অনুষ্টুপ রায় বর্মণ: ২৬ জানুয়ারির রাত। সকালেই কর্তব্যপথে সেনাবাহিনীর কুচকাওয়াজ, বায়ু সেনার উড়ান দেখেছে দেশবাসী। ফরাসি দেশনায়কের সামনে সসম্মানে প্রজাতন্ত্র দিবস পালন করেছে ভারত, আর রাতে পৌঁছে গিয়েছে বাইপাসের ধারে কলকাতা শহরের এক নামি শপিং মলের সিনেমা হলে। লক্ষ্য বলিউডের ‘গ্রীক গড’ হৃতিক রোশনের ‘ফাইটার’ দর্শন। ২৫ তারিখেই সিনেমা হলে পৌঁছে গিয়েছে ‘টপ গান’ বা হাল আমলের ‘টপ গান ম্যাভেরিকের’ বলিউড ভার্সন। কেমন হল জেটের লড়াই? টম ক্রুজকে ছুঁয়ে ফেলল দেশের অন্যতম বড় সুপারস্টার? নাকি কিছুটা হলেও কম হল দর্শকের প্রত্যাশা পূরণ। 


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

সিনেমার মূল বক্তব্য কী?


শুরুতেই ট্রেলার দেখে বেশিরভাগ দর্শক বুঝে গিয়েছেন কী হতে চলেছে সিনেমার মূল বিষয়। বর্তমান যুগে নেটফ্লিক্স থেকে শুরু করে অন্যান্য সব ওটিটি প্লাটফর্ম এবং বিদেশি সিনেমার ভারতীয় রিলিজের কল্যাণে বেশিরভাগ মানুষ টম ক্রুজের ‘টপ গান’ এবং তার সিক্যুয়েল ‘টপ গান ম্যাভেরিক’-এর গল্প জানেন। ফলত প্রায় সকলেই বুঝে গিয়েছিলেন যে এই সিনেমায় কী থাকতে চলেছে। গল্পের দিক থেকে দেখতে গেলে এই সিনেমা দর্শককে নতুন কিছু দিতে পারেনি। সাম্প্রতিক অতীতে বলিউডের দুই ‘খান’ তাদের কামব্যাক করেছেন স্পাই মুভি দিয়ে। সেই সিনেমার মতোই পাকিস্তানের ভারত আক্রমণ এবং তারপরে ভারতের যোগ্য জবাবের এই গতে বাঁধা চেনা এবং সহজ ছকের বাইরে বেরতে পারেনি হৃতিকের ফাইটার।


পাক সেনাবাহিনীর যেকোনও বড় অফিসারের ঘরে অবাধে প্রবেশ করে টেররিস্ট। তাদের সঙ্গে তাদের ডেরায় গিয়ে বৈঠক করে আইএসআই। গল্পে রয়েছে বাস্তব ঘটনার বিভিন্ন রেফারেন্স এবং সেই ঘটনার বভিন্ন ওলিগলি ঘুরে অবশেষে সিনেমা শেষ হচ্ছে সেই এক জায়গায়। ভারতের সেরা অফিসারের একার হাতে দুষ্টের দমন।  


আরও পড়ুন: Iman Chakraborty: ভরা বাজার, ছোট করে বড় পদক্ষেপ! ইমনের হাতে মার্সেডিজের চাবি...


দেশাত্মবোধের আগুনে সেঁকে নেওয়া সিনেমার ব্যাবসা 


২৬ জানুয়ারির দেশাত্মবোধক আবহাওয়ায় দেশপ্রেমের আগুনে হাত সেঁকে ভালো ব্যবসার পথেই পায়ে পায়ে এগোচ্ছে ‘ফাইটার’। সিনেমার নির্দিষ্ট কিছু ধরনের দৃশ্য এবং সংলাপে হল কাঁপিয়ে দর্শকের হাততালি এই বক্তব্যের স্বপক্ষে প্রমাণ বহন করে। সাম্প্রতিক যে সিনেমাগুলো ভারতীয় সিনেমার জগতে আলোড়ন তুলেছে এবং ‘রেকর্ড ব্রেকিং’ ব্যবসা করেছে তার বেশিরভাগেরই মূল গল্প এই চেনা ছকে বাঁধা।


