সোমনাথ মিত্র


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

দুই শতকের দু’খান ১ জুলাই। মাঝে ৮০টা বছর। শুধু বিধানই দিয়ে গেলেন। কখনও চিকিত্সক হিসাবে রোগীদের, কখনও উপাচার্য হিসাবে ছাত্রদের, কখনও মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে রাজ্যবাসীকে। এককথায় ‘বিধান’ নামটি সার্থক। কেশবচন্দ্র সেনের ‘নববিধান’ নামে বইয়ে অনুপ্রাণিত হয়েই পিতা প্রকাশচন্দ্র রায় ‘বিধান’ নামকরণ করেছিলেন। মুখ দেখেই রোগ নির্ণয় করার এমন ‘অলৌকিক বিদ্যা’ রপ্ত করেছিলেন ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় যে হতদরিদ্র থেকে রাজা-উজিরের কাছে তিনি ছিলেন ধন্বন্তরি চিকিত্সক। কেউ কেউ বলতেন তাঁর দিব্যদৃষ্টি রয়েছে। তা হয়তো ছিল। মহাত্মা গান্ধী বলতেন,  “বিধান, দ্য সেফ্টি হ্যান্ড অব ইন্ডিয়া।” দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ মারা যাওয়ার পর, কলকাতায় তাঁর স্ত্রী বাসন্তী দেবীর মুখোমুখি বিধান রায় দাঁড়ালে, মিসেস দাশ কাতর আর্তিতে বলেছিলেন, “বিধান তুমি থাকতে উনি বিনা চিকিত্সায় এভাবে চলে গেলেন।” নিশ্চুপ ছিলেন বিধান। ডঃ শ্যামাপ্রসাদের মৃত্যুর পরও তাঁর মা এমনই কথা বিধানচন্দ্র রায়কে বলেছিলেন।


নিজেকে শুধু চিকিত্সার গণ্ডির মধ্যে বেঁধে রাখেননি বিধানচন্দ্র রায়। শিক্ষা, শিল্প, রাজনীতি, দর্শন সব ক্ষেত্রে সমান দক্ষতা রেখে গেছেন। তাঁর এই বিশাল কর্মকাণ্ডে ৩ জন মানুষের বিশেষ প্রভাব ছিল। বলা যায়, তাঁদের গুরু হিসাবেই দেখতেন বিধান। চিকিত্সা শাস্ত্রে কর্নেল লুকিস। যিনি বিধানকে শিক্ষা দিয়েছিলেন, ইংরেজদের সঙ্গে মাথা উঁচু করে কথা বলতে। বিধান বলেছিলেন, “তিনি আমার মধ্যে পৌরুষ জাগিয়ে তুলেছিলেন। আত্মসম্মান বোধ তৈরি করেন।”  রাজনীতিতে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। যাঁর হাত ধরে জাতীয় রাজনীতিতে আসা। গান্ধীজির সঙ্গে সাক্ষাত্। আর শেষে শিক্ষা প্রসারে বাংলার বাঘ তথা স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। এই মানুষটির কাছে তাঁর বিবেক-চেতনা আত্মসমর্পণ করেছিলেন বিধানচন্দ্র রায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ফেলো’ হওয়ার সরাসরি প্রস্তাব দিয়েছিলেন তত্কালীন উপাচার্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। তিনি সে পথে না হেঁটে সেনেট নির্বাচনে দাঁড়ান এবং মন্মথনাথ রায়চৌধুরী, চারুচন্দ্র বিশ্বাসের মতো ব্যক্তিদের হারিয়ে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন।



এরপর থেকেই আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে বিধানের। একদিন গভর্নর লর্ড লিটন তৃতীয় বারের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হওয়ার প্রস্তাব দিয়ে চিঠি দেন আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কে। সঙ্গে ছিল বেশ কিছু শর্ত। বিধানকে তিনি এতটাই ভরসা করতেন যে সেই চিঠি দেখিয়ে তাঁর মতামত জানতে চান আশুতোষ মুখোপাধ্যায়।  বিধান বলেন, যে শর্তগুলি রাখা হয়েছে, তা অত্যন্ত অপমানজনক। এরপর লাটসাহেবের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে পাল্টা চিঠিতে আশুতোষের সেই বিখ্যাত জবাব, ফ্রিডম ফার্স্ট, ফ্রিডম সেকন্ড অ্যান্ড ফ্রিডম অলয়েজ। আশুতোষের সংস্পর্শে এসেই বিধান আরও নির্ভীক ও অনাপোষী হয়েছিলেন।


