নিজস্ব প্রতিবেদন: বহিরাগতরা এসে ঠিক ঠিকই বুঝে নেয় কারা বহিরাগত। একদা লিখেছিলেন বরেণ্য কবি শঙ্খ ঘোষ। তাঁর এই অপূর্ব লাইনটিই কি এবার চলচ্চিত্রের মতো দৃশ্যায়িত হচ্ছে বাংলার সাধারণ মানুষের চোখের সামনে? মানে, ভোট-যুদ্ধের বারুদগন্ধে মত্ত বাংলায় কি এখন বহিরাগত-বহিরাগতে ঠোকাঠুকি?


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

না, বিষয়টা ঠিক 'বহিরাগত' (outsiders) নয়, ভোটবাংলায় এখন বরং বহিরাগত-তত্ত্বের জোরদার ঠোকাঠুকি চলছে। বাংলার রাজনীতিতে 'বহিরাগত'-বিতর্ক অবশ্য আজকের নয়। এর সুদীর্ঘ ইতিহাস আছে। বাম-আমল থেকেই এর সূত্রপাত। পরে তা তৃণমূল-বিজেপির (TMC-BJP) দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মধ্যেও দীর্ঘদিন ধরে গভীর ছায়া ফেলে রেখেছে। বিজেপি'র স্থানীয় নেতার পরিবর্তে বাংলায় অ-বাঙালি নেতাদেরই বারবার দেখা যেতে থাকার অভিযোগে তৃণমূল বিষয়টিকে 'বহিরাগত' তকমায় রাঙিয়ে দিয়েছিল। 


মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee) একদা খুব সুচারু ভাবে বিজেপির বিরুদ্ধে এই বহিরাগত-তত্ত্ব প্রয়োগ করেছেন। সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক মহল মনে করে, এতে তিনি রীতিমতো সফলও হয়েছেন একদা। যদিও তাঁর 'বহিরাগত'-নিদান নিয়ে রাজ্য-রাজনীতিতে একদা কিঞ্চিৎ ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হওয়ায় এ বিষয়ে নিজের অবস্থান স্পষ্টও করে দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, সকলে নন, বাইরে থেকে এসে যাঁরা রাজ্যের ঐতিহ্য-সংস্কৃতিকে 'আঘাত' করছেন, 'বহিরাগত' তকমা মূলত তাঁদের জন্যই।


কিন্তু অদূর অতীতে মমতার এই বহিরাগত-ব্যাখ্যা যাই হোক, আসন্ন ভোট-যুদ্ধের (west Bengal assembly election 2021) দিকে তাকিয়ে যে প্রার্থীতালিকা তৃণমূল শুক্রবার প্রকাশ করেছে, তা নিয়ে 'বহিরাগত' প্রশ্নেই রীতিমতো ক্ষোভ দেখা দিয়েছে তৃণমূলের অন্দরে। বিভিন্ন জায়গায় তৃণমূলের একাংশই তাঁদের সুপ্রিমোর ঘোষণা করা প্রার্থীদের নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন; কোথাও কোথাও তাঁরা সরাসরি স্বদলীয় প্রার্থীদের 'বহিরাগত' তকমায় দাগিয়েও দিয়েছেন। যার ফলে, রাজনৈতিক ভাবে একদা-ব্যবহৃত তৃণমূলের 'বহিরাগত' শব্দ-অস্ত্রটি এখন সটান তাদের দিকেই ঘুরে গিয়েছে। রাজনৈতিক শব্দ-কৌশলের এই 'প্যারাডাইম শিফ্ট' তাই ভোটবঙ্গের রঙ্গমঞ্চে নতুন রাজনৈতিক সমীকরণই তৈরি করে দিচ্ছে বলে মত কারও কারও।


আরও পড়ুন: WB assembly election 2021: বিদ্রোহের ভয়? পিছিয়ে যাচ্ছে বিজেপি'র প্রার্থীতালিকা প্রকাশ


'বহিরাগত' শীর্ষক কবিতাটিতে শঙ্খ ঘোষ (Shankha Ghosh) বলেছিলেন-- 'আমার কথা কি বলতে চাও না? নিশ্চিত তুমি বহিরাগত'। কার্যত দেখা যাচ্ছে, কথা বলতে না-চাওয়া নয়, বরং কথার ফুলঝুরিতেই যেন নতুন করে রচিত হচ্ছে 'বহিরাগত' তত্ত্ব-তকমা-বিতর্ক।