সেই পাকিস্তান-ভারত শত্রুতা। ভারতের উপর পাকিস্তানের আক্রমণ এবং ‘পে-ব্যাক’। অনেকেই বলে থাকেন ২০১৪ সালের পরে ভারত পাকিস্তানকে রাজনৈতিক এবং সেনাবিহিনির দিক থেকে বেশ কঠিন অবস্থানের মধ্যে ফেলেছে। তার উপড়ে এসে জুড়ে বসেছে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ সমস্যা এবং তার জেরে তৈরি হওয়া প্রায় অচলাবস্থা।


এই অবস্থায় দেশপ্রেমী ভারতবাসী স্বাভাবিকভাবেই বেশ খুশি। এবং এই অবস্থাকে কাজে লাগাতে তৎপর ধুরন্ধর ব্যবসায়ী বলিউড। প্রতিটি ‘ঘুসকে মারেঙ্গে’ মার্কা ঘটনার কোনওটাই সাম্প্রতিক সিনেমার টপিক হওয়ার হাত থেকে নিস্তার পায়নি। ভিকি কৌশলের কেরিয়ার গ্রাফ বদলে দিয়েছে ‘উড়ি’ এবং তারপরেই ফিল্ড মার্শাল শ্যাম মানেকশ-র জীবনের উপর তৈরি সিনেমা তাঁকে হয়ত কিছুটা ‘টাইপকাস্ট’ করে ফেলছে। সময় সেটা বলবে। শাহরুখের ‘পাঠানে’-ও উঠে এসেছে ভারত-পাক শত্রুতা এবং একই ছাঁচের গল্প রয়েছে সলমানের ‘টাইগার ৩’-তে।


ফলত সেনাবাহিনীর আবেগ এবং দেশাত্মবোধের পিঠে বসে গত এক বছরে বেশকিছু বিগ বাজেট সিনেমা ‘বক্স অফিসের’ সমুদ্র পেরিয়েছে। ‘ফাইটার’-ও তার ব্যাতিক্রম নয়।


অভিনেতা থেকে দৃশ্য-সুন্দর কমোডিটিতে পরিণত হৃতিক


গল্পে বেশিরভাগ চরিত্রের অভিনয় বেশ দুর্বল। আবেগপূর্ণ দৃশ্যে হৃতিকের অভিনয় এত বছর পরেও বেশ দুর্বল। কিছু জায়গায় প্রয়োজনের তুলনায় বেশি আবার কিছু জায়গায় অত্যন্ত কম অভিব্যক্তি তাঁর অভিনয়কে বেশ ক্লান্তিকর করে তুলেছে। দুঃখ, অভিমান, আক্রোশ, প্রতিশোধ অনেক সময়েই মনে হয়েছে এই অভিব্যক্তিগুলো যেন শুধুমাত্র সিচুয়েশনের মাধ্যমে ফুটে উঠছে। অভিনয় সেখানে হারিয়ে যাচ্ছে ভালো দৃশ্যায়নের পিছনে। ‘ওয়ার’ সিনেমার মতোই হৃতিকের স্ক্রিনের এন্ট্রি অসাধারণ ড্রামাটিক। কিন্তু তাঁর চরিত্রকে এস্ট্যাবলিশ করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যাকস্টোরি খুব বেশি জায়গা পায়নি। একই সঙ্গে এটা বলা যায় হৃতিককে হয়ত কিছুটা কমই ব্যবহার করেছেন পরিচালক। সিনেয়ার বেশিরভাগ অংশ জুড়েই আপনার মনে হবে যে হৃতিককে ঠিক যতক্ষণ বিভিন্ন সিনেম্যাটিক ভাবে দুরন্ত অ্যাঙ্গেলে চলতে-ফিরতে, অর্থাৎ বিভিন্নভাবে পোজ দিতে দেখা গিয়েছে সেই দৃশ্য বেশি সুন্দর। অর্থাৎ অভিনেতা হৃতিক এবং কমোডিটি হৃতিকের লড়াইয়ে নিঃসন্দেহে জয়ী কমোডিটি হৃতিক।      