আরও পড়ুন- গল্পস্বল্প: প্রেম, দাম্পত্য, বিচ্ছেদ- তসলিমাকে নিজের হাতে গড়েছিলেন কবি রুদ্র


জানা যায়, আশুতোষই বিধান রায়কে পরামর্শ দিয়েছিলেন ১৯২২ সালে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করার। নির্দল প্রার্থী হিসাবে বিধানকে উত্তর কলকাতা মিউনিসিপ্যাল (বারাকপুর) কেন্দ্র বেছে দেন তিনি। বিধান রায়ের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। সেবার এই কেন্দ্রের নির্বাচন ছিল বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য ঘটনা। রাজনীতিতে নবাগত বিধানকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে কংগ্রেস স্বরাজ্য দলের হয়ে দাঁড়ানোর প্রস্তাব দেন চিত্তরঞ্জন দাশ। দেশবন্ধুর সেই প্রস্তাব বিধান রায় ফিরিয়ে দিয়েছিলেন একটাই কারণে। পাছে মানুষের কাছে ভুল বার্তা যায়। তবে, বিধানের এই সিদ্ধান্তে রুষ্ট হলেও বাইরে থেকে সমর্থন করেছিলেন চিত্তরঞ্জন দাশ। মজার বিষয়, এই কেন্দ্রের ফলাফল কী হয়, তা জানতে কৌতুহল ছিল গোটা দেশের। কারণ, লড়াইটা দাঁড়িয়ে গিয়েছিল জাতীয় স্তরের। একদিকে স্বয়ং রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় অন্যদিকে দেশবন্ধু- বাংলার বাঘ সমর্থিত বিধান। শেষমেশ বিপুল ভোটে জয়ী হন বিধানচন্দ্র রায়। প্রায় ৩ হাজারের বেশি ভোটে হারতে হয়েছিল সুরেন্দ্রনাথকে। বলা যায়, সেদিন থেকেই মূল রাজনীতির সরণি থেকে সরতে শুরু করেন রাষ্ট্রগুরু। আর সেই রাজনীতির রাজপথে অভিষেক ঘটে নবাগত বিধানের।



বিধানের জীবনে আশুতোষ মুখোপাধ্যায় একটা বিরাট জায়গা জুড়ে থাকায় তাঁর পুত্র শ্যামাপ্রসাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত স্নেহের ও বন্ধুত্বের। ১৯৪২ সালে ফজলুল হক সাহেবের মন্ত্রিসভায় শ্যামাপ্রসাদ যখন অর্থমন্ত্রী, একবার গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। শ্যামাপ্রসাদ মৃতপ্রায় বলে বিভিন্ন খবরের কাগজে লেখালেখি হয়। তাঁর কর্মময় জীবনী শোকপ্রস্তাব হিসাবে ‘কম্পোজ’ করে রেখেছিল কলকাতার কিছু খবরের কাগজ। এমতাবস্থায়, বিধান রায় টানা তিনদিন বন্ধুর পাশে থেকে মৃত্যুর দোরগোড়া থেকে ফিরিয়ে আনেন শ্যামাপ্রসাদকে।


আরও পড়ুন- গল্পস্বল্প: সিগারেট না খেলে গলা পরিষ্কার হয় না... হেমন্তর ব্যারিটোন কন্ঠের ‘অদ্ভুত রহস্য’


তবে, বন্ধুত্বের নজির এখানেই শেষ নয়। জানা যায়, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার কিছুদিন আগে দিল্লিতে তত্কালীন কেন্দ্রীয় শিল্প ও সরবরাহ মন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদের সঙ্গে দেখা করতে যান বিধানচন্দ্র রায়। তখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ। কংগ্রেসের অন্দরে প্রবল অন্তর্কলহের জেরে নড়বড় করছে প্রফুল্ল ঘোষের চেয়ার। সে পদে তখন অন্যতম দাবিদার বিধানই। শ্যামাপ্রসাদ জানান, তিনি এখনও বিধানসভার সদস্য। বিধানের জন্য তাঁর কেন্দ্র ছেড়ে দিতে রাজি আছেন। বিধানও রাজি হয়ে যান। তবে শর্ত একটাই- স্বাস্থ্যের কথা ভেবে বঙ্গ রাজনীতিতে শ্যামাপ্রসাদ ফিরে এলে তিনি ওই পদ থেকে পদত্যাগ করবেন। এই ছিল বিধান-শ্যামাপ্রসাদের রসায়ন।



মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর দেশভাগের যন্ত্রণা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, কমিউনিস্ট পার্টির বিদ্রোহ ভাবিয়ে তুলেছিল বিধান রায়কে। তার মধ্যেও বাংলায় শিল্পবিস্তার করা নিয়ে তাঁর মনোবলে এতটুকুও চিড় খায়নি। আর তাঁকে সে সময় প্রভূত সাহায্য করেছিলেন বন্ধু তথা কেন্দ্রীয় শিল্পমন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। চিত্তরঞ্জনে রেলইঞ্জিন কারখানা থেকে দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন, দেশের প্রথম কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় খড়গপুর আইআইটি-সহ একাধিক ক্ষেত্রে শ্যামাপ্রসাদের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য।



দেশভাগের পর পাকিস্তানে যখন সংখ্যালঘুরা অত্যাচারিত হচ্ছেন, দিনের আলোয় খুন হচ্ছেন, বাধ্য হয়েই বিধান নেহেরুকে চিঠি দিয়ে বলেন, পাকিস্তান পূর্ববঙ্গে হিন্দুদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হলে, পুনর্বাসনের জন্য পূর্ববঙ্গের কিছু অঞ্চল দখল করুক ভারত। এই প্রস্তাবে সহমত পোষণ করেছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখ্যোপাধ্যায়, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল। তবে পণ্ডিত নেহেরু এই প্রস্তাবে সায় দেননি। তিনি হেঁটেছেন পাক প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলীর সঙ্গে আলোচনার পথে। যা বিখ্যাত হয়ে আছে নেহরু-লিয়াকত্ চুক্তি নামে। যে চুক্তিতে ভারত-পাকিস্তানের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা, অধিকার সুরক্ষিত করার কথা বলা হয়েছে। এই চুক্তির তীব্র বিরোধিতা করে ইস্তফা দেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। ১৯৫০ সালে ১৪ এপ্রিল পার্লামেন্টে তাঁর পদত্যাগের জন্য বিবৃতি দিয়ে কলকাতায় যখন ফেরেন, তাঁকে সংবর্ধনা জানাতে প্রচুর লোকের সমাগম হয়। বিধান রায়ও এই চুক্তির সাফল্য নিয়ে সংশয়ে ছিলেন। কিন্তু শ্যামাপ্রসাদের মতো সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারেননি।


আরও পড়ুন- গল্পস্বল্প: ফ্যাতাড়ুরা যে কখন বিস্ফোরণ ঘটাবে সরকারও টের পাবে না!



কাশ্মীরে গৃহবন্দি অবস্থায় ১৯৫৩ সালে ২৩ জুন মৃত্যু হয় শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের। তাঁর মৃত্যুতে কলকাতায় ব্যাপক উত্তেজনা তৈরি হয়। জানা যায়, ভাঙচুর চালানো হয় বিধানচন্দ্রের বাড়িতেও। শ্যামাপ্রসাদ ভুল চিকিত্সা মারা গিয়েছিলেন বলে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। তা জানতে নিজেই তদন্ত শুরু করেন বিধানচন্দ্র রায়।  ‘ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়: জীবন ও সময়কাল’ শীর্ষক বইয়ে জানা যায় তত্কালীন কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী শেখ আবদ্দুলার কাছে চিঠি লিখে প্রেসক্রিপশন চেয়ে পাঠান তিনি। প্রেসক্রিপশন দেখে চমকে ওঠেন বিধান। কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে জানতে চান, হাই ব্লাড প্রেসারে ভুগছিলেন শ্যামাপ্রসাদ, সেখানে কেন রক্তচাপ না কমিয়ে রক্তচাপ বাড়ানোর ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়। কেন তাঁকে খবর দেওয়া হয়নি বলে জোর সওয়াল করেন বিধানচন্দ্র রায়। ভবানীপুরের বাড়িতে শ্যামাপ্রসাদের মরদেহ যখন পৌঁছয়, তাঁর মা বিধান ডেকে বলেছিলেন, “বিধান তুমি থাকতে আমার শ্যামা ভুল চিকিতসায় মারা গেল।” সে দিনও নিরুত্তর ছিলেন ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়।