রহস্যভেদী কিরীটী স্টাইলে এলেন, জয় করলেন
শীতের রাতে বর্ষশেষে এসে গোয়েন্দা রহস্যভেদী কিরীটী কি ভাঁজ ফেললেন মিস্টার বক্সী আর মিস্টার প্রদোষ মিত্রের কপালে? গবেষণায় শর্মিলা মাইতি
ছবির নাম- কিরীটী রায়
রেটিং- ****
ঘুমিয়ে আছে গোয়েন্দারা সব বাঙালির অন্তরে। অথবা বলা চলে এই শীতে তারা তেড়েফুঁড়ে জেগে উঠেছেJ শীত পড়তে না পড়তেই হাড়-হিম করা সব রহস্যের সমাধান। এ বছরশেষটা কিন্তু জমে উঠল কিরীটীর আবির্ভাবে। সাড়ে ছ ফুট লম্বা, ফরসা, ব্যাকব্রাশ করা কোঁকড়ানো চুল। কিরীটী সত্যিই এলেন নিজের স্টাইলে এবং আত্মপরিচয়ে বলীয়ান হয়ে। নীহাররঞ্জন গুপ্তের কাহিনির নায়ক, যিনি কয়েক দশকের পাঠকের চোখের ঘুম কেড়ে নিয়েছিলেন। সে ছিল বালিশে নীহার অমনিবাস রেখে গোগ্রাসে কিরীটী গেলার সময়। তার পর এত কাল বাদে রুপোলি পর্দা আলো করলেন শালপ্রাংশু কিরীটী। আবির্ভাবেই একহাত নিলেন প্রতিযোগীদের। মিস্টার মিত্র এবং মিস্টার বক্সীকে।
কিরীটীর ফার্সিট ডে ফার্সিট শো দেখে মনে হচ্ছিল, প্রতিযোগিতা কি সত্যই চলে। নাকি গজেন্দ্র মিত্রর সেই বক্তব্যটাই ঠিক, যার সারমর্ম দাঁড়ায়, কিরীটী মগজাস্ত্রে নয়, ধীশক্তির বিচারে নয়, শোম্যানশিপে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীদের থেকে এগিয়ে। প্রথমদুটি সহজসাধ্য। মহিলামহলে অসম্ভব জনপ্রিয় এই কাল্পনিক রহস্যভেদীকে ডাক্তার নীহাররঞ্জন গুপ্ত এমন একটি স্বভাবগাম্ভীর্য দিয়েছেন, যা আসলে একটি সম্মোহের বাতাবরন তৈরি করে। কিরীটী অমনিবাসের কভার ডিজাইন করেছিলেন প্রয়াত শিল্পী শৈল চক্রবর্তী। এই শৈল চক্রবর্তীরই পুত্র চিরঞ্জিত চক্রবর্তী। তিনি যে কিরীটী চরিত্রে অভিনয় করবেন, এ যেন ইতিহাসেরই বিধান। তবুও মাঝখানে কেটে গেল এতগুলো বছর। একটি সাক্ষাত্কারে তিনি আমায় জানিয়েছিলেন, কিরীটীর চরিত্রটি করবেন বলে অনেকের কাছেই মৌখিক অনুমোদন করে রেখেছিলেন। তা সত্ত্বেও হাতে এল পনের বছর পর। যা হয়েছে, ভালর জন্যেই। কারণ, এত দিনে মুগ্ধ পাঠক-পাঠিকারাও বাণপ্রস্থের গোড়ায়। তাঁরা সেই মোহাচ্ছন্নতা কাটিয়ে অনেকটাই বাস্তববাদী। কাজেই, পর্দায় কিরীটী যে একটু বেশি বয়সেই আসবেন, আরও একটু পরিণত মস্তিষ্কই নিয়ে আসবেন, তাতে আর বিচিত্র কী!
