'কেদারনাথ' ফিল্ম রিভিউ: প্রথম ছবিতে কি মন কাড়তে পারলেন সারা?
রণিতা গোস্বামী
রণিতা গোস্বামী
'পদ্মাবত'- এর পর ফের বিতর্কের মুখে আরও একটি বলিউড ফিল্ম। আর এই ছবিটি হল অভিষেক কাপুর পরিচালিত 'কেদারনাথ'। যদিও 'পদ্মাবত'-এর মতো 'কেদারনাথ' নিয়ে দেশজুড়ে সেভাবে তাণ্ডব হয়নি ঠিকই, তবে ছবি নিয়ে জোর বিতর্ক তৈরি হয়েছে। তবে ছবির গল্পে হিন্দু -মুসলিম প্রেম দেখানোর হয়েছে, তাই এটি রাজ্যের শান্তি শৃঙ্খলা বিনষ্ট হতে পারে এমন দাবিতে ছবিটি 'উত্তরাখণ্ড'-এ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
তবে কী এমন রয়েছে ছবির গল্পে? বলিউডে নিজের ডেবিভ ছবিতে কেমন পারফরম্যান্স করলেন সইফ-অমৃতা কন্যা সারা? এসব প্রশ্ন সিনেমাপ্রেমীদের মনে এসেই থাকে। যাঁরা এখনও ছবিটি দেখেননি তাঁদের জন্য রইল এই 'কেদারনাথ'-এর রিভিউ...
কেদারনাথ এর প্রেক্ষাপট
ছবিটি ১৯১৩ সালে উত্তরাখণ্ডের বন্যার প্রেক্ষাপটে তৈরি। ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র মক্কু হিন্দু পণ্ডিতের মেয়ে, সে তীর্থস্থান কেদারনাথ সংলগ্ন এলাকাই নিজের বাবা-মা ও দিদির সঙ্গে থাকে। অন্যদিকে গল্পের নায়ক মনসুর পিঠ্ঠুর চরিত্রে অভিনয় করেছেন। মনসুরও কেদারনাথের মন্দির সংলগ্ন এলাকাতেই থাকেন। ছবিতে দেখা যায় মক্কু-র সঙ্গে তার দিদির ছেলেবেলার প্রেমিক কুল্লু (নিশান্ত ধাইয়া) বাগদান করিয়েছে তাঁর বাবা। এই নিয়েই দুই বোনের মধ্য মন কষাকাষি। যদিও কুল্লুকে মক্কুর বিন্দুমাত্র পছন্দ নয়। দিদির ভালোবাসাকে নিয়ে ছেলেখেলা করার জন্য মক্কু তাকে অনেক কথা শোনায়, তবুও সে মক্কুর পিছু ছাড়ে না। অন্যদিকে মক্কুর ভালোলাগে পিঠ্ঠু মনসুরকে। ধীরে ধীরে মনসুরের সঙ্গে মক্কুর প্রেম জমে ওঠে। যদিও প্রথমদিকে মনসুর মক্কুকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করে যে তাঁদের এই প্রেম কখনওই পরিণতি পাবে না, কারণ বাধা হয়ে দাঁড়াবে ধর্ম। তার উপর সে একজন কট্টর হিন্দু পণ্ডিত পরিবারের মেয়ে। তবুও মক্কু শুনতে নারাজ। সে মনসুরকেই বিয়ে করতে চায়। এসবের মধ্যে মক্কুকে ভালোবেসে ফেলে মনসুর। তাঁদের ভালোবাসা ক্রমশ গভীর হতে থাকে। বিষয়টি জানাজানি হওয়াতেই বাধ সাধে মক্কুর পরিবার। শুরু হয় অশান্ত। মেয়ের এমন কাণ্ড মেনে নিতে পারছিলেন না মক্কুর বাবা। উল্টে বিষয়টি জানাজানি হতেই মনসুরকে তুলে নিয়ে এসে বেধরক মারধর করে তাঁর 'মাঙ্গেতর', অর্থাৎ মক্কুর সঙ্গে যার বাগদান হয়ে। মক্কুকে বিয়ে করার জন্য উঠে পড়ে লাগে সে। শুরু হয় ঘোর অশান্তি। মেয়েকে আটকাতে পরদিন সকালেই মেয়ের বিয়ে দেয় মক্কুর বাবা, যদিও মক্কু গিয়ে হাতের শিরা কেটে আত্মহত্যার চেষ্টা করা।
এপর্যন্ত ঠিকঠাকই ছিল, তবে এরপরই আসে মহা দুর্যোগ। প্রেম, ধর্মীয় বাধা, সবকিছুর উপরে গিয়ে প্রকৃতি রুষ্ঠ হয়ে উঠে। উত্তরাঘণ্ডে নেমে আসে সেই মহা প্রলয়। চোখের নিমেষে তচনচ হয়ে যায় সবকিছু। সবাইকে বাঁচাতে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উঠে পড়ে লাগে মনসুর। তবে শেষপর্যন্ত কি মনসুর-মক্কুর সঙ্গম হবে? প্রাকৃতির দুর্যোগ কি তাঁদের এক করতে পারবে, কী হবে গল্পের শেষে? সেকথা জানতে হলে অবশ্যই প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে দেখতে হবে 'কেদারনাথ' ছবিটি।
