গল্পস্বল্প: সিগারেট না খেলে গলা পরিষ্কার হয় না... হেমন্তর ব্যারিটোন কন্ঠের ‘অদ্ভুত রহস্য’

পরবর্তী সময়ে ‘জুনিয়র পঙ্কজের’ মনে হয়েছিল, নাম-ডাক তো হচ্ছে। কিন্তু এর মধ্যে হেমন্ত কই? অন্যের পোশাক পরে আর কতদিন?

Reported By: সোমনাথ মিত্র | Updated By: Jun 24, 2020, 01:41 PM IST
গল্পস্বল্প: সিগারেট না খেলে গলা পরিষ্কার হয় না... হেমন্তর ব্যারিটোন কন্ঠের ‘অদ্ভুত রহস্য’
ফাইল চিত্র

সোমনাথ মিত্র

একটা সময় বিতর্ক তৈরি হয়, সুরকার সলিল চৌধুরী না থাকলে কিংবদন্তি হতেন না হেমন্ত মুখোপাধ্যায়! সে সময় তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। এক সাক্ষাত্কারে তিনি বলেন, সলিলকে আবিষ্কার করেন হেমন্তই। এ কথা মনুমেন্টের তলায় দাঁড়িয়ে বলতেও আমার দ্বিধা নেই। বাংলা ও হিন্দি গানের জগতে হেমন্ত একটি ঋতু। যেটি না থাকলে গানের বারোমাস্যা সম্পূর্ণ হয় না।

পঙ্কজ কুমার মল্লিক তাঁর ভীষণ পছন্দের। তাঁকে অনুসরণ করেই গান গাওয়া শুরু। ‘ছোটো পঙ্কজ’ বলা হতো তাঁকে। আত্মজীবনী ‘আনন্দধারায়’ পঙ্কজ কুমার মল্লিকের প্রতি তাঁর সম্ভ্রম বোঝাতে হেমন্ত লিখছেন-

“আমি তখন পঙ্কজদার ঢঙে গান গাইছি। আমাকে দেখে অনেকে বলে জুনিয়ার পঙ্কজ। খুব বাহবা দেয়। তখনও আমার সঙ্গে পঙ্কজদার আলাপ পরিচয় নেই। খুব ইচ্ছে হলো একদিন আলাপ করবার। ...একদিন সাহসে ভর করে গেলাম ওঁর সেবক বৈদ্য স্ট্রীটের বাড়িতে। বাড়িতে পেলাম ওঁকে। খুব সঙ্কোচের সঙ্গে নিজের পরিচয় দিলাম। উনি শুনে বললেন, ‘ও, তুমিই হেমন্ত? বাঃ বেশ। বেশ ভাল গান করো। আচ্ছা আচ্ছা।’ ... ওই কটা কথা বলে উনি বেরিয়ে গেলেন। গাড়ি ছাড়বার আগে মুখ বাড়িয়ে আমাকে বললেন ‘আমি নিউ থিয়েটার্স যাচ্ছি, তুমি কোথায় যাবে? আমি বললাম আমি ভবানীপুরে। উনিই একাই চলে গেলেন টালিগঞ্জের দিকে।’”

পরবর্তী সময়ে ‘জুনিয়র পঙ্কজের’ মনে হয়েছিল, নাম-ডাক তো হচ্ছে। কিন্তু এর মধ্যে হেমন্ত কই? অন্যের পোশাক পরে আর কতদিন? এবার চাই নিজের পোশাক। খুঁজতে শুরু করলেন নিজেকে। তিনের দশকে গানের ট্র্যাডিশন ভাঙার স্পর্ধা দেখিয়েছিলেন ছিপছিপে, দীর্ঘকায়, ধুতি-পঞ্জাবি পরা নিপাট ব্যক্তিটি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অন্তিমযাত্রায় এক নম্বর গার্স্টিন প্লেসের  আকাশবাণীর পুরনো বিল্ডিংয়ে সরাসরি সম্প্রচারে হেমন্ত গেয়েছিলেন, “যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন”। কাঁদিয়ে ছেড়ে ছিলেন বাঙালিকে। এমন দরদী রবীন্দ্র সংগীত হয়তো বাঙালি প্রথম শুনল। আর তখন থেকেই হেমন্ত যুগের সূচনা।

গলার জোরেই সিনেমা হিট করে দিতে পারতেন। এমন একাধিক নজির রয়েছে। একবার এক প্রযোজক গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কাছে এসে বললেন, আমার সব ছবি ফ্লপ। এবার ছবি হিট করতে না পারলে পথে মারা যাবো। প্রযোজকের কাতর আর্জিতে কলম ধরলেন গৌরী। গলা দিলেন হেমন্ত। ব্যস বাকিটা ইতিহাস। ‘এই বালুকা বেলায় আমি লিখেছিনু’, ‘এই মেঘলা দিনে একলা..’ বা ‘কেন দূরে থাকো, শুধু আড়াল রাখো’। বাঙালির মন খারাপ হলে, আজও এই গানগুলো শুনেই এক বুক শ্বাস নেয়। বলে রাখা ভালো, এর পর থেকে সে প্রযোজককে আর পথে বসতে হয়নি।

হেমন্ত মুখোপাধ্যায় থেকে হেমন্ত কুমার হওয়ার যাত্রা শুরু হয় পঞ্চাশের গোড়ায়। প্রথম সুর দেন হিন্দিতে ‘আনন্দ মঠ’ (১৯৫৩) ছবিতে। তাঁর সুরে লতা মঙ্গেশকরের গলায় ‘বন্দে মাতরম’ গানটি অন্য মাত্রা পেয়েছিল। এরপর, ‘ডাকু কি লেডকি’, ‘নাগিন’, ‘সম্রাট’, ‘বন্দিশ’, ‘আনজান’ একের পর এক ছবিতে তাঁর সুরে হিট গান। ১৯৫৬ সালে ‘নাগিন’ সিনেমার জন্য সেরা সুরকার হিসাবে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার জেতেন। গুলজার তাঁর স্মৃতি কথায় বলছেন, বলিউডে একধারে গান গাইছেন, সুর করছেন, সিনেমা প্রোডিউস করছেন, ষাটের দশকে এমন কলার তোলা বাঙালি দেখা যেত না।

মার্সিডিজ চালিয়ে বম্বে শহরে ঘুরে বেড়াতেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। হাতে সিগারেট, কখনও নস্যি। যাঁর এমন ব্যারিটোন গলা, তাঁর ঠোঁটে ঘনঘন সিগারেট! সত্যিই ইন্ডাস্ট্রিতে এমন দুঃসাহসিক গায়ক খুবই কম আছে। সিগারেট খাওয়া নিয়ে প্রশ্ন করা হলে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সহাস্যে বলতেন, সিগারেট না খেলে গলার গ্রেনটা ভাল আসে না। গলা পরিষ্কার হয় না। সত্যি, সিগনেচার তৈরি হয়ে গেছে তাঁর কণ্ঠ। ২০২০, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জন্মশতবর্ষ। আজও অমলিন তাঁর গান। তাঁর কন্ঠ আজও প্রাণবন্ত। আজ যদি বাঙালি পথ হারিয়ে ফেলে বা ঝড়ের মুখোমুখি হয়, বা মেঘলা দিনে একলা থাকার ইচ্ছে করে বা নীল ধ্রুবতারা প্রশ্ন করে, সেই ঠিকানা রেখে গেছেন হেমন্ত তাঁর গানেই...

.