সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

বঙ্গজীবনের অঙ্গ দুর্গা পুজো ৷ যতই পাঁজি মেনে এটি এক ধর্মীয় অনুষ্ঠান রূপে পালিত হোক না কেন, মা দুর্গাকে ঘিরে গোটা বাংলা উৎসবের আনন্দে মাতবেই। দোকানে কিংবা শপিং মলে পুজোর সেল, নিউজ স্ট্যান্ডে সাজানো পূজাবার্ষিকী আর বিজ্ঞাপনের জন্য বাঁশের মোড়কে ঢাকা পড়তে থাকা শহর থেকে শহরতলি বুঝিয়ে দেয় দুর্গোৎসবের কথা। অনেকের রুটি রুজির ব্যবস্থা করে দিয়ে এই সময়কালটা যেন বার্তা দেয়- বাণিজ্যে বসতে দুর্গা। ধর্মীয় অনুষ্ঠানের গণ্ডি পেরিয়ে উৎসবে মেতে এক বিশেষ জীবনযাত্রা অর্থনীতিকে সূচিত করে ৷


পুজো উপলক্ষ্যে শহর সেজে ওঠে। দুর্গা প্রতিমার সুন্দর মূর্তি, অসামান্য থিম এবং প্যান্ডেলজুড়ে  শিল্পকর্ম দেখে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। আজকাল তো রথযাত্রার সময় থেকেই বড় বড় পুজো কমিটি খুঁটি পুজো করে নেয়। গ্রাম অথবা শহরতলী থেকে প্যান্ডেল গড়ার কাজে আসে কর্মীরা ৷ এরা বংশ পরম্পরায় শেখা শিল্পকর্ম তুলে ধরেন প্যান্ডেল তৈরির কাজে। প্যান্ডেল নির্মাণের কাজে নিযুক্ত থাকে মাস তিনেক যা এই সব কর্মীদের সারা বছরের রোজগারের একটা বড় অংশ। সাধারণত মোট পুজোর খরচের ৫০-৬০ শতাংশ যায় প্যান্ডেলে। কোনও কোনও প্যান্ডেল নির্মানে খরচ কয়েক কোটি টাকা ৷ প্রতিমার মূর্তি তৈরির কাজে যেমন একদল লোকেরা নিযুক্ত থাকে যারা এই কাজ বংশ পরম্পরায় শিখে এসেছে আবার ইদানিং একেবারে আর্ট কলেজ থেকে শিখে আসা শিল্পীরাও এই কাজে নিয়োজিত হচ্ছেন। এই সব প্রতিমা শিল্পী তথা কর্মীদের গোটা বছরের আয়ের সিংহ ভাগই আসে দুর্গা পুজোর বরাত থেকে। শুধু রাজ্য নয় রাজ্যের বাইরে এমনকী দেশের বাইরে পাড়ি দেয় তাদের তৈরী প্রতিমা। চিরকালই আলোর রোশনাইয়ে উৎসবের জৌলুশ ফুটে ওঠে ৷ বিভিন্ন প্রযুক্তি ও পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় আকর্ষণীয় আলোর নকশায়। আর এই সব উদ্ভাবনী আলোকসজ্জার মাধ্যমে দর্শনীয়ভাবে বিশাল বিশাল প্যান্ডেল আলোকিত হয়ে থাকে। মোটামুটি দেখা গিয়েছে, পুজোর মোট খরচের ১৫ শতাংশ যায় আলো এবং আলোকসজ্জায়।