দীপিকা পাডুকোন প্রতিবারের মতোই নিজের অভিনয়ে চেষ্টা করেছেন কিন্তু বার বার তাঁর ‘গ্ল্যাম কোশেন্ট’ তাঁর অভিনয় দক্ষতাকে আড়াল করে দিয়েছে। বাবা-মায়ের সঙ্গে যে দৃশ্যে অভিব্যাক্তির উপরেই সম্পূর্ণ দৃশ্য নির্ভরশিল ছিল সেখানে কম সময় হলেও অভিনয় দিয়ে বাঁচিয়ে দিলেন আশুতোষ রাণা।


অনিল কাপুর এবং অন্যান্য অভিনেতাদের অভিনয়ও দর্শকদের মনে বেশি দাগ কাটতে পারবে বলে মনে হয়নি। 


গা গরম সংলাপ


বলিউড যে তার ছবিতে দেশাত্মবোধের অ্যাঙ্গেলকে সামনে রেখে বাজি মারার লড়িয়ে নেমেছে তার অন্যতম হাতিয়ার সিমেনার সংলাপ। ‘হাউ ইজ দ্যা জোশ’ বর্তমানে ভিকই কৌশলের সঙ্গে সমার্থক হয়ে গিয়েছে। সেইরকমই বেশ কিছু ‘গা গরম’ সংলাপ পাওয়া গিয়েছে এই সিনেমাতেও। দর্শক যে এই ধরনের সংলাপের সঙ্গে বেশ ভালো মাত্রায় রিলেট করছেন তা বেশ বোঝা যায় হাততালির মাত্রা থেকে। শেষ ফাইট ‘সিক্যুয়েন্সে’ ফাইটের থেকেও বেশি প্রাধান্য পেয়েছে সংলাপ। ‘জয় হিন্দ’-এর মানে থেকে শুরু করে ‘পিওকে’-র মানে এবং সেখান থেকে ‘ইন্ডিয়া অক্যুপায়েড পাকিস্তান’ ডায়লগ আগামী বেশ কিছুদিন দর্শকের মুখে মুখে ফিরবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এবং পাশাপাশি হলের বাইরে বেরিয়ে এই সিনেমার কোন অংশ দর্শক সব থেকে বেশি মনে রাখবে তা বলতে গেলে ফাইটার জেটের কসরতের পাশপাশি একটা বড় অংশ জুড়ে থাকবে ডায়লগ।


মনে থাকবে ফাইটার জেটের হাওয়াই খেল


টম ক্রুজ ইতিমধ্যেই আমাদের দেখিয়ে দিয়েছেন ফাইটার জেট নিয়ে ঠিক কী কী করা যায়। ফলত হৃতিকের ফাইটার দেখার পরে অনেকেরই জেট প্লেন নিয়ে দেখানো কসরত নিয়ে খুব বেশি প্রশ্ন জাগবে না মনে। তবে একথা ঠিক যে সেনাবাহিনী সম্পর্কে গবেষণা অন্যান্য সিনেমার তুলনায় ভালো হয়েছে এই সিনেমায়। তাদের আদব-কায়দা, কাজের পদ্ধতি, নিয়মানুবর্তিতা সম্পর্কে অন্যান্য সিনেমার তুলনায় বেশি রিসার্চ করা হয়েছে তা বোঝা যায়।


আরও পড়ুন: Priyanka-Debashis: লালনের সূত্র ধরে ৯২-এর দাঙ্গা! নয়া ছবিতে জুটিতে প্রিয়াঙ্কা-দেবাশিস


জেট নিয়ে শেষবার ‘টেক অফ’ করার দৃশ্য এবং শেষ ফাইট সিক্যুয়েন্স বাদ দিলে অন্যোন্য ক্ষেত্রে অবাস্তব (এবং অবশ্যই অপ্রয়োজনীয়) ‘ডায়লগবাজি’ এই সিনেমায় কম।


এবার যদি আসা যায় ফাইটার জেটের কসরতের প্রসঙ্গে তাহলে সেই ক্ষেত্রেও ভালো রিসার্চের ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু তার পরেই বলতেই হয় যে ‘ডগ ফাইট’ বা অন্যান্য যুদ্ধের সিক্যুয়েন্সে যুদ্ধের থেকেও বেশি প্লেন নিয়ে কসরত দেখানোর উপড়ে ফোকাস করা হয়েছে এখানে। ফলে বলিউডের 'টপ গান' হতে হতেও হল না ‘ফাইটার’।


তাহলে দেখব কেন?


