আমিরি সাম্রাজ্যে নারীদের রাজ্যপাট, স্বাধীনতার উড়ান
শর্মিলা মাইতি
ছবির নাম- দঙ্গল
রেটিং- ***1/2
সদ্য ভারতের সমস্ত প্রেক্ষাগৃহে ফিল্ম শো শুরুর আগে জাতীয় সঙ্গীত বাধ্যতামূলক হয়েছে। আর দঙ্গলই প্রথম ছবি যাতে শুরুতে সব তদর্সক দাঁড়িয়ে সম্মান জানালেন, আর ফিল্ম চলাকালীন ক্লাইম্যাক্স মুহূর্তে ব্যাকগ্রাউন্ডে জাতীয় সঙ্গীত বেজে ওঠার সময় দর্শককে দেখা গেল স্বতঃস্ফূর্তভাবে সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে। ইদানীং স্পোর্ট্স ফিল্মের ঘরানায় একটা বিপ্লব ঘটে গিয়েছে। বহুকাল যাবত্ এই গতি, স্বয়ংক্রিয়তা আর টেকনিক দেখার জন্য আর হলিউডি ছবির অপেক্ষা করতে হচ্ছে না। ধার করতেও হচ্ছে না। স্বদেশের টেকনিশিয়ানরা যে যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য সেটা বার বার প্রমাণিত হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে আমার একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার জানানোর লোভ সামলাতে পারছি না। অনেকেরই জানা নেই, বড় বড় হলিউডি অ্যানিমেশন ছবির পুরোটাই বানানো হয় এ দেশের অ্যানিমেশন আর্টিস্টদের দিয়ে। বানিয়ে আউটসোর্স করা হয় বিদেশে। সেই সব টেকনিক্যাল হ্যান্ডস-এর নামই কেউ জানতে পারেন না। যা হোক, এ বছর সাক্ষী অলিম্পিক মেডেল জিতলেন সবাইকে অবাক করে। তিনিও জন্মসূত্রে হরিয়ানভি। আর এ বছরই দু দুটো বিগ বাজেটের ছবি আমরা পেলাম কুস্তিগিরের জীবনী নিয়ে। সলমন আর আমির, যুযুধান দুই খান। স্ট্র্যাটেজিক্যালি কেউ কারওকে ওভারল্যাপ করেননি। দর্শক ভাগাভাগি হয়নি। মনন আর বিজনেস, দুটোর উপরেই অধিকার কায়েম করতে পেরেছেন। প্রথম দিনে যদিও আমিরের ছবি কালেকশনে পিছিয়ে থাকতেও পারে। কিন্তু আমিরি চালে অনেক বেশিদিনই এ ছবি সিনেমাহল আলো করে রাখার দাবি রাখে।
নারী স্বাধীনতার জন্য আমরা নানাবিধ পরিকল্পনা, বক্তৃতা শুনে থাকি। হরিয়ানার প্রত্যন্ত গ্রামের এক কুস্তিগির তাঁর দুই মেয়েকে নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, স্বপ্ন সাকার করতে যে-যে কঠিন পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন তা জেনে আজকের দিনে অবাক হতে হয়। নারীর সমানাধিকারের প্রশ্ন তুলতে গিয়ে অনেক সময়েই আমরা অলিগলিতে হারিয়ে যাই। বাকবিতণ্ডায় আসল উদ্দেশ্য কোথায় হারিয়ে যায়। পুরুষের মতো হয়ে ওঠা, নারীত্বের সংজ্ঞায় যে-যে