কী রকম? একটু-একটু নমুনা দেখে নেওয়া যাক।


শুক্রবার তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থীতালিকা ঘোষণা করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২৯৪টির মধ্যে ২৯১ আসনের প্রার্থী ঘোষণা করেন তিনি। যেখানে রয়েছেন একাধিক তারকা প্রার্থী। যেমন, চণ্ডীপুর থেকে সোহম চক্রবর্তী, চন্দননগর থেকে ইন্দ্রনীল সেন, বারাসত থেকে চিরঞ্জিৎ চক্রবর্তী, সোনারপুর দক্ষিণ থেকে লাভলী মৈত্র-সহ একাধিক তারকা প্রার্থী এবার তৃণমূল কংগ্রেসের টিকিটে লড়াই করবেন। জুন মালিয়া, রাজ চক্রবর্তী, সায়নী ঘোষরাও তৃণমূলের হয়ে এবার লড়ছেন।


আর এই তারকা প্রার্থীদের নাম ঘোষণার পর থেকেই যেন দলে তাল কাটতে শুরু করে। কে রাজ চক্রবর্তী, কে সায়নী ঘোষ বলে প্রশ্ন তুলে বিক্ষোভ শুরু করে দেন তৃণমূল কংগ্রেসেরই একাংশ।


আসানসোল দক্ষিণ থেকে এবার তৃণমূলের টিকিটে লড়ছেন অভিনেত্রী সায়নী ঘোষ। এবং আসানসোল দক্ষিণের বেশ কিছু জায়গায় সায়নী ঘোষের নামে দেওয়াল লিখনও শুরু হয়ে গিয়েছে। কিন্তু কেন ওই বিধানসভা কেন্দ্রে সায়নীকে প্রার্থী করা হল, তা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন আসানসোল তৃণমূল কংগ্রেসের একাংশ। আসানসোল পুরনিগমের পাঁচবারের কাউন্সিলর লক্ষ্মণ ঠাকুরকে সরিয়ে কেন সায়নীকে প্রার্থী করা হল, তা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। 


বাঁকুড়া থেকে এবার তৃণমূলের হয়ে লড়াই করছেন অভিনেত্রী সায়ন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। তৃণমূলে যোগ দেওয়ার পরপরই কেন সায়ন্তিকাকে প্রার্থী করা হল, তা নিয়ে ক্ষুব্ধ তৃণমূল কংগ্রেসের স্থানীয় নেতৃত্বের একাংশ। সেখানে এক মহিলা তৃণমূলনেত্রী বলেছেন, বাংলা যেমন তার নিজের মেয়েকেই চায়, বাঁকুড়াও তেমনই তার নিজের মেয়েকেই চায়।


বারাকপুরে রাজ চক্রবর্তীকে (raj chakraborty) প্রার্থী করায়, ক্ষোভ প্রকাশ করেন স্থানীয় তৃণমূল কংগ্রেসের বেশ কিছু সমর্থক। তিনি রাজ চক্রবর্তীকে চেনেন না, এমনও বলে দিলেন বারাকপুর পুর প্রশাসক উত্তম দাস। সেখানে উত্তম দাসকে প্রার্থী না করায় যথেষ্ট ক্ষোভ দেখা দেয়। উত্তমকে কেন প্রার্থী করা হল না, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন অনেকে। যদিও উত্তম জানান, তিনি 'দলকে ভালবাসেন', তাই দলের মনোনীত প্রার্থীর হয়েই প্রচার করবেন। 


এদিকে রাজ চক্রবর্তী এই বিতর্কে বলে দিয়েছেন-- নিশ্চয়ই সবটা ভেবে নিয়েই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। রাজ আরও জানান, তিনি মোটেই বহিরাগত নন, তাঁরা সকলে বাংলার মানুষ, বাংলার জন্য ভাববেন, বাংলার জন্য লড়বেন। সোহম এবং কাঞ্চনও এই সুরেই ডিফেন্ড করেছেন বুমেরাং এই 'বহিরাগত'কে। 


শুধু তারকা প্রার্থী নন, স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীকেই তো 'বহিরাগত' বলছে বিজেপি। মমতাকে নন্দীগ্রামে বহিরাগত বলে উল্লেখ করেছেন শুভেন্দু অধিকারীই।


তা হলে কী দাঁড়াল? 'উঁচু স্বর তুলে কথা বলে যারা জেনে নাও তারা বহিরাগত'? নাকি এসব থেকে ফোকাস সরিয়ে আরও একটু দূরের বিতর্কেই চোখ ফেলা ভাল যেখানে ওই 'চালার উপরে ঝুঁকে পড়ে চাঁদ বহুদূর থেকে বহিরাগত'! দেখা যাক, শেষ পর্যন্ত এই বিতর্ক মাটি ও চাঁদ ছেড়ে কোথায় গিয়ে পৌঁছয়।


আরও পড়ুন: WB assembly election 2021: স্থানিক ইস্যু নিয়েই আপাতত ভোট-লড়াইয়ের ময়দানে মধুজা