অনেক 'না'-র মাঝেও এই সিনেমার দেখার বেশ কিছু কারণ আছে। আছে অন্যান্য সিনেমার তুলনায় ভালো রিসার্চ, সুন্দর দৃশ্যায়ন। মাথায় গেঁথে যাওয়া গান। এই সিনেমায় আছে আমাদের সকলের ছোটবেলার ফাইটার জেট চালানোর সুপ্ত বাসনা। গতি, জেট প্লেন, ‘ডগ ফাইট’ প্রেমীদের পছন্দের তালিকায় উপরের দিকেই থাকবে ফাইটার।


কী হতে পারত


এই সিনেমা হতে পারত অনেক কিছু। বেরিয়ে আসতে পারত ছক বাধা গল্প থেকে। হতে পারত অভিনয় দক্ষতার অসাধারণ নিদর্শন। কিন্তু দিনের শেষে এই সিনেমা বেশ কিছু অত্যন্ত সিনেম্যাটিক কিন্তু অবাস্তব দৃশ্যে মোরা এক প্রায় অসাধারণ হতে হতে না হওয়া সিনেমাই রয়ে গেল। পুলওয়ামার ঘটনা যখন দেখানো হচ্ছে তার ঠিক আগে সিআরপিএফ-এর বাস থেকে দেশে পতাকা ওড়ানো এবং প্রত্যুত্তরে হেলিকপ্টারের দরজায় দাঁড়িয়ে হৃতিকের পতাকা ওড়ানোর মতো অবাস্তব দৃশ্যের প্রয়োগ না হলেও এই সিনেমা ‘বেশ ভালো’ বলেই গণ্য হতে পারত দর্শকদের
মনে। 


সিনেমার প্রায় শেষ লগ্নে যখন ফাইটার জেটকে মুহুর্তে আকাশে তোলা গুরুত্বপূর্ণ সেখানে এতক্ষণের ‘ডায়লগবাজির’ প্রয়োজনীয়তা নিয়েও দর্শকদের মনে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। মোদ্দা বিষয় হল যেখানে সিনেরমার মূলে থাকা জেট প্লেনের লড়াইকে আরও সুন্দর করে দেখিয়ে পুরো সিনেমা সাজানো যেত সেখানে ডায়লগের অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার সিনেমাকে আকারে বাড়িয়েছে কিন্তু গুণে বাড়ায়নি।


অবশেষে


বলিউডের সিনেমাকে এবার এই চেনা ছক ভেঙে বেরতে হবে নাহলে কিছুদিন পরেই আর এই একই ধরনের গল্প দর্শকদের মনে দাগ কাটবে না। পাকিস্তানি বোঝাতে গেলেই অভিনেতার চোখে সুরমা ব্যাবহার না করলেও হয়। বিশেষ করে যখন সে জেট প্লেন চালাচ্ছে বলে দৃশ্যে দেখানো হচ্ছে। পাশপাশি পাকিস্তানি বোঝাতে 'জনাব' এবং অন্যান্য উর্দু শব্দের ব্যবহারের বর্ধিত মাত্রা সিনেমাকে গুনগত দিক থেকে কিছুটা জোলো করে দেয়।


শুধুমাত্র সিনেম্যাটিক ফ্রেম, কথায় কথায় দেশের পতাকা দেখানো, 'জোশ' বাড়ানো ডায়লগ দিয়ে শর্টকাটে কোটি কোটি টাকা কামাইয়ের রাস্তায় একটানা হাঁটতে থাকলে বলিউডের কপালে বেশ দুঃখ আছে। ছক ভাঙতে হবে। তবেই দর্শকের মনে জায়গা করা যাবে নাহলে শুধুই দর্শকের পকেটে জায়গা করেই খুশি থাকতে হবে নির্মাতাদের। এতে ব্যবসা তো হয়ে যাবে কিন্তু শৈল্পিক বিকাশ হবে না তা বলাই যায়।


(দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির টাটকা খবর, আপডেট এবং ভিডিয়ো পেতে ডাউনলোড-লাইক-ফলো-সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের AppFacebookWhatsapp ChannelX (Twitter)YoutubeInstagram পেজ-চ্যানেল)