আরও পড়ুন: Durga Puja 2023: সেফটি পিন | ছোট গল্প | পাপিয়া বোস ধর


অনেকের হাতে এই সময় আসে পুজো বোনাস কিংবা পুজো অ্যাডভান্সের টাকা। তাছাড়া বহুদিন ধরেই সারা বছরের মধ্যে এই সময়টাতেই জামা কাপড় থেকে গৃহস্থালির জিনিসপত্র কেনাকাটা সেরে নেওয়ার একটা প্রবণতা রয়েছে বাঙালিদের মধ্যে। যুগ যুগ ধরে বাঙালির এই প্রবণতাকে কাজে লাগিয়ে উপভোক্তাদের আকৃষ্ট করতে নানা রকম ছাড় এবং অফারের মাধ্যমে বিপণনের ডালি সাজিয়ে হাজির হয় বিভিন্ন পোশাক, অলঙ্কার, ইলেকট্রনিক্স ব্র্যান্ড এবং ই-কমার্স প্লেয়াররা। ভিড় জমে শপিং মলে। আবার এই সময় নানা রকম হাট এবং মেলার আয়োজন করা হয় তাঁতী এবং কুটির শিল্পের শিল্পীদের পণ্যের বাজার তৈরি করে দিতে। সামগ্রিক ভাবে গোটা বছরের খুচরো ব্যবসার বড় অংশ লেনদেন হয় এই উৎসবের মরসুমেই।


ব্রান্ডিং তথা পণ্য বাজারজাত করার একটা সুযোগ অবশ্যই এই উৎসবের সময়কাল। অনেক কর্পোরেট সংস্থা নতুন পণ্য বাজারে আনার জন্য এই সময়টাকেই বেছে নেন। তাছাড়া এই সময় থাকে বিপণন সংস্থার নানা রকম ডিসকাউন্ট সহ উৎসবের অফার। সেই সব তথ্য উপভোক্তাদের কাছে পৌঁছে দিতে নির্ভর করা হয় বিজ্ঞাপনের। পাশাপাশি তাদের পণ্য যাতে মানুষের সেন্টিমেন্টকে স্পর্শ করতে পারে তার জন্য দুর্গাপুজোকে ভিত্তি করে মন ছুঁয়ে যাওয়া সৃজনশীল বিজ্ঞাপন বানানো হয়। পুজোর সময় রাস্তায় রাস্তায় বিজ্ঞাপনের হোর্ডিংয়ে হোর্ডিংয়ে শহরের মুখ ঢেকে যায় ৷ আবার এই  বিজ্ঞাপনকে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে সংবাদপত্র, টিভি, রেডিও, সিনেমা ও ডিজিটাল মাধ্যমকে ব্যবহার করা হয়।


পুজোর বাজার সেরে বাড়ি ফেরার সময় অনেকেই বাইরে কোথাও খেয়ে নেন। তাছাড়া পুজোর কটা দিন উৎসবের অঙ্গ হিসেবে চলে রীতিমতো পেটপুজো। সেই খাওয়া দাওয়া চলে একেবারে পুজো মন্ডপের আশে পাশে গড়ে ওঠা ভেলপুরি, ফুচকা, চপ, কাটলেট, বিরিয়ানির স্টল থেকে একেবারে নামী দামী রেস্তেরাঁয়। 


পুজোয় ছুটি মেলে তাই উৎসবের মুডে আর ঘরে বসে থাকতে মন চায় না। তখন ছুটি উপভোগ করতে শুধুমাত্র একবেলা নিজের শহরের বিখ্যাত পুজো বাড়ি অথবা প্যান্ডেল প্যান্ডেলে ভ্রমণ কিংবা গঙ্গাবক্ষে প্রতিমা নিরাঞ্জন দর্শনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। তা রাজ্যের মধ্যে অন্য কোনও স্থানে কিংবা রাজ্যের বাইরে এমন কি বিদেশের মাটিতেও পা রাখে আজকাল অনেকেই। আবার কলকাতায় জমকালো পুজো দেখতে বাইরে থেকেও লোক আসে। বিদেশি পর্যটকদের কাছে কলকাতার পুজোর একটা আকর্ষণ রয়েছে। করোনার জন্য যত্রতত্র ঘুরে বেড়ানোয় নিষেধ থাকায় মাঝে দুটো বছর পর্যটন ধাক্কা খেয়েছিল। কিন্তু গত বছর থেকে তা অনেকটাই স্বাভাবিক হয়েছে। পায়ের তলায় সরষে নিয়ে ফের বাঙালি বেরিয়ে পড়ছে পাহাড় থেকে সমুদ্রে। ট্রাভেল এজেন্টদের প্যাকেজ ট্যুর, ট্রেন, বিমান টিকিটের চাহিদা তারই প্রতিফলন।


