এতদিন কোথায় ছিলেন

জ্ঞান হওয়া ইস্তক সেই রূপকথার বন্দিনী আমাকে বলতেন, ইংরেজি পড়। জীবনের দরজা খুলে যাবে। আমার মতো ভাত রান্না করতে হবে না। ছোটহাতের বি-কে উল্টে দিলে ডি হয়, এন হল ডিগবাজি খাওয়া ইউ। নিজে হাতে শিখিয়েছিলেন। কাঁচের আলমারির রংবেরং-এর ইয়ামোটা বইগুলো পড়তে পারার লোভ দেখিয়ে নির্ভুল বানান লেখাতেন ধৈর্য ধরে। স্টিভ জোবস কে জানার অনেক আগেই, অ্যাপল বানানে কটা পি লাগে, ঠিক জেনেছিলাম তাঁরই কাছে।

Updated By: Oct 9, 2012, 09:37 PM IST

শর্মিলা মাইতি
রেটিং- ****1/2
জ্ঞান হওয়া ইস্তক সেই রূপকথার বন্দিনী আমাকে বলতেন, ইংরেজি পড়। জীবনের দরজা খুলে যাবে। আমার মতো ভাত রান্না করতে হবে না। ছোটহাতের বি-কে উল্টে দিলে ডি হয়, এন হল ডিগবাজি খাওয়া ইউ। নিজে হাতে শিখিয়েছিলেন। কাঁচের আলমারির রংবেরং-এর ইয়ামোটা বইগুলো পড়তে পারার লোভ দেখিয়ে নির্ভুল বানান লেখাতেন ধৈর্য ধরে। স্টিভ জোবস কে জানার অনেক আগেই, অ্যাপল বানানে কটা পি লাগে, ঠিক জেনেছিলাম তাঁরই কাছে। ।।। তারপর কখন রেডিয়ান্ট রিডারের লক্ষ্মণরেখা পার হয়ে, বন্দিনীর আঙুলের মুঠি ছাড়িয়ে, তাঁকে অনেক পিছনে ফেলে ফিনিশ লাইন ছুঁয়ে ফেললাম। আলমারির ইংরেজি বই টেনে আগাপাশতলা পড়া হয়ে গেল। সাহেবি ঢং-এ ইংরেজি বলে হাইহিল পরার ছাড়পত্র মিলে গেল। পিছন ফিরেও দেখিনি আমার রূপকথার রানি কোন দাগে আটকে রইলেন। স্বপ্নের সব রূপ-রস-নির্যাস আমাকে দিয়ে, আমার জীবনের দরজাটা খুলে দিয়ে, এখনও তিনি ধূমায়িত রান্নাঘরে প্রতিদিনের জীবন অনুশীলন করেন। করেই চলেন।
এক কথায়, ইংলিশ ভিংলিশ সেই সব রূপকথার বন্দিনীকে আবার সিংহাসনে বসাল। সেই মায়েরা, যাদের জীবনে বলার কিছুই নেই, তাঁদের গল্পই বললেন পরিচালক গৌরী শিন্ডে এবং শ্রীদেবী। একই সঙ্গে পরিচালক আর নায়িকার নাম বললাম। শ্রীদেবী, কামব্যাক হো তো অ্যায়সি! বিস্ময়বোধক শব্দ অভিধানে বড় কম। প্রত্যেক ফ্রেমে এই হিম্মতওয়ালি যেভাবে ‘চরিত্র’ হয়ে উঠলেন, না দেখলে কল্পনা করা অসম্ভব। এক সেকেন্ডও চোখ সরালে মিস করবেন তাঁর অভিব্যক্তির অনুপুঙ্খ। ছবিতে ছেলের মনোরঞ্জনের জন্য মাইকেল জ্যাকসন-এর নাচ (যার আয়ু মোটে ছ সেকেন্ড) ছাড়া শ্রীদেবীর নাচ দেখতে পাবেন না। তাতে কী! যা দেখতে পাবেন, তাতেই বলবেনই, এত দিন কোথায় ছিলেন, শ্রীদেবী!

