Tagore Death Anniversary: `সমুখ দিয়ে স্বপনসম/যেয়ো না মোরে হেলায় ঠেলে`
কবির মননে কী ভাবে যেন মৃত্যু ও শ্রাবণ একাত্ম হয়ে পড়ে।
সৌমিত্র সেন
তিনি বৈশাখের জাতক, কিন্তু শ্রাবণ তাঁর মৃত্যুমাস। সেই-শ্রাবণ, যাকে তিনি জীবনের শোকে-দুখে-সুখে মরমে-মরমে পরতে-পরতে আবিষ্কার করেছেন। এ-হেন শ্রাবণদিন তাঁর মৃত্যুদিন হয়ে থেকে গেল। এবং নানা রবীন্দ্রনাথের একখানি মালা হয়েও তবু মৃত্যুদিনে রবীন্দ্রনাথ কী ভীষণভাবেই-না আদ্যন্ত 'কবি'ই থেকে গেলেন!
যে-বর্ষামাসকে (Rainy Season)একটি জাতির হয়ে নিভৃতির অমিত সংরাগে উজ্জীবিত করেছিলেন তিনি জীবনভর, তাঁর মৃত্যুলগ্নে সেই-বর্ষণের মধ্যে দিয়েই সেই জাতি শোকস্তব্ধ হয়ে ফিরে দেখল তাঁর অন্যতম প্রিয় এই কবিকে (Poet)। যিনি মৃত্যুকে ভয় পেয়েছেন, মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন, মৃত্যুকে অনুভব করেছেন, মৃত্যুকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবেছেন, আবার মৃত্যুকে অতিক্রমও করেছেন। যিনি অচলায়তন ভাঙার গান গেয়ে গিয়েছেন। অথচ তখন, সেই প্রবল শ্রাবণদিনে তাঁর সুদীর্ঘ দেহ একটি অচল আয়তন বই আর কিছু নয়!
আরও পড়ুন: সব রকম সংকীর্ণতার নাগপাশ ছিন্ন করার গ্রীষ্মসাধনই তাঁর নিজস্ব 'বৈশাখ'
কবির মৃত্যু নেই! কবি এক হিসেবে মৃত্যুঞ্জয়ী। কিন্তু মৃত্যুভাবনা? সচেতন শিল্পিত মন মাত্রেই মৃত্যু বাদ দিয়ে জীবনের কথা ভাবতে পারে না। কেননা, তার অখণ্ড দৃষ্টিতে জীবন ও মৃত্যু একাকার হয়ে যায়।
রবীন্দ্রনাথের (Rabindranath Tagore) কবি-মনটির ক্ষেত্রেও তা ঘটেছে। 'নৈবেদ্য' কাব্যগ্রন্থের 'মৃত্যু' কবিতায় লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ-- 'মৃত্যুও অজ্ঞাত মোর। আজি তার তরে/ক্ষণে ক্ষণে শিহরিয়া কাঁপিতেছি ডরে।' কিন্তু আর কয়েক চরণ পরেই আসে--'...মৃত্যুর প্রভাতে/সেই অচেনার মুখ হেরিবি আবার/মুহূর্তে চেনার মতো।' 'উত্সর্গ' কাব্যগ্রন্থের 'মরণমিলন' কবিতায় মৃত্যু-ভাবুক রবীন্দ্রনাথ যেন অনেক বেশি প্রস্তুত, প্রজ্ঞাস্থিত। গোটা কবিতাটায় ধুয়োর মতো শুধু ওঠে--'ওগো মরণ, হে মোর মরণ' চরণধ্বনি, প্রায় মরণের চরণধ্বনির মতোই।
মৃত্যু (Death) কত বিভঙ্গে কত বৈভবে কত অনুরণনে, কত অনুভবে যে ধরা দিয়েছে কবির লেখায়। আর শ্রাবণ? তার-ও তো ইয়ত্তা নেই। 'ওগো আমার শ্রাবণ-মেঘের খেয়াতরীর মাঝি,/অশ্রুভরা পুরব হাওয়ায় পাল তুলে দাও আজি।'-র নানা তির্যকতা, কৌণিকতা, নানা বাঁক ও বেদন ঘুরে-ঘুরে সারা জীবন ধরে তাঁর শ্রাবণসাধনের সঙ্গী হয়ে পড়েছে।
