" মুচকি হেসে তিস্তার উত্তরটা যেন 'এলিজিবল ব্যাচেলর'দের গালে সপাটে এক চড়! "আমার যোগ্যতাকে সম্মান দেওয়ার মত পুরুষ এই ভারতে নেই। একটা খারাপ সংসারে থাকতে চাই না। সঙ্গী না পাওয়া কষ্টের। কিন্তু যখন দেখি, সঙ্গী হিসেবে যাকে বিশ্বাস করলাম, সে আদপে সঙ্গী-ই নয়। তখন সেটা আরও বেশি কষ্টের। আমার জীবনে একাধিক সম্পর্ক এসেছে। লিভ-ইনও করেছি। কিন্তু সব সম্পর্ক যেন শুধু ওই শরীরকেই খোঁজে। ভেতরের মেয়েটাকে কজন বোঝে বলতো? বিয়ের জন্য লড়াই ছাড়তে বলেছিল। বলেছিল, আমি যে 'হয়ে ওঠা মেয়ে', সেটা বলা যাবে না। পারব না। আমার শরীর। আমার মন। আমার সিদ্ধান্ত। শত কোটি টাকার বিনিময়েও আমি আমার এই লড়াই ছাড়তে পারব না।"
তিস্তার ভালো থাকার জন্য তাই কোনও পুরুষসঙ্গীর দরকার পড়ে না। বায়োলজিক্যালি 'মা' হওয়া তিস্তার পক্ষে সম্ভব নয়। তিস্তা ভালো থাকে ওদের 'মা' হয়ে। রাস্তায় হুঁশ করে বেড়িয়ে যাওয়া গাড়িটা যখন ওদের ধাক্কা মেরে চলে যায়, পিছনে ফিরেও তাকায় না। তিস্তা তখন ওদের কোলে তুলে নেয়। পরম মমতায় শুশ্রূষায় সারিয়ে তোলে বড় আদরের ওর এই 'ছেলে-মেয়ে'দের....। কথা বলতে বলতে কখন যেন ঘড়ির কাঁটা ঘুরে যায়। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। তিস্তা ব্যস্ত হয়ে ওঠে। বাড়ি গিয়ে ছেলে-মেয়েদের সন্ধ্যার 'টিফিন'টা দিতে হবে যে। 'মা'-এর অপেক্ষায় ওরা বসে রয়েছে। 'মা' না খাইয়ে দিলে যে ওরা খায় না। তিস্তা হাঁটা শুরু করে...