তবু প্রথম দর্শনেই ধাতস্থ হতে সময় লাগবে। কিরীটী মধ্যবয়স্ক, যৌবন পেরিয়ে এসেছেন সবে। তবে পুরো ব্যাপারটাই কফিতে চুমুক দিয়ে আস্তে আস্তে উত্তাপটা আহরণ করার মতোই সুললিত। কিরীটী ফেলুদার মতো আধুনিক নন। পঠনপাঠন থেকে মগজে ফুড ফর থট আসেনা। ফেলুদাকে আমরা দেখেছি, বিভিন্ন কিসিমের বই পড়তে, আর সমসাময়িক কেসগুলোর সমাধানসূত্রও সেই বইয়ের পাতা থেকেই আহরণ করতেন। রিডিং বিটুইন দ্য লাইনস যদি হয় ফেলুদার সিক্রেট, তবে কিরীটীর অস্ত্র হল রিডিং বিটুইন পিপলস স্প্লিট পারসোন্যালিটিজ। তিনি ব্যোমকেশের মতো সংযতবাক নন, যথেষ্ট কথা বলেন। কথায় কথায় চাপে রাখার চেষ্টা করেন সন্দেহভাজনকে। যেটা সেতারের সুর-এও খুব স্পষ্ট। কিরীটীর ভাষায় জলের মতো পরিষ্কার। যাঁরা ইতিমধ্যে নীহাররঞ্জন গুপ্তর কাহিনি পড়েছেন এবং অনিকেতের ছবি দেখার প্রবল ইচ্ছে রাখেন, তাঁদের বলি, নীহারবাবু যেমন উপন্যাসের তারে সুর তুলতেন একেবারে অন্তরা থেকে। কোনও সঞ্চারী নেই, নেই কোনও আলাপচারণের ভণিতা। এক্কেবারে সোজাসুজি গল্পে ঢুকে যাওয়া। এখানে অনিকেত কিন্তু ফিল্মমেকিং-এর অর্ডার মেনে ধাপে ধাপে খোলস খুলেছেন, তীরগতিতে নয়। অডিয়েন্সকে সময় দিয়েছেন।
অন্যদিকে এখনও পর্দা কাঁপাচ্ছেন এক জোড়া ফেলুদা এবং একজন অ্যাকশনপ্যাকড ব্যোমকেশ। দুজনেরই অস্ত্র উত্তুঙ্গ, পরীক্ষিত জনপ্রিয়তা। সব্যসাচী যতই বয়সে বাড়ুন, ফেলুদাও তাঁরই সঙ্গে পরিপক্ক হন। সাহিত্যের বন্ধন কাটিয়ে পুরোপুরি পরদায় একরকম তাঁরই অঙ্গুলিহেলনে ফেলুদার কেরিয়ার চলছে। তোপসের বয়স কিন্তু সেই অনুপাতে বাড়ছে না। তোপসের ভূমিকাও হয়ে উঠছে নেহাতই পার্সোন্যাল অ্যাসিস্ট্যান্টের। লালমোহনবাবুও তেমন রেগুলার নন। অন্যদিকে ব্যোমকেশ আর অজিত অভিন্নহৃদয় বন্ধু। বাস্তবে স্র্ষ্টা শরদিন্দুর একরকম এক্সটেনশন। তাঁর বাস্তবের বন্ধু অজিতেরই চিত্ররূপ এই অজিত চরিত্র। কিন্তু কিরীটীর ক্ষেত্রে প্রাইভেট ডিটেকটিভ আর অ্যাসিস্ট্যান্টের মেলবন্ধনটা সম্পূর্ণ অন্য স্বাদের। বন্ধুত্বই বেশি গাঢ়। সাহিত্যিক হিসেবেই শুধু বেঁধে রাখা যায় না সুব্রতকে। সঙ্গে একজন পুলিশ অফিসার রথীনের রসায়ন মিলেমিশে গেল এই হরস্যভেদী ল্যাবরেটরিতে। কিরীটী নিজেই বলে উঠছেন, শহরে যদি একমাত্র পারফেক্ট মার্ডার হয়, তবে সেটা করবেন তিনিই। রসে-বশে-লুচি-আলুর ছেঁচকি-রাজনীতির টোটকা এবং রহস্যভেদে এমন মাখোমাখো সম্পর্ক আর একটিও দেখা যায়নি। এমন একটা সম্পর্ক, যা কেবল তিনজন অভিনেতার মধ্যে পর্দার বাইরের বন্ধুত্ব থাকলেই ঘটতে পারে। পরিচালকের অভিনেতা হলেই হয়না। কৌশিক গাঙ্গুলির অভিনয়টা না থাকলে পুরোটা শেষ হত না। অনেকটা পঞ্চাননের বোমার সাইজের রাজভোগের মতো। না থাকলে লুচি-চচ্চড়ির প্যাকেজটা কমপ্লিট হয়না!
