কলিকাতা চলিয়াছে 'রোলে'তে 'রোলে'তে

মধ্য-প্রাচ্যের শোয়ারমা বা মেক্সিকোর কসিডিয়ার মতো রুটিতে মাংস পুরে, চিজ বা হুমস দিয়ে বেক করে খাবার চল ছিল অনেক আগে থেকেই। কিন্তু আমার চিরপরিচিত রোলের সঙ্গে এই খাবারের গুরুত্বপূর্ণ তফাতটা হয়ে গেল স্বাদে।

Updated By: Oct 13, 2011, 09:09 PM IST

সাধক-কবি নিশিকান্তের কথা আমরা সবাই জানি। কিন্তু খাদক, লোভী বাঙালির রোল আবিষ্কারের খবর রাখি কত জন? পরোটা-মাংস ঝটপট খেয়ে ফেলার উপায় বার করতে গিয়েই তিরিশের দশকে খাস কলকাতার বুকে রোলের আবির্ভাব। মধ্য-প্রাচ্যের শোয়ারমা বা মেক্সিকোর কসিডিয়ার মতো রুটিতে মাংস পুরে, চিজ বা হুমস দিয়ে বেক করে খাবার চল ছিল অনেক আগে থেকেই। কিন্তু আমার চিরপরিচিত রোলের সঙ্গে এই খাবারের গুরুত্বপূর্ণ তফাতটা হয়ে গেল স্বাদে। মুচমুচে বাদামিরঙা পরোটার মাঝে থরে থরে ভাজা মাংসের আস্তরণ আপনাকে যদি লোলুপ করে তোলে, তা হলে কলকাতার রাস্তার রাস্তায় বিক্রি হওয়া রোলের দোকান দেখে আপনি উতলা হবেনই। তেলছাপ ওঠা কাগজে মুড়ে এই রোলে কামড় বসালেই আপনি পৌঁছে যেতে পারেন রসনার সপ্তম স্বর্গে। সেই তুলনায় শোয়ারমা বেশ নিরামিষ। পিটা ব্রেড বা খব্‌জের মধ্যে ডোনার কেবাব বা ফেলাফেল পুরে, স্যালাড আর হুমস দিয়ে তৈরি শোয়ারমাতে সেই স্বাদ কোথায়? মেক্সিকোর কসিডিয়ার কনসেপ্টে রুটির ভাঁজে মাংস থাকলেও, তা অনেক বেশি পাশ্চাত্য। স্বাদ দূরে থাক, প্রণালীতেও দূরত্ব আকাশ-জমিন। আর যদি রোলের কথাই বলতে হয়, তা হলে ধর্মতলার নিজাম এই ব্যাপারে দেশ-কালের গণ্ডি ছাড়িয়ে হয়ে উঠেছে বিশ্বজনীন। রোলের দোকান দিতে চাইলে এই পীঠস্থানে গিয়ে মাথা ঠেকিয়ে আসতেই হবে। শুধু এই কারণে নয় যে নিজামের রোল স্বাদে অতুলনীয়। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটা হল, রোল ব্যাপারটার উদ্ভব হয়েছে এই দোকান থেকেই। হগ মার্কেট চত্বরে উনিশ শতকের গোড়ায় একটা ছোট্ট স্টল দিয়েছিলেন লখনউ থেকে আসা শেখ হাসান রেজা।
প্রথম দিকে বানাতেন শুধু কাবাব। সঙ্গে পরোটাও। কিছুদিন যাবার পর, খাবার যখন 'হিট' করতে শুরু করে, শেখ সাহেবের মাথা থেকে বেরোল, পরোটা আর কাবাব আলাদা না দিয়ে যদি পরোটাকে কাবাব দিয়ে মুড়ে দেওয়া যায় তো কেমন হয়? যেমন ভাবা তেমন কাজ। জন্ম নিল পরোটা আর কাবাবের যুগলবন্দি, ফিউশন প্রেম। আর তারপরেই ধুন্ধুমার ব্যাপার। হইহই পড়ে গেল খাদ্যরসিক মহলে। কিন্তু মুশকিল হল সাহেবদের। খাবার সময় হাতে তেল লাগাটা তাঁদের না-পসন্দ।
ধুরন্ধর শেখ সাহেব তখন একটা কাগজ দিয়ে মুড়ে দিলেন সেই পরোটা। ব্যস! জন্ম নিল আজকের রোল। সাহেবরা মাথা নিচু করতে বাধ্য হলেন ভারতীয় উদ্ভাবনা আর ফিউশনের কাছে। কারণ ও জিনিসের যে ততদিনে ভক্ত হয়ে গিয়েছেন তাঁরাও। সারা পৃথিবী জয় করলেও আট ইঞ্চির পরোটায় যে কী জাদুর খেল আছে, সেই রহস্য এখনো সমাধান করতে পারেনি ইংরেজ সমাজ।

১৯৩২ সালে শেখ সাহেব তাঁর স্টল উঠিয়ে নিয়ে আসেন এখনকার জায়গায়।
ছেলে শেখ নিজামুদ্দিনের নামে নাম দিলেন 'নিজাম'। সেই শুরু নিজামের জয়যাত্রার। মাঝে কিছুদিন বন্ধ থাকলেও আবার রমরম করে ফিরে এসেছে তার পুরনো আভিজাত্য আর কেতা নিয়ে। বস্তুত, মাতাল দামাল এই শহরের যাবতীয় 'হেপ'পনা আর সাবালকত্বের মধ্যেও কিছু কিছু জিনিস টিকে থেকে যায় তার অমলিন আবেদন নিয়ে।
বর্ষার রাতে খোলা জানালা দিয়ে বৃষ্টি ভেজা হাওয়া ঢুকলে যেমন ডোভার লেনে আপনার কৈশোরে শোনা আমির খানের রাগ মালহারের অনাস্বাদিত স্মৃতি আপনাকে মনকেমন করিয়ে দেয়, নিজামের রোল ব্যাপারটাও অনেকটা সেই ধ্রুপদী নেশার মত, যা পাওয়া এবং না পাওয়ার সাথে মিশে আছে, শুধু রসনাই নয়, সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে জীবনটাকে চেটেপুটে খাওয়ার বাসনা। ভাগ্যিস এ সব দোকান কলকাতায় ছিল! না হলে, অঞ্জন দত্তের ভাষায় বলতে হত, 'তুমি না থাকলে কলকাতা ছেড়ে কবে টা টা বাই বাই'!

শময়িতা চক্রবর্তী

Tags:
.