'আমার' ভাইয়ের রক্তে রাঙানো 'নয়' একুশে ফেব্রুয়ারি

তখনই মনে হয়, ভাষা-আন্দোলন শুধুই কি বাংলা ভাষার জন্য কতগুলি মানুষের আত্মবলিদান? নিজেরও মাতৃভাষা বাংলা বলেই কি আবেগমথিত হয়ে প্রতিবারের মতো ভাষা-পুজোয় ভেসে যাব? আরও একবার? ভুলে যাব, এই ভাষা-আন্দোলন থেকেই একটা দেশ তার প্রতিবাদের ভাষা খুঁজে পেয়েছিল, পেয়েছিল স্বাধীনতার সন্ধান? উনিশশো বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি কি সেই ক্ষমতার ভাষা, ডেঞ্জারাস ডিসকোর্সের বিরুদ্ধেও আন্দোলনও নয়? নিছক বর্ণমালার স্বাধীনতা পেরিয়ে মুক্তচিন্তা আর অবাধ গতিবিধির জন্যেও আন্দোলন নয়?

Updated By: Feb 20, 2012, 05:42 PM IST

এই লেখার সঙ্গে ভাষা দিবসের কোনও যোগাযোগ নেই। থাকার কথাও নয়। যে কোনও সময়েই হয়তো লেখা যেতে পারত। কিন্তু ভাষা দিবসের ক'দিন আগে একটি মন্তব্য উসকে দিল ভাবনা।

সম্প্রতি পার্ক স্ট্রিটে এক মহিলার ধর্ষণের ঘটনার পর রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান বলেছিলেন, বিষয়টি নিয়ে সংবাদমাধ্যম বাড়াবাড়ি করছে। তেমন কোনও ঘটনা নয়। প্রশ্ন উঠে পড়েছিল মহিলার চাল-চরিত্র নিয়ে।

সঙ্গে সঙ্গে ভাবনা পিছিয়ে গেল আরও দিন কয়েক আগে। রায়গঞ্জের একটি কলেজে শাসকদলের ছাত্র সংগঠনের হেনস্থার শিকার হয়েছিলেন অধ্যক্ষ। তেমনটাইঅভিযোগ ছিল। সেদিনও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, তেমন কোনও ঘটনা নয়। ছোটছোট ছেলেদের কাণ্ড নিয়ে সংবাদমাধ্যমই বাড়াবাড়ি করছে।

রাজ্যে উপর্যুপরি কৃষক মৃত্যুর ঘটনা। দেনার দায়ে, খেতে না পেয়ে হতাশা-গ্লানি-অসীম রিক্ততায় আত্মহত্যাই একমাত্র পথ মনে হয়েছে রাজ্যের বহু কৃষকের। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, এক-আধজন ছাড়া কেউই নাকি কৃষক নয়।

তিনটি ঘটনায়, তিনটি মন্তব্য। আচমকা আমরা এক নতুন প্রশাসনিক বয়ানের, ডিসকোর্সের মুখোমুখি হয়ে যাই। যে বিচার ব্যবস্থা, তদন্ত-পদ্ধতি এই পুঁজিবাদী ধনতন্ত্রের প্রধান ভিত, সেই মাধ্যমের উপরে ভরসা না রেখেই আচমকা রাজ্য প্রশাসনের সর্বময়কর্তা (যিনি নিজেও এই ধনতন্ত্রেরই ফসল)-র নিদান হেঁকে দেওয়ার প্রবণতা স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে। তাতে দলতন্ত্র প্রাধান্য পেল, না পেল না, মানুষের মুখে দুমুঠো খাবার উঠল, না উঠল না, মানুষের জীবনে শান্তি আছে, না গিয়েছে, তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। কিন্তু প্রায় সামান্য তথ্যের ভিত্তিতে যে ভাবে মুখ্যমন্ত্রী একের পর এক সিদ্ধান্তে পৌঁছে যান এবং কাঠগড়ায় তুলে দেন 'বিরোধী স্বর'কে তার দুরকম অর্থ হতে পারে: 'কথা বলবেন না', (যদি বলেন তবে) পক্ষে বলুন। অর্থাত্‍‍, সাদা-কালোর মতো স্পষ্ট বিভাজনের এক পরিস্থিতি তুলে ধরতে চান তিনি। তাই মন্ত্রিসভা এবং দলীয় সদস্য-অনুগতরা যে ভাবে নেত্রীর বৈজয়ন্তী উড়িয়ে দিতে চান, সাধারণ মানুষের কাছেও তাঁর সেটাই প্রত্যাশা।

চৌত্রিশ বছরের 'অপশাসনের' পর 'সুস্থ' রাজনীতির লক্ষ্যে মানুষ পরিবর্তন এনেছেন। কেন্দ্রে এবং রাজ্যে সেই গণ-সমর্থনই মুখ্যমন্ত্রীর প্রধান অস্ত্র। তাঁর ক্ষমতার পরিভাষা। 'সুস্থতাকামী' সেই সমর্থন কখন যেন ক্ষমতার ভাষা, প্রায় একনায়কের বাচনে পরিণত হয়ে গিয়েছে। তিনি রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে আগ বাড়িয়ে মানুষের কাছে পৌঁছে যান। সেলিব্রিটিদের হাত ধরে, কাঁধ ধরে হাসি মুখে অভ্যর্থনা করেন। দেখে অনেকেই হয়তো আপ্লুত হয়ে যান। মনে হয় কাছের মানুষ। কিন্তু সেই কাছাকাছি পৌঁছনোর বার্তায় মিশে থাকে 'সবকিছু' নিয়ন্ত্রণ করার বার্তা। দাপটের ভাষা। অবিশ্বাসের কথা। সভা-পারিষদদের সর্বসমক্ষে ধমক, তাঁদের পাল্টা স্তুতি-বন্দনায় সেই ক্ষমতা এবং ক্ষমতার দাসত্ব করার ছবিটা পরিষ্কার।

তখনই মনে হয়, ভাষা-আন্দোলন শুধুই কি বাংলা ভাষার জন্য কতগুলি মানুষের আত্মবলিদান? নিজেরও মাতৃভাষা বাংলা বলেই কি আবেগমথিত হয়ে প্রতিবারের মতো ভাষা-পুজোয় ভেসে যাব? আরও একবার? ভুলে যাব, এই ভাষা-আন্দোলন থেকেই একটা দেশ তার প্রতিবাদের ভাষা খুঁজে পেয়েছিল, পেয়েছিল স্বাধীনতার সন্ধান? উনিশশো বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি কি সেই ক্ষমতার ভাষা, ডেঞ্জারাস ডিসকোর্সের বিরুদ্ধেও আন্দোলনও নয়? নিছক বর্ণমালার স্বাধীনতা পেরিয়ে মুক্তচিন্তা আর অবাধ গতিবিধির জন্যেও আন্দোলন নয়?

সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারকে দূরের মানুষ মনে হয়।

মনুজেন্দ্র কুনডু

Tags:
.