আরও পড়ুন: Durga Puja 2023: সার্কেল | ছোট গল্প | অরুণাভ রাহারায়


প্রতি বছরই পুজোর সময় বেশ কিছু বাংলা ছবি মুক্তি পায় ৷ উৎসবের সময় ছুটি উপভোগ করতে বিনোদনের একটা জায়গা অবশ্যই সিনেমা। ফলে ছবির বাণিজ্যিক সাফল্যের কথা ভেবে প্রযোজক, পরিচালক, অভিনেতা সকলেই চান এই সময়ে যেন ছবি মুক্তি পায়। তবে শুধু বাংলা ছবি নয় উৎসবের বাজার ধরতে হিন্দি ছবিও মুক্তি পেতে দেখা যায় এই সময়ে।


সারা বছর রেডিও না শুনলেও মহালয়ার দিন সকালের মহিষাসুরমর্দিনী প্রভাতি অনুষ্ঠান শুনতেই হবে। এটাই বাঙালি জীবনের প্রথা। ঠিক তেমনই বঙ্গভাষীর এক শ্রেনীর লোকের কাছে দুর্গাপুজোর মরসুমে হাতে তুলে নিতে হবে পূজাবার্ষিকী। শুধু এই রাজ্যে বসবাসকারী বলে নয় প্রবাসী বাঙালির একাংশ বিভিন্ন পূজাবার্ষিকীর দিকে তাকিয়ে থাকে নতুন বাংলা গল্প উপন্যাস পড়ার জন্য। আবার বহুল প্রচারিত সংবাদপত্র বা প্রকাশনা সংস্থার পাশাপাশি লিটল ম্যাগাজ়িন বাণিজ্যিক কারণে এবং পাঠকের কাছে পৌঁছতে পুজোর অপেক্ষায় দিন গোনে।


মাঝে দু’বছর করোনা মহামারীর কারণে এই পুজো ঘিরে উৎসবে ভাঁটা পড়েছিল। তখন লকডাউনের কারণে জীবনযাত্রায় বড় রকমের পরিবর্তন ঘটেছিল। কাজ হারিয়ে আর্থিক সঙ্কটের জন্য খরচে কাঁটছাঁট করতে বাধ্য হয়েছিল অনেক মানুষ। অন্যদিকে তখন উৎসবের আবেগ থাকলেও ব্যবসা বিস্তারের ঝুঁকি নেওয়া যায়নি। যার ফলে দুর্গোৎসব ঘিরে অর্থনীতি-বাণিজ্য রীতিমতো ধাক্কা খেয়েছিল। তবে ভ্যাক্সিন আবিষ্কারের মাধ্যমে করোনাকে জয় এবং দুর্গাপুজোকে ইউনেস্কোর হেরিটেজ তকমা - এই দুই প্রভাবে পুজো ঘিরে গত বছরেই বঙ্গে রীতিমতো উন্মাদনা ফিরেছিল। গত বছরেই ৪৫ থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকার উৎসবমুখর বাণিজ্যের কথা শোনা গিয়েছিল। এবার তো সেদিক দিয়ে পরিস্থিতি আরও ভালো তাই আশা করাই যায় উৎসবের আবেগে মেতে পুজো ঘিরে বাণিজ্য- অর্থনীতির আরও বিস্তার ঘটবে।


(দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির টাটকা খবর, আপডেট এবং ভিডিয়ো পেতে ডাউনলোড-লাইক-ফলো-সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের AppFacebookWhatsapp ChannelX (Twitter)YoutubeInstagram পেজ-চ্যানেল)