সৌভিক মুখোপাধ্যায়


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

আবার একটা পুজো এসে গেল। নির্ঘন্ট মেনে যে পুজোর শুরু, তার শুরু বাঙালির বেস্ট সেলার বই পঞ্জিকা বা পাঁজি ধরে। আর এই পাঁজির হাত ধরেই টাইম মেশিনের ঈশ্বরের মর্তে আসার অবিরল আনন্দ দিয়ে গিয়েছে বাঙালিদের। এখনও পর্যন্ত প্রথম ছাপা পঞ্জিকার বয়স ১৯৫ বছর। ১৮১৮ সালের আগে ছাপা কোনও পঞ্জিকার সন্ধান পাওয়া যায়নি। পি.এম.বাগচি-র পঞ্জিকা প্রথম প্রকাশিত হয় সম্ভাবত ১৮৮৮ সালে। সচিত্র পঞ্জিকার আদর্শ ধরা হয় এটিকে।


পঞ্জিকা কী? পঞ্জিকা কেন? সেই কবে থেকেই এই সব বিষয় নিয়ে গবেষণার অন্ত নেই। ফলে, মতান্তর অব্যাহত। পঞ্জিকার রকমফের রয়েছে। গার্হস্থ্য, ডাইরেক্টরি, ফুল, হাফ বা পকেট পঞ্জিকা। তিথি-নক্ষত্র, পূজা-পার্বন, যাত্রা, শুভকর্ম, বারবেলা-কালবেলা, অমৃতযোগ ইত্যাদি। জ্যোতিষ রচনার্থে পঞ্জিকার অস্থি-মজ্জা-রস-রক্ত। কিন্তু পি.এম.বাগচি কোম্পানি প্রথমে পঞ্জিকা ছাপানোর কথা  ভাবেনি। ১৮৮৩ সালে প্রথম লেখার কালি তৈরির ব্যবসা শুরু হয়েছিল। পি.এম.বাগচি নামাঙ্কিত প্রতিষ্ঠাটির ইতিহাসের পাতা ওলটালেই অনেক অবাক করা তথ্যের পাশাপাশি এই প্রতিষ্ঠানের নানা কৃতিত্বের অধিকারী আর পুরস্কৃত হওয়ার খবর পাওয়া যায়।



আসলে বাঙালিরা যে আত্মবিস্মৃত জাতি, তার উদাহরণ এই যে, কিশোরীমোহন বাগচিকে যথাযথ মনে না রাখা। ১৮৮৩ সালে ভারতবর্ষে প্রথম বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় কালি প্রস্তুত করে পি.এম.বাগচি অ্যান্ড কোং। কিশোরীমোহন এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পাস দিয়ে তার স্কলারশিপের নামমাত্র টাকায় এই কালি তৈরির কারবার শুরু করেন। আজব হলেও সত্যি! কালি সম্পর্কিত সচিত্র একটি পুস্তিকা প্রকাশিত ও প্রচারিত হয় 'এনি লাইন'-এ।



রাসায়নিক কালি প্রথম আবিষ্কৃত হয় ১৮৭৯ সালে জার্মানিতে। আর তার মাত্র চার বছর পরে ১৮৮৩ সালে ভারতবর্ষে প্রথম কালি প্রস্তুত করেন পি.এম.বাগচি অ্যান্ড কোং। কিশোরীমোহন রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে সম্পূর্ণ ভেষজ পদ্ধতিতে এক স্থায়ী উজ্জ্বল এবং অতুলনীয় কালি আবিষ্কার করেন। যার পরিচিতি ঘটে সরস্বতী মার্কা কালি হিসাবে। সেই সময়ে এই সরস্বতী মার্কা কালি বিখ্যাত ছিল। কিশোরীমোহন এই কালির জন্য উচ্ছ্বসিত এবং বিখ্যাত মানুষের কাছ থেকেও প্রশংসিত হন। এই সবের মধ্যে একটা কথা না বললেই নয়, তা হল, রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতৃস্মৃতি গ্রন্থে উল্লিখিত একটি কাহিনি। সেখানে লেখা হয়- কত না বিচিত্র প্রকৃতির ছাত্র এসে তখন জুটত আশ্রমে। আমাদের ব্যবহারের জন্য এক বোতল পি.এম.বাগচির কালি থাকত ঘরে। একটি ছেলের কথা মনে পড়ে। সে লেখাপড়ার প্রতি বিতৃষ্ণ। লিখতে যাতে না হয় তাই সে একদিন বোতলের সব কালি কোন সময়ে ঢকঢক করে খেয়ে খালি বোতলটি তাকের উপর রেখে দিল। (পিতৃস্মৃতি: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১৩ অঘ্রায়ণ, ১৩৭৩)


