একটি সোচ্চার কণ্ঠস্বর ও উদ্যত হাত

ছবির নাম: প্রলয় রেটিং: ***

Updated By: Aug 13, 2013, 09:59 PM IST

শর্মিলা মাইতি
ছবির নাম: প্রলয়
রেটিং: ***
চেন্নাই এক্সপ্রেস যেমনই চলুক, একবার উঠে পড়লে চেন নাই যে টেনে থামাবেন! সে যাই হোক, চেন্নাই এক্সপ্রেসে শাহ রুখ খান অবশ্য রাজ চক্রবর্তীর প্রলয় ছবিটার একটু প্রোমোশন করে দিয়েছেন। ডোন্ট আন্ডারএস্টিমেট দ্য পাওয়ার অফ কমন ম্যান! রাজের ছবি প্রলয়-এর অলিখিত ট্যাগলাইন এটাই।

শহর জুড়ে পোস্টার। নানা বয়সের অভিনেতা অভিনেত্রীরা তুলে ধরেছেন প্ল্যাকার্ড। বরুণ বিশ্বাস কে? যে পদবীটা ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে বাঙালির মেরুদন্ড থেকে। মজ্জাহীন ফাঁপা হয়ে যাচ্ছে যে রাজ্যের হাড়গোড়। শাসকের কাছে তারই এক কোণে সুঁটিয়া (ছবিতে দুখিয়া) গ্রামে প্রথম বিপ্লবের ফুলকি। যে-খবরটা মিডিয়া সবার কাছেই "খবর" হিসেবে পেশ করেছিল। নির্বিচার ধর্ষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল একটি কণ্ঠস্বর। তরুণ কণ্ঠ। যার নাম বরুণ বিশ্বাস। শাসকের পোষা গুণ্ডার হাতেই কণ্ঠরোধ হয়েছিল তার।
পরিচালক রাজ চক্রবর্তী এ যুগের সফলতম বাণিজ্যিক পরিচালক। যে ভাবনাটা তিনি দর্শকের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন, সেটা একটা সহজ সোজা পথে বলা জাগরণের মন্ত্র। জং-ধরা লোহার স্তুপের মধ্যে একটি তরোয়ালও যদি থাকে, সেটাকেই উঁচিয়ে ধরে প্রতিবাদ করতে হবে। পরিবর্তন শুধু সরকারের গদিতে এলেই হবে না। আনতে হবে মানুষের মনেও। সোজা করতে হবে শিরদাঁড়া।

ধর্ষণের দৃশ্য দিয়ে শুরু। গুন্ডারাজ। নারীর চিত্কার। থানায় গেলে নির্বিকার পুলিশের জবাব। ওটা আমাদের এরিয়ায় পড়ে না। অন্য থানায় গেলেও মেলে একই উত্তর। ধর্ষিতা নারীরা স্থান পায় না হাসপাতালেও। পঞ্চায়েতের চিঠি লাগে সেখানে। যেসব কথা লিখছি, সেগুলো সিনেমার দৃশ্য বটে, তবু নির্মম বাস্তব। বরুণ বিশ্বাসের পর আরও অনেক বাস্তব উদাহরণ পেয়েছি খবরের পাতাতেই। কিন্তু সে সবই মৃত মুখের সারি। তবু একটা কথায় বিশ্বাস রাখা যায়। বিপ্লবী রক্তবীজের ঝাড়। এক জায়গায় রক্ত ঝরলে অন্য জায়গায় মাথা তুলে দাঁড়ায়।
গল্পটা বলার জন্য একটা সহজ সোজা স্ট্রাকচার নিয়েছেন। কলকাতার মিত্র ইন্সটিটিউশনের শিক্ষক গ্রামে গিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের পোষা গুণ্ডাদের শাস্তির দাবিতে অহিংস প্রতিবাদ গড়ে তোলে। পরমব্রতকে এই চরিত্রে বেশ সাবলীল লেগেছে। অন্ধকার অরাজকতার মধ্যে এক নতুন আলো। মাস্টার বলে সবাই ডাকে তাঁকে। সম্মান দিয়ে। নিজের জীবনের সর্বস্ব নিংড়ে দিয়ে রক্ষা করে চলে নারীর সম্ভ্রম, দান করে গরিবকে। ঠিক বাস্তবের বরুণ যেমন ছিলেন। ভাল লাগে নো-মেকআপের মিমিকেও। চোখে মুখে সারল্য অথচ দার্ঢ্য। যেটা ভাল লাগে না, সেটা হল পরিচালকের বাণিজ্যিক ছবির অভিজ্ঞতাকে ঝেড়ে না-ফেলার ক্ষমতা। এমন একটি ছবিতে নাচ-গান আর আইটেম সং খুবই মোটা দাগের। বেয়াড়ারকম বেখাপ্পা। এরকম ছন্দপতনের ব্যাপারে অনেকটাই সচেতনতার প্রয়োজন ছিল। এগুলো না থাকলেও, সাধারণ দর্শকের বুঝতে কোনও অসুবিধে ছিল না। তবে রয়েছে সাধারণ মানুষের আবেগ ছুঁয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা। ভাষা সহজ, কিন্তু ফিল্মি-ঘেঁষা। গ্রামগঞ্জের দর্শকের কথা ভেবে সেটা অবশ্য মেনে নেওয়াই যায়।

বিপ্লবের সত্যি যে কোথা থেকে শুরু হয় আর স্বপ্ন যে কোথায় শেষ হয়, তা কেউ জানে না। দ্বিতীয়ার্ধে পুরোটাই কল্পনার উড়ান। তবে আদর্শ বুকে চেপে ধরে। দেশের আইন অমান্য করে। বরুণের বয়োজ্যেষ্ঠ সতীর্থ বিনোদবিহারী, যে-ভূমিকায় অভিনয় করেছেন পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, ঠিকানা খুঁজে আসেন সেই দুখিয়া গ্রামে। শুরু হয় প্রতিশোধের অন্য এক অধ্যায়। সেটা এখানে বললে সিনেমা দেখার মজাটাই হারিয়ে যাবে। রহস্যের মধ্যে ক্যামেরার ভূমিকাও অনস্বীকার্য। লং শট, ক্লোজ শটে সুন্দর খেলা। দেখতে ভাল লাগবে পুরুলিয়াকে। আর এই সংকটের মুহূর্তে একজনের আবির্ভাব। শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়। আবার অভিনয়ের অন্য মাত্রা! দেখেই পরখ করে নেবেন। অভিনয়ই এ ছবির সেরা আকর্ষণ। আগাগোড়া ভাল লাগবে রুদ্রনীল আর প্রদীপকে। পাওয়ার অফ কমন ম্যান কাকে বলে সেটা জেনে নিন পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে। সবশেষে, রাজ চক্রবর্তীর এই ছবি যে একেবারে নিখুঁত কিংবা সেরা সেটা বলা যায় না। তবে, গুরুত্ব অন্যখানে। এই টালমাটাল রাজনৈতিক পরিস্থিতির আঁচ বুঝে নিতে কিছু ছবি দেখা উচিত। যাঁরা গত দশ বছরে গ্রামে যাওয়ার সুযোগ পাননি, তাঁদের জন্য তো বটেই। `প্রলয়` সেই "উচিত" বর্গেই পড়ে।

.