এই কেমিস্ট্রিটা কিন্তু মিসিং ফেলুদা আর ব্যোমকেশের দুটি ছবিতে। মিসিং না বলে বলা ভাল, প্রয়োজন হয়নি। রহস্যভেদী কিরীটীর প্রধান খাদ্য বিভিন্ন রঙের মানুষ। সেতারের সুর উপন্যাসের বাসবী থেকে জেনিফার থেকে বিভাস সান্যাল, এমনকি বাড়ির পরিচারিকা বাসন্তী ও শ্যামা। কিংবা বাসবীর গুণমুগ্ধ পাঁচ প্রেমিক, সবারই মস্তিষ্ক আর গতিবিধি ছানবিন করে দেখেন। বড় অনায়াসে।
নীহারবাবুর নারী চরিত্ররাও গভীর। সাদা-কালোয় একপেশে নয়। জেনিফারের রূপে স্বস্তিকা প্রাণবন্ত। বিশেষ করে বৃদ্ধাবেশে তিনি নিজের প্রতিভা মেলে ধরার সুযোগ পেলেন। আন্ডারটোনড অ্যাক্টিং আর পরিণতমনস্কতা, দুচোই যুক্ত হল। সায়নী আর কাঞ্চনার কথা বিশেষ করে বলা দরকার। প্রথমবার সায়নী এমন একটি বর্ণময় চরিত্র পেলেন। স্ক্রিন প্রেজেন্স অনবদ্য। ভঙ্গিমা ও স্টাইল রপ্ত করেছেন ভালই। সুসির চরিত্রে বারসিঙ্গারের যে ঝলক আপনারা প্রোমোদেই দেখেন, সেই মুগ্ধতার সুরটা কোথাও ছেঁড়ে না। এই ফাঁকে জয় সরকারের কথাটাও বলা দরকার। রাগ তিলক্ক্ামোদ এমন অপূর্ব সুরমূর্ছনা যে গোয়েন্দাকাহিনিকেও বাড়তি আবেগ দেয়, সেটা জানা ছিল না। শুধু আবেগ নয়, ইন্ডোর ড্রামাকেও এক পর্দা বেশি রোমহর্যক ক্লাইম্যাক্সে নিয়ে যেতে পারে।
ত্রিশ থেকে ৬০ দশক পুরোটাই ইন্ডোরে ক্রিয়েট করা মেগাসিরিয়ালের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে। এই চ্যালেঞ্জটা সসম্মানে উতরেছেন অনিকেত চট্টোপাধ্যায়। টুকটাক রাজনৈতিক আলোচনার মাধ্যমেই উঠে আসছে সমকালীন রাজনৈতিক বাতাবরণ। কংগ্রেস চাইছিল বাংলা বিহার এক হোক। সিপিআই তার সম্পূর্ণ বিরোধিতা করছিল। এই মর্মে কিন্তু জয় হল সিপিআই-এর। সেই রাজনৈতিক চিত্র হঠাত্ এমন নস্টালজিয়া ক্রিয়েট করল যা বর্ণনার অতীত। সত্যিই ম্যাজিক!
এককথায়, চিরঞ্জিতের মাধ্যমেই আমরা পরিপূর্ণ কিরীটীর একটুকরো বরফ ভেসে উঠতে দেখলাম। জলের গভীরে আছে আরও বিশাল চাঁই। সেটা দেখার জন্যে আরও বেশ ক বছর অপেক্ষা করতেই হবে। অন্তত গোটাপাঁচেক কিরীটী উপন্যাস যেন এঁর মাধ্যমেই উদ্ভাসিত হয়। পরদায়।
আরও পড়ুন, আমিরি সাম্রাজ্যে নারীদের রাজ্যপাট, স্বাধীনতার উড়ান