কেউ কথা রাখেনি

বাংলা নাটক এখনও বড়ই বেহাল। কিছুটা স্বাধীনতা নিয়েই বলা যায়, মধুসূদনে যে বাংলা নাটকের গোড়াপত্তন, রবীন্দ্রনাথের মাধ্যমে যার অগ্রগমন, বাদল সরকারে তার পরিসমাপ্তি। মাঝখানে অল্প কিছু সময় আইপিটিএ এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রমী ধারার জন্ম দিয়েছিল বটে, কিন্তু তার পর আবার সেই পুরনো ধারাই ফিরে এল অন্য মোড়কে।

Updated By: Nov 28, 2011, 07:14 PM IST

বাংলা নাটক এখনও বড়ই বেহাল। কিছুটা স্বাধীনতা নিয়েই বলা যায়, মধুসূদনে যে বাংলা নাটকের গোড়াপত্তন, রবীন্দ্রনাথের মাধ্যমে যার অগ্রগমন, বাদল সরকারে তার পরিসমাপ্তি। এর আগে, পরে ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক স্তরে নাটক রচনা ও প্রযোজনার প্রচেষ্টা হয়েছে। সে সবের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলা যায়, কোনও প্রয়াসই শেষ পর্যন্ত খুব একটা ছাপ রেখে যায়নি। তবে ঐতিহাসিক পাঠের নিরিখে তাদের গুরুত্ব যে অপরিসীম সে কথা অনস্বীকার্য।

কিন্তু 'সহৃদয়হৃদয়সংবাদী' পাঠকের মনে সেই সব রচনা যে আবেদন রাখতে পারল না, তার একটা বড় কারণ মনে হয় মানুষের 'অনুপস্থিতি'। শ্রেণিবৈষম্য এবং শ্রেণিশোষণের বহুমাত্রিকতার নিরিখে মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম, যা ঔপনিবেশিক এবং উপনিবেশ-উত্তর ভারতের বাস্তবতা, তা কখনওই বাংলা নাট্যপ্রয়াসে সে ভাবে প্রকাশ পায়নি। তুলনামূলক ভাবে বাংলা উপন্যাস বা কাব্যের ইতিহাস যথেষ্ট বস্তুনিষ্ঠ।

কিন্তু কিছু উদাহরণ বাদ দিলে বাংলা নাটকের আশ্রয় মোটামুটি ভাবে পুরাণকথা, ইতিহাস, সংস্কৃত ও পাশ্চাত্য নাটকের অনুকরণ ও অনুসরণ। গঠন ও বিষয়গত দিক দিয়ে সেই ঊনবিংশ শতকেই সাধারণের সাহিত্য-সংস্কৃতিকে বিসর্জন দিয়েছিল বাঙালি শিক্ষিত, ভদ্রলোক শ্রেণি। যাত্রা-পাঁচালি-খেউড়কে তার জন্য কম গালমন্দ, কুত্‍‍সা সহ্য করতে হয়নি।
এ সবের বিরুদ্ধে বারবার যে অভিযোগ উঠত, তা হল অশ্লীলতা। অথচ, অশ্লীলতা যে সে সময় শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যে বিশেষ ভাবে চালু ছিল তা তখনকার সংবাদমাধ্যমের বিবরণ থেকেই স্পষ্ট।

এমনকী, একই দোষে দুষ্ট ছিলেন তখনকার সংবাদপত্রের সম্পাদকরাও। অথচ, কাঠগড়ায় তোলা হয়েছিল শুধুই নিম্নবর্গের আচার-ব্যবহার-সাংস্কৃতিক চর্যাকে। সম্ভবত, তাঁদের সংস্কৃতির শরীর-নির্ভরতাকে একেবারেই গ্রহণ করতে পারেনি বিদেশি শিক্ষায় জারিত, ছুঁত্‍‍মার্গসর্বস্ব বাঙালি সমাজ। তা ছাড়া, বিদেশি প্রভুর কাছে জাতে ওঠার বিষয়টি তো ছিলই। তাই সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রসেনিয়ম নাট্যধারা অবলম্বন করতে গিয়ে একেবারেই জলাঞ্জলি দিতে হয়েছিল ঘরের শিল্পভাবনা। ফলে অচিরেই যাত্রা-পাঁচালিরা ঠাঁই পেল ঊনবিংশ শতাব্দীর মহাফেজখানায়।

অন্যদিকে, 1876 খ্রিস্টাব্দে নাট্য নিয়ন্ত্রণ আইনের চোখ রাঙানির ভয়ে শিক্ষিত বাঙালিও আর প্রতিবাদী নাটক লেখায় সাহস দেখাতে পারেনি। সব মিলিয়ে গণবিচ্ছিন্ন
হয়ে যাওয়ার যে সূত্রপাত ঘটল উনিশ শতকে সেই ধারায় অবগাহন করাটাই অভ্যাসে পরিণত হল বাঙালির। মাঝখানে অল্প কিছু সময় আইপিটিএ এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রমী
ধারার জন্ম দিয়েছিল বটে, কিন্তু তার পর আবার সেই পুরনো ধারাই ফিরে এল অন্য মোড়কে। আজকাল উত্তরাধুনিক চিন্তায় উদ্বুদ্ধ বাঙালি 'ফোক' নামধেয় এক শিল্প পুনরুজ্জীবিত করার প্রয়াস চালাচ্ছেন বটে কিন্তু আপাতদৃষ্টিতেই স্পষ্ট, লোকশিল্প বা সাধারণ মানুষের সংস্কৃতি শিক্ষিত বাঙালি গ্রহণ করেছে তাকে নিজের মতো করে মানিয়ে নিয়ে। পরিবর্তন, পরিবর্ধন, পরিমার্জন করে তবে তাকে ঠাঁই দিয়েছে নিজের বৈঠকখানার শোকেসে। তাকে তারই মতো করে গ্রহণ করতে পারেনি অধিকাংশ সময়ই। যদিবা পেরে থাকে, তবে তা এসেছে বৌদ্ধিকচর্চার অনুষঙ্গে। তাতে যত না রয়েছে স্বতঃস্ফূর্ততা, তার চেয়ে ঢের বেশি আছে প্রয়োজনের তাগিদ।

আর এখানেই রয়ে গিয়েছে চিন্তার দীনতা।

এই রচনাটি বর্তমান লেখকের নিম্নোক্ত দুটি গবেষণাধর্মী লেখার অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত আকার:

১ বেঙ্গলি থিয়েটার: অ্যান এডিফিস অন দি অ্যাশেস অফ দ্য পিপল'স কালচার, সোশ্যাল সায়েন্টিস্ট [মার্চ-এপ্রিল 2010]

২ ইনসেপশন অফ দ্য ড্রামাটিক পারফরম্যানসেস অ্যাক্ট, 1876,: আ ব্রিফ ওভারভিউ অফ দ্য সেল্ফ-সিকিং বেঙ্গলি ইন্টেলিজেন্টশিয়া

মনুজেন্দ্র কুনডু

Tags:
.