দু'ডানায় দুনিয়ায়

আসলে পাখি নয়, প্রজাপতি নয়, গাছপালা নয়- মনের গভীরে থাকা এক পলায়নী মনোবৃত্তির কারণেই নাকি অনেক মানুষ চারপাশের ভীষণ চেনা, কেজো, হিসেবি জগতের মধ্যেই অন্য একটা আপাত অচেনা, প্রায় অনুল্লেখ্য জগতের দিকে আকর্ষিত হয়। সময়ে-অসময়ে এই ঘরের ভিতরের ঘরটায় ঢুকে পড়া। এ-ও তো এক ধরনের ভ্রমণ? তবে সেই অপ্রয়োজনীয় ভ্রমণ কাহিনির লেখক কিংবা পাঠক সম্ভবত হতে পারেন দার্জিলিঙের পটভূমিকায় চলচ্চিত্রায়িত সত্যজিত্‍-ক্লাসিকের পাহাড়ী সান্যালের মতো আপাত গৌণ চরিত্ররাই।

Updated By: Feb 24, 2012, 01:21 PM IST

পাখি দেখে হয়টা কী?

প্রাথমিক আলাপের পর্বটা একটু গাঢ় হওয়ার পর 'শখ'-এর কথা উঠলে মোটামুটিভাবে 'শক' লাগানো অনিবার্য প্রশ্ন! পরিচয়টা গড়িয়ে গ্লাসের আসরে পৌঁছনোর পর বিহঙ্গকুলের ঠিকুজি-কোষ্ঠী নিয়ে একটু নাড়াচাড়া শুরু হলেই যে কৌতূহলগুলোর মুখোমুখি হতে হয়, তার প্রতিতুলনায় আসতে পারে 'কাঞ্চনজঙ্ঘা' ছবিতে 'রায়বাহাদুর' ছবি বিশ্বাসের সেই বিখ্যাত (?) প্রশ্নটা--''রোস্ট হয়?''

সত্যি কথা বলতে কী, উত্তরটা তেমন করে খোঁজার চেষ্টাই করা হয়নি কোনও দিন। ঘটনাচক্রে প্রকৃতি সম্পর্কে আগ্রহটা তৈরি হয়েছিল স্কুলের উঁচুতলার দিকে। স্থানীয় কলেজের রসায়ন বিভাগের এক ল্যাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট-এর পাল্লায় পড়ে। ভদ্রলোকের বাউন্ডুলেপনার নেশা ছিল। সেই সঙ্গে, শীত পড়লেই বন্দুক কাঁধে এদিক-ওদিক পাখি খুঁজে বেড়ানোর। মারতেন কম, দেখতেন বেশি। শুধু পাখি নয়, প্রজাপতি, পোকামাকড়, গাছপালা সম্পর্কেও ব্যতিক্রমী বুত্‍পত্তি ছিল তাঁর। এখন মনে হয়, কাঁধে ঝোলনো বারো বোরের শটগান'টা ছিল তাঁর একটা ছুতো। আসল উদ্দেশ্য ছিল, 'পাখি দেখার উপকারিতা' সম্পর্কিত কঠিন প্রশ্নগুলোকে এড়ানো। তবে প্রশ্নটা এখন আর করে ওঠার উপায় নেই। ট্রপো-স্ট্র্যাটো-আয়নোস্ফিয়ারের সীমানা ছাড়িয়ে তিনি এখন অন্য জগতের বাসিন্দা।

আসলে পাখি নয়, প্রজাপতি নয়, গাছপালা নয়- মনের গভীরে থাকা এক পলায়নী মনোবৃত্তির কারণেই নাকি অনেক মানুষ চারপাশের ভীষণ চেনা, কেজো, হিসেবি জগতের মধ্যেই অন্য একটা আপাত অচেনা, প্রায় অনুল্লেখ্য জগতের দিকে আকর্ষিত হয়। সময়ে-অসময়ে এই ঘরের ভিতরের ঘরটায় ঢুকে পড়া। এ-ও তো এক ধরনের ভ্রমণ? তবে সেই অপ্রয়োজনীয় ভ্রমণ কাহিনির লেখক কিংবা পাঠক সম্ভবত হতে পারেন দার্জিলিঙের পটভূমিকায় চলচ্চিত্রায়িত সত্যজিত্‍-ক্লাসিকের পাহাড়ী সান্যালের মতো আপাত গৌণ চরিত্ররাই।

খুব বেশি রোম্যান্টিক হওয়ার বোধ হয় দরকার পড়ে না। পাখি আমাদের অনেককেই টানে। অন্তত একটা বয়স পর্যন্ত। তাদের রঙের বাহার, ডাকের রকমফের, ওড়ার কৌশল- সবেতেই যেন একটা মুক্তির স্বাদ। চারপাশের ছকে বাঁধা, চৌকো-চ্যাপটা পরিবেশটা ছেড়ে নির্নিমেষে অন্য একটা নিঃসীম দুনিয়ায় হারিয়ে যাওয়ার অনুভূতি। ব্যস এইটুকুই! হোক না ক্ষণিকের জন্য, তবু তো যাওয়া। সচরাচর রবিবারে বা অন্য কোনও ছুটির দিনে। কিংবা কিছুটা সময় চুরি করে সপ্তাহের মাঝেই। অফিসের ন্যাপস্যাকে বাইনোকুলারের সঙ্গে 'গ্রিমেট-ইনস্কিপ'-এর ফিল্ড গাইড'টা ঢুকিয়েই ধাঁ!

এমনকী সবসময় 'ঘর হতে শুধু দুই পা' ফেলারও দরকার পড়ে না! চার দেওয়ালের চৌহদ্দিতে বসেই চলে যায় প্রকৃতির গভীরে! কলেজ-জীবনে একটা পারা-ওঠা আয়নার সামনে সদ্য দাড়ি গজানো গালে রেজর চালানো প্র্যাকটিস করার সময় হঠাত্‍ই আবিষ্কার করে ফেলেছিলাম সবুজের স্মৃতিতে মানস ভ্রমণের এই কায়দাটা। নজরটা গুটিয়ে এনে পারা-ওঠা ঝাপসা গহ্বরটার মধ্যে দিয়ে মনটাকে চালান করে দিতে পারলেই শর্টকাটে পৌঁছে যাওয়া যেত সেই 'অন্য' দুনিয়ায়-- শীতের সকালে আগুনমারির চরে (সরকারি দস্তাবেজে এখন যার নাম নয়াচর) চখাচখি'র মিঠে খুনসুটি, গ্রীষ্মের দুপুরে তমলুক রাজবাড়ির বাগানে ছাতারের বাসা থেকে দু'টো ডিম ফেলে দিয়ে পরাভৃত পাপিয়া'র ঠিক দু'টো ডিম পেড়ে রেখে যাওয়া, ভরা বর্ষায় কাঁকটিয়ার জলায় শামুকখোলের courtship!

পারা-ওঠা আয়নাটা কোথায় যেন হারিয়ে গেল একদিন। আজকাল দাড়িটা আর নিয়মিত কাটা হয়ে ওঠে না।

সায়ন ত্রিপাঠী

Tags:
.