বৈশিষ্ট্যগুলোকে সম্পদ বলে মনে করা হয় সেগুলোকে সম্পূর্ণ বর্জন করা। কথাগুলো যত সহজ শব্দে লেখা হল, ততটা সহজ নয় একেবারেই। দঙ্গল দেখে মনে হল, সেই বাকস্বাধীনতা যা পুরুষ তথা পিতা চাপিয়ে দিচ্ছেন কন্যাদের উপর, সেই স্বাধীনতার উড়ানেই দেশের মুখ হয়ে উঠছে তারা। হঠাত্ যেন প্রবল জোরে ধাক্কা দিল কেউ। নারীদের শৈশব, পেলবতা, মাধুর্য্য এমনকি সৌন্দর্যও ছিনিয়ে নিয়ে পথ দেখানো, লক্ষ্মণরেখা পেরনোর ধৃষ্টতা বুকে এনে দেওয়া- এ সবই করলেন এক কুস্তিগির। সমাজের তোয়াক্কা না করে। নাম মহাবীর সিং ফোগত। মাটির আখড়ায় নিয়মিত কুস্তি লড়তে লড়তে চল রুক্ষ্ম হয়ে যাচ্ছে, গীতা-ববিতার চুল কাটার দৃশ্যটা যেন হাতুড়ির মতো ঘা দেয়। এই হরিয়ানাতেই ক্রমাগত কন্যাভ্রূণ ও শিশুকন্যা হত্যার হার এতই বেশি যে, আঁতকে উঠবেন সবাই। আর এই স্বাধীনতারেখার সঙ্গে বেণীর মতো জড়িয়ে গেল জাতীয়তাবোধ। এ এক অন্য বিপ্লব। ব্যক্তিগত সুখ আহ্লাদকে পুরোপুরি বর্জন করে দেশের জন্যে কুস্তি লড়া। মেডেল জেতা সব নারীদের জন্য, যাঁদের বয়স হতে না হতেই বিয়ে হয়ে যায়, বয়স হতে-না-হতে বিয়োতে হয়, আর তারপর বয়স হতে না হতে বুড়িয়ে যায়।
নিজেকে আমূল বদলেছেন আমির। তবে অবাক করে আমিরের উদারতা, সবাইকে ঢালাও জমি দিয়েছেন, জায়গা দিয়েছেন অভিনয় করবার। ফতিমা সানা শেখ ও সান্যা দুজনের অভিনয় দেখে সত্যিই বাকরুদ্ধ হবে। সৌন্দর্যের অন্য সংজ্ঞা, নারীত্বের অন্য উদ্দেশ্য। অপূর্ব ক্যামেরার কারিকুরি। কুস্তির প্যাঁচ শেখা আর সেটাকে বিশ্বাসযোগ্যভাবে ক্যামেরায় তুলে ধরা, কী অসম্ভব স্বাচ্ছন্দ্য। কী অপূর্ব বলিষ্ঠতা। এঁরা দুজনই দর্শককে আটকে রেখে দেবে। সুলতান ছবির অনুষ্কা শর্মাকে এদের কাছে নস্যি মনে হবে। প্রাণ দিয়েছে প্রিতমের মিউজিকও। ছন্দোবদ্ধতার মধ্যেই যে জাতীয়তাবাদের স্পিরিট ঢোকালেন কীভাবে, শুনলে সত্যিই গর্ববোধ হয়।
খেলার মধ্যেও আছে রাজনীতি। বাস্তবেও আর পর্দাতেও। নাহলে কাহিনি টানটান হয় না। এখানেও সে মালমশলা আছে। তাই মাঝপথে ছবিটিকে স্লো মনে হবে। কিন্তু সেইটুকু সেলাই করে দিলেন আমির নিজে। যদিও তিনি এ ছবিতে অল-ইন-অল চেহারা থেকে বেরিয়ে এসেছেন। বদলে ফেলেছেন খোলস। একেবারে আম হরিয়ানভির মতো চেহারা বানিয়েছেন। শেষে এটুকুই বলার, সলমনের কাঁধে অনেকটাই ভর করে ছিলেন সুলতান, কিন্তু আমিরের সাম্রাজ্যে নারীদের রাজ্যপাট অনেকটাই। এটাই তফাত।