সব ‘সরস্বতী বিদ্যালয়ে’ পড়া, ইংরেজি-না-জানা ‘অসহায়’ মায়েদের সম্মিলিত চরিত্রর ঠাসবুননে তৈরি এক চরিত্রে, একা অভিনয় করে দেখালেন শ্রীদেবী। সংসারে থেকেও যাঁরা প্রায় অদৃশ্য। যাঁদের মধুমালতী হাতের ছোঁয়ায় সুস্বাদু হয় ঘরের খাবার, একটা জানলা-দরজাহীন চৌখুপির মধ্যেই যাঁদের রাতদিনের শ্রম, তাদেরই গল্প। শ্রীদেবীর চরিত্র শশী সকালের কাগজে বাইরের বিশ্বটুকু জানতে শুরু করলেই যাঁর স্বামী ডেকে ওঠেন, চা চাই। ছেলের স্কুল, মেয়ের ক্লাসের স্ক্র্যাপবুক, মনের মতো খাবার, প্রাণান্ত পরিশ্রম আর অঢেল মমতা দিয়েও যে তার অক্ষমতাকে ঢাকা দিতে পারে না। তুচ্ছ হয়ে যায় ইংরেজি জানা মেয়ে ও স্বামীর কাছে। একটি ভাষা জানা-না-জানার মধ্যে দিয়েই একটি সংসারের মধ্যেও কেমন ক্ষমতার আসনগুলো ওলটপালট হয়ে যায়।।। এই শশীই অসাধারণ লাড্ডু বানায়। বাড়ি বাড়ি হোম ডেলিভারি দিয়ে খুঁজে নেয় মুক্তির স্বাদ। আয়রন চেস্টে জমিয়ে রাখে সঞ্চয়। সেখানেও স্বামীর তাচ্ছিল্য। তোমার কি এটা না করলেই নয়। লাড্ডু বানানোর জন্যই কি তোমার জন্ম হয়েছে?
তাক লাগালেন পরিচালক। কোনও গল্প ছাড়াই আড়াই ঘন্টা সম্মোহিত করে রাখলেন দর্শককে। অথবা শুধুই দর্শকের সঙ্গে ট্রিকস খেলে চললেন? চার দেওয়ালের ভেতরের গল্পটা টেনে বের করে নিয়ে এলেন প্রথম বিশ্বে। নিউ ইয়র্কবাসী দিদির বড় মেয়ের বিয়ে, জোগাড়যন্ত্র করতে যেতে হবে তো! এক্ষেত্রে সাধারণত যা হয়, প্রায় পরিচারিকার সম্মান দিয়েই পাঠানো হয় একলা শশীকে। এবেলা তার ইংরেজি-না-জানার জোর খাটে না, স্বামী সংসার ছেড়ে একলা পাড়ি দিতে হয়, ইংরেজি-না-জানা গৃহবধূ বনাম ইংরেজি-সর্বস্ব নিউ ইয়র্ক। কেমন করে ‘সামনা’ করবে সে? এক কাপ কফি আর স্যান্ডউইচ কিনতে গিয়েই যেন সুনামির মুখোমুখি হয় শশী। এই অক্ষমতার হাতকড়া থেকে মুক্তির তাগিদ থেকেই একদিন ‘চুপিচুপি’ ফোন স্পোকেন ইংলিশ ক্লাসের স্কুলে। লজ্জার ঘোমটা খুলে। সারা জীবনের সিংহভাগ সঞ্চয় চারশ ডলারে ভাঙিয়ে নিয়ে ‘চুপিচুপি’ চার হপ্তার ক্লাশ শুরু করে দিলেন। চার দেওয়াল গণ্ডি থেকে ‘চুপিচুপি’ তিরের বেগে বেরিয়ে বিশ্বসংসারে শ্বাস নেওয়া। ভিংলিশ-এর গণ্ডি পেরিয়ে ইংলিশে উত্তরণ। এই ‘চুপিচুপি’-র বিশ্বে সঙ্গ দিল শশীর আমেরিকাবাসী বোনঝি।