অভিনয়
'কেদারনাথ' সারা আলি খানের প্রথম ছবি হলেও ছবিটি দেখার সময় কখনওই মনে হয়নি এটাই তাঁর প্রথম ছবি। ছবিতে দেখালেই বোঝা যাবে সারা ক্যামেরার সামনে কতটা স্বচ্ছন্দ, তিনি কতটি আত্মবিশ্বাসী। সইফ-অমৃতা কন্যা কতটা ট্যালেন্টেড, আর তিনি যে বলিউডে শক্ত ঘাঁটি গড়ার জন্যই এসেছেন তা সারা বেশ বুঝে দিয়েছেন। ছবিতে সুশান্ত সিং রাজপুতের অভিনয়ও বেশ ভালো, তবে সারা অনেক ক্ষেত্রেই তাঁকে ছাপিয়ে গেছেন। পাশাপাশি সারার দিদির চরিত্রে পূজা গর, মায়ের চরিত্রে অলকা আমিন ও বাবার ভরদ্বাজের অভিনয়ও মন্দ নয়।
পরিচালনা ও চিত্রনাট্য
'কেদারনাথ'-এর ছবির চিত্রনাট্য যে অসাধারণ কোনও গল্প তা কখনওই নয়। উত্তরাখণ্ডের প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রেক্ষাপটে তৈরি এটা একটি প্রেমের গল্প। তবে ছিমছাম প্রেমের গল্পও যে এভাবে সুন্দরভাবে তুলে ধরলে দর্শকদের হৃদয় স্পর্শ করতে পারে তা বুঝিয়ে দিয়েছেন 'কাই পো চে' খ্যাত পরিচালক অভিষেক কাপুর। সিনেমাটি প্রথম হাফে সাধারণ বলে মনে হলেও, দ্বিতীয় হাফে এটি মন ছুঁয়ে যায়। বিশেষ করে শেষ ১৫ মিনিট দর্শকদের টানটান করে বসিয়ে রাখতে সক্ষম পরিচালক। উত্তরখণ্ডের প্রাকৃতিক দুর্যোগ ফুটিয়ে তুলতে যেভাবে VFX-এর ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে দর্শকদের গায়ে কাঁটা দিয়েছে। শেষ কিছুক্ষণ চুপ করে, টানটান উত্তেজনা নিয়ে বসে থাকতে দেখা গেছে দর্শকদের। পাশাপাশি অনেক দৃশ্যের জন্যই আবেগে বহু সিনেমাপ্রেমীদের চোখের পাতাও ভিজেছে। সবমিলিয়ে পরিচালক বুঝিয়ে দিয়েছেন সুন্দর করে বলতে পারছেন ছিমছাম প্রেমের গল্প দিয়ে বাজিমাত করা যায়।
সঙ্গীত ও আবহ, ক্যামেরা ও সম্পাদনা
ছবিতে অসংখ্য গান ব্যবহার করা হয়েছে তেমনটা নয়। তবে নমো নমো শঙ্করা, সুইটহার্ট, কাফিরানা গানগুলি মন্দ নয়। তবে মন ছুঁয়েছে অমিত ত্রিবেদীর করা আবহ সঙ্গীত, যা চিত্রনাট্যকে আরও অনেকবেশি সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলতে সাহায্য করেছে। প্রশংসনীয় তুষার কান্তি রায়ের সিনেমাটোগ্রাফিও। প্রশংসনীয় ছবির সুন্দর স্মার্ট সম্পদনা।
ত্রুটি
ছবিতে কোনও কোনও ক্ষেত্রে ডায়ালগ বড় বেশি নাটকীয় লেগেছে। বিশেষ করে মনসুরের চরিত্রটিকে (সুশান্ত সিং রাজপুত) বেশি নায়কচিত করে তোলার জন্য, কোনও কোনও ডায়ালগ ও দৃশ্য বড় বেশি নাটকীয় বলে মনে হয়েছে, যেগুলি না দেখালেও চলত। মক্কু-মনসুর চরিত্রদুটিকে আরেকটু সাজিয়ে গুছিয়ে তুলে ধরা যেত।
মোটের উপর 'কেদারনাথ' ছবিটি মন্দ নয়। বলা ভালো এই সময়ে দাঁড়িয়ে যখন বলিউডে অন্যরকম ছবি তৈরির চল তৈরি হয়েছে, তখনও 'কেদারনাথ' ছবিটিকে দিয়ে পরিচালক অভিষেক কাপুর বুঝিয়ে দিয়েছেন আজও ভালো করে প্রেমের গল্প ভালো করে বলতে পারলে তা দর্শকদের মন জয় করে নিতে পারে। তাঁদের ৮ ও ৯-এর দশকের প্রেম কাহিনী ভিত্তির সিনেমাগুলির মতোই আবেগতাড়িত করে তুলতে পারে। সব মিলিয়ে 'কেদারনাথ' ৫ এর মধ্যে ৩ দেওয়া যায়। তবে ডেবিউ ছবি হিসাবে সারাকে এই ছবিতে ৫-এর ৪ দেওয়াই যেতে পারে। অভিনয়ে তিনি শ্রীদেবী কন্যা জাহ্নবীর থেকে যে অনেক এগিয়ে তা বেশ বুঝিয়ে দিয়েছেন।