কত দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যাবে? 'শ্রাবণ, তুমি বাতাসে কার আভাস পেলে', 'শ্রাবণবরিষণ পার হয়ে', 'শ্রাবণমেঘের আধেকদুয়ার', 'শ্রাবণ হয়ে এলে ফিরে', 'শ্রাবণের গগনের গায়', 'শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে', 'শ্রাবণের পবনে আকুল বিষণ্ণ সন্ধ্যায়', 'শ্রাবণের বারি ধারা' 'আজ শ্রাবণের আমন্ত্রণে' 'আজ শ্রাবণের পূর্ণিমাতে' --এই সব গানে কবি শ্রাবণবাতাস, শ্রাবণবরিষন, শ্রাবণমেঘের কাব্য রচনা করেছেন। কিন্তু এসব তাঁর বর্ষাগানের শ্রাবণ-অনুভববের এক ও একমাত্র অভিমুখ নয়। বরং একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যায়, তিনি আসলে শ্রাবণের সঙ্গে মৃত্যুকে গেঁথে গেঁথে দেখতে চেয়েছেন; হয়তো এই দেখাটা তাঁর অবচেতনের মধ্যে দিয়েই অনেকাংশে সম্পন্ন হয়েছে, কিন্তু এটা খুব নিরুচ্চারে নিভৃতে ঘটেছে তাঁর শ্রাবণপংক্তিমালায়। এ কথা ভীষণ ভাবে সত্য যে, তাঁর শ্রাবণগানে তিনি অধিকাংশ সময়েই নীপবনগন্ধঘন অন্ধকার খুঁজেছেন, খুঁজেছেন সিক্ত বকুলে ঢাকা বনতল, কখনও খুঁজেছেন ঘন রস-আবরণে ঢাকা অরণ্যতল, পেয়েছেন গোপন কেতকীর পরিমল, অনুভব করেছেন বাদল-হাওয়ার দীর্ঘশ্বাসে যূথীবনের অতল বেদন।
কিন্তু 'গীতাঞ্জলি'র ১৮ নম্বর রচনাটিই যেন তাঁর শ্রাবণ-দর্শনের অভিজ্ঞান হয়ে রয়ে যায়। শ্রাবণ ও মৃত্যুর যৌথতাসূচক ভাবনাপ্রতিমার অপরূপ নির্যাস হয়ে রয়ে যায় এই 'শ্রাবণ-ঘন-গহন-মোহে/গোপন তব চরণ ফেলে/নিশার মতো নীরব ওহে/সবার দিঠি এড়ায়ে এলে'। এই কাব্যগীতির অন্তিম আর্তিটুকু মরমে না বেজে পারে না-- 'হে একা সখা, হে প্রিয়তম,/রয়েছে খোলা এ ঘর মম,/সমুখ দিয়ে স্বপনসম/যেয়ো না মোরে হেলায় ঠেলে।'!
ওই 'একা সখা' এক অপূর্ব অভিব্যক্তি! আকুল শ্রাবণের সমস্ত রস, প্লাবন, সমস্ত গৌরব, প্রাণন, সমস্ত ধ্বনি ও ছন্দ, সমস্ত সুর ও স্মৃতির অপরূপ প্রদর্শনীর বিপুলতার মধ্যেও কবি এই একা সখার কল্পনা করেছেন। যিনি তাঁর ঘরের খোলা দুয়ার দিয়ে আসবেন! তাঁকে কবির একান্ত অনুরোধ, তিনি যেন কবিকে তখন হেলায় ঠেলে না চলে যান!
না, শ্রাবণসাধন তাঁর ব্যর্থ হয়নি। শ্রাবণঘনগহনমোহ তাঁকে ভোলেনি! তিনি মৃত্যুশ্রাবণের কবি হয়েই যেন 'বেঁচে' রইলেন!
(Zee 24 Ghanta App : দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির লেটেস্ট খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Zee 24 Ghanta App)
আরও পড়ুন: Rabindranath Tagore death anniversary: ছবির নাম 'বাইশে শ্রাবণ'-ই দেবেন, কেন অনড় ছিলেন মৃণাল সেন?