কিশোরীমোহন বাগচি, প্যারিমোহন বাগচির বড় ছেলে। কোম্পানির নাম তাঁর নামেই। কালির স্বর্গে চুলের তেল, সেন্ট, রবার স্ট্যাম্পও তৈরি করা হত। কিন্তু সেই সময়ে মিডিয়া কোথায়? প্রোডাক্টের বিজ্ঞাপন কীভাবে হবে? কিছু ইংরেজি কাগজ ছিল। কিন্তু গ্রামের মানুষ ইংরেজি বুঝবেন কি করে। পঞ্জিকাই ছিল দেশের মানচিত্র জুড়ে সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম। বাজার চলতি পঞ্জিকাতেই বিজ্ঞাপন দেওয়া হত। কিন্তু বিজ্ঞাপনের ছাপার মান যথেষ্ট গুণসম্পন্ন না হওয়ায় কিশোরীমোহন নিজেই পঞ্জিকা প্রকাশ করেন।


পঞ্জিকা কী ও কেন, এটি আমার আলোচ্য বিষয় নয়। আসলে পি.এম.বাগচি পঞ্জিকার সঙ্গে ডাইরেক্টরি বের করত। পরবর্তীকালে সর্বভারতীয় ডাইরেক্টরি প্রকাশ করে এরা। সেসময়ে পঞ্জিকায় কত রকম বিজ্ঞাপন বেরতো এর জন্য আরও প্রায় ৫০০ পাতা অতিরিক্ত দিতে হত। এই পঞ্জিকায় বিজ্ঞাপন আমার আগ্রহের। মধ্যবিত্ত বাঙালির কথা কলকাতার সমাজের এক অসম্ভব সুন্দর প্রতিফলন পাওয়া যায়। ১৮৯৯ সালে পি.এম.বাগচির যে ডাইরেক্টরিটি পাওয়া যায়, তা দু-খণ্ডে প্রকাশ পায়। যা দেখলে আমাদের অবাক হতে হয়। এতে ছিল অবিভক্ত ভারতের বর্তমানের ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, বার্মা এবং শ্রীলঙ্কার ভৌগোলিক খণ্ডের মানচিত্রে অবস্থিত প্রতিটি বিষয়ক জীবনীপঞ্জি। তার সঙ্গে রয়েছে তত্ত্ব ও তথ্য। ছিল ভারতের ৫১ পীঠ পরিচয়। পরিমাপ প্রণলি (মাপ, ওজন, কাগজের মাপ ইত্যাদি) লিমিটেশন অর্থাত্ আমাদের বিষয় ও সময় মাপক সংক্রান্ত খরচ (উকিল ফি ও কোর্ট ফি সহ)



মাসমাইনের টাকা প্রতি হিসাব, মিউনিসিপ্যাল লাইসেন্স ও ট্যাক্সের হার, বঙ্গদেশের খাজনা বিষয়ক আইন, পোস্ট অ্যান্ড টেলিগ্রাফ সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য। হিন্দু আইন বিস্তৃত অ্যালোপ্যাথি ও হোমিওপ্যাথি, গৃহ চিকিত্সা, কলকাতার কোন কোন দ্রব্যের পাইকারি বাজার কোথায়। অখণ্ড ভারত-সহ বার্মা সিলোন-এর সংবাদপত্র সকল, বড়লাট-সহ বিভিন্ন পদস্থ সরকারি কর্মচারীদের পদ-সহ নাম, হাইকোর্ট অব জুডিকেটর, হাইকোর্ট (কোন আইন ব্যবসায়ীর কত ফি) কাদের প্রধান প্রধান অফিস ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-সমূহের পরিচয়। এর সঙ্গে থাকত কলকাতার স্ট্রিট ডাইরেক্টরি। যেখানে থাকত প্রতিটি ফাঁকা জমি, রাস্তা বা গলির নম্বর যুক্ত বাড়িগুলির মালিকের নাম বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, দোকান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এই ডাইরেক্টরিকে কেউ কেউ কলকাতার কোষ বলেও উচ্চারণ করেছেন। যা নেই ডাইরেক্টরিতে, তা নেই কলকাতায়।



আসলে, আগেই যা বলেছিলাম,  পঞ্জিকা বা পি.এম.বাগচির গুণকীর্তন করার জন্য আমার এই লেখা নয়। আসলে পুরনো কলকাতা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আলাপ হয় এই কোম্পানির আজকের অন্যতম পুরুষ পি.এম.বাগচির সঙ্গে। চিত্পুর নিয়ে কাজ করার সময়ে এই পি.এম.বাগচি দা আমার মন-মননের ভালোলাগাগুলোকে এত বেশি করে প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছেন, আনন্দের পরিসরে আমাকে এনে দিয়েছেন যে, আজ সেগুলোই ভাগ করে নিতে মন চাইল।



পি.এম.বাগচির উত্তরসূরি পীযূষ বাগচি (বাঁদিক থেকে দ্বিতীয়)


ই-নৈবেদ্য পড়ুন- ২৪ ঘণ্টার সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে ইমন চক্রবর্তী


ই-নৈবেদ্য পড়ুন- থিয়েটার এবং থিয়েটার


ই-নৈবেদ্য পড়ুন- ঝুলন শব্দের মানে হল, মেয়েরাই অগতির 'গতি'


ই-নৈবেদ্য পড়ুন- আদর্শ শঙ্কর, দুর্গমকে সুগম করাই প্যাশন অভিযাত্রী অনিন্দ্যর