ইংলিশ ক্লাশটা নিয়ে দুচারটে কথা বলি। এটাও একটা ভিংলিশ-এর মিনি-বিশ্ব। স্প্যানিশ, ফ্রেঞ্চ, চাইনিজ, ওয়েস্ট-ইন্ডিয়ান, পাকিস্তানি আর ভারতীয় ছাত্র পড়তে আসে এখানে। ইংরেজিতে কথা বলতে পারলে স্প্যানিশ গভর্নেস তার মালকিনের ছেলেকে স্প্যানিশ শিখে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে পারবে। দক্ষিণভারতীয় আইটি স্পেশালিস্ট তার সহকর্মীদের উচিত শিক্ষা দিতে পারবে। পাকিস্তানি ড্রাইভার আমেরিকান বান্ধবী পাবে। ইংরেজি শেখার তাগিদ যাদের আলাদা আলাদা। তবু ইংরেজি না-বলেও একজন ফ্রেঞ্চ নির্দ্বিধায় মনের কথা বোঝাতে পারে এক মারাঠি গৃহবধূকে। সত্যি, চমত্কার স্ক্রিপ্টের ব্যবহার! চোখে আঙুল দিয়ে দেখালেন ইংরেজি ভাষার সারশূন্যতা। মেহদি নেবউ-এর অভিনয় মনে থাকবে অনেকদিন।
ক্লাইম্যাক্স শটের কথাও বলে রাখি একটু। বিয়েবাড়ির পার্টিতে টার্ন আসে শশীর, বিবাহিত দম্পতির উদ্দেশে কিছু বলার জন্য। ইংলিশ স্পিকিং কোর্স করার পর শশী নির্ভুল ইংরেজিতে কথা বলে না। কিন্তু মনের কথা প্রকাশ করতে পারে। নিজের ভেতরে গুমরে থাকা অভিমান উগরে দেয় না, বোধগম্য ভাষায় মোলায়েমভাবে নিজের উপলব্ধির কথা বলে। ক্র্যাশ কোর্সের লক্ষ্যই তাই। লজ্জায় কুঁকড়ে থাকা অভিব্যক্তির গিঁটগুলো খুলে দিয়ে ভাবপ্রকাশের রাস্তা করে দেওয়া। শশীর স্পিচে উঠে আসে একটাই আবেদন। বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রী ‘ইকোয়াল’। সংসারে কেউ কারওর ছোট নয়। পরিচালক যেভাবে নাটকীয় পরিস্থিতি সৃষ্টির প্রলোভন থেকে দূরে থাকলেন, তাতে আরও পরিষ্কার হল তাঁর গবেষণার পরিধিটাও।

এইখানে বলে নিই, ছবির নাম কেন ‘ইংলিশ-ভিংলিশ’। শুধু শ্রীদেবীর কল্যাণে নয়। প্লেনে সহযাত্রী হিসেবে অমিতাভ বচ্চনের সদর্প উপস্থিতিই এর কারণ। ঘাবড়াবেন না। তিনিই ছবিতে বলেছেন, ‘সময় এসেছে ইংরেজি ভাষাকে ভ্যাংচানোর! আর ভয় পেলে চলবে না।’ ছবিতে মিডাস টাচ এই বিগ বি-ই। পাশাপাশি শ্রীদেবী-অমিতাভ। অসাধারণ কমিক সিকোয়েন্স। এক শব্দে, ঐতিহাসিক!
এক নিঃশ্বাসে দেখার মতো ছবি। আধুনিক এবং প্রাচীনমনস্কদের সমানভাবে অবশ্যদ্রষ্টব্য। আর অবশ্যই, যদি এখনও খুব বেশি দূরে চলে গিয়ে না থাকেন, তাহলে ছবি দেখা শেষ করে সেই রূপকথার বন্দিনীকে একবার জড়িয়ে ধরুন। একটি ভাষা না-জানার অপরাধে, তাঁকে উপহার দেওয়া শ্লেষ আর অপমানগুলো ফিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ না-ই বা পেলেন!

.