ধর্ষণ মানে `বেইজ্জতি` নয়, শরীরের জবরদখল আসলে ক্ষমতার-রাজনীতি!
ঊষসী মুখোপাধ্যায়
ঊষসী মুখোপাধ্যায়
টিভিতে সারি সারি ঝাপসা মুখ!
হাথরসের নির্যাতিতার বাড়ির চৌকাঠে তখন উপচে পড়া ভিড়। সদ্য সন্তানহারা মা কালো আঁচলে মুখ ঢেকেছেন। বাবার মুখে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা সাদা কাপড়। বাড়িশুদ্ধ লোক, সবার মুখ ঢাকা। যে-কজনের মুখ খোলা, তাদেরও টিভি স্ক্রিনে ঝাপসা করে দেওয়া হয়েছে।
কেন? কী অপরাধ ওদের?
না! ওরা অপরাধী নয়। বরং অপরাধের শিকার!
তবু ওদেরই মুখ ঢাকা। 'লোকলজ্জার' ভয়ে আবছা সব!
আমরা যারা আজ চিৎকার করে হাথরস-কাণ্ডের বিচার চাইছি, সত্যি তারাও কি কখনও ভেবে দেখেছি, টিভিতে-কাগজে কেন যুগ যুগ ধরে ধর্ষিতার (এবং তার পরিবারের) মুখ কেন এভাবে ঝাপসা দেওয়া হয়? এই আমরাই বলি ধর্ষণ মানেই মহিলার দোষ, একথা বলা এবার বন্ধ হোক! তবুও কই, প্রশ্নগুলো তুলি না তো!
যে 'ইজ্জত' বাঁচাতে এই সন্তানহারা পরিবার মুখ লুকোচ্ছে, ধর্ষণের সঙ্গে সেই 'ইজ্জতের' কিই বা সম্পর্ক? কারও শরীরের সঙ্গে জবরদস্তি করা, ধর্ষণ করাকে 'ইজ্জত লুটে' নেওয়া কেন বলি আমরা? আমরা কি সত্যিই বিশ্বাস করি, যে একজন মহিলার যাবতীয় সম্মান স্রেফ যোনিপথেই আবদ্ধ হয়ে আছে? নাকি সম্মান ব্যাপরটা এতই ঠুনকো, যে শরীরের দখলদারি হলেই সব ধুয়েমুছে সাফ হয়ে যায়?
ধর্ষণ আর ইজ্জত, আপাত সম্পর্কহীন এই দুটো শব্দকে এক সুতোয় বেঁধে দিয়েছে সমাজ। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, আঙুল উঠবে আমাদের দিকেই। সমাজ তো আমাদের নিয়েই তৈরি! এই 'ইজ্জতের' সঙ্গে নারীর শরীরকে বহুকাল আগেই জুড়ে দিয়েছি আমরা। মেয়েরাই সম্মান, মেয়েরাই লাজ-লজ্জার ধারক-বাহক। এটাই তো প্রচলিত রীতি, না?
নির্ভয়া, তেলেঙ্গানা, উন্নাও, হাথরসের মতো পরের পর ঘটনা আমাদের ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে দিয়েছে। দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দিয়েছি। কিন্তু আজও বোধহয় সেই ইজ্জতের রীতি সমানভাবে বয়ে চলেছি আমরাও। ধর্ষণ একটা জঘণ্য অপরাধ। স্রেফ যৌনতা নয়। স্রেফ সেক্সুয়াল আর্জ নয়! বরং এটা সেক্সুয়াল ভায়োলেন্স।
সমাজতত্ত্ববিদরা বলেন, ধর্ষণ আদতে রাজনৈতিক একটা অপরাধ। শরীরের রাজনীতি, জবরদখলের রাজনীতি। একজনের শরীরে অন্যজনের জবরদস্তির দখলদারি। মজা দেখানো। ভয় পাওয়ানো। ক্ষমতা জোর ফলানো! বুঝিয়ে দেওয়া, যে আমার এতটাই ক্ষমতা, যে চাইলেই তোমার জীবনে 'কঁহি মু দিখানে কে লায়ক নেহি'র তকমা সেঁটে দিতে পারি।
প্রত্যেকটা ধর্ষণের হিংস্রতায় এই পাওয়ার-পলিটিক্স লুকিয়ে আছে। বিরোধীরা নির্যাতিতার গ্রামে ঢুকতে চাইলে যে ভাবে ক্ষমতার জোরে তাদের ঠেলে ফেলে দেওয়া যায়, ঠিক সেভাবেই একজন মহিলার শরীর দখল করে তাকে সমাজের একেবারে কোণে ঠেলে ফেলা যায়! আজ, এই ২০২০ সালে দাঁড়িয়েও সেই পাওয়ার-পলিটিক্স ষোলো আনা সত্যি!
কিন্তু আক্ষেপ একটাই, আজও আমরা অচেতন ভাবেই ধর্ষণকে ইজ্জতের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলি!
ধর্ষণের শিকার কোনও মহিলার ছবি প্রকাশ্যে দেখাতে পারে না সংবাদমাধ্যম। এটা দেশের শীর্ষ আদালতের নির্দেশ। তার যুক্তিসঙ্গত কারণও আছে বৈকি। বিশ্বাস যাই হোক না কেন, বাস্তবের মাটিতে গেঁথে থাকা ধারনাগুলোকে অস্বীকার করা যায় না। সত্যিই তো মহিলার শরীরের সঙ্গেই তার 'ইজ্জতের' সুতোগুলো বাঁধা আছে। বিলক্ষণ জানি, একজন নির্যাতিতার মুখ প্রকাশ্যে দেখালে তার ও তার পরিবারের জীবন দুর্বিষহ করে তুলবে আমাদের সমাজ। রাস্তাঘাটে, ট্রামে বাসের ফিসফাসে আঙুল উঠবে সেই 'ইজ্জতের' দিকে! এখনও তাই তত্ত্বের কাছে বিশ্বাসতে নত হতে হয়। না, আমরা নির্যাতিতার মুখ ঝাপসা করে দিই। না-চেয়েও মেনে নিই শরীরই আসলে সব ইজ্জতের কেন্দ্রবিন্দু।
ধর্ষণের বিচার চেয়ে গলা চড়াতে হলে তাই এই শরীর-রাজনীতির দিকেও আঙুল তুলতে হবে। এমন একটা ভয়ঙ্কর পাওয়ার-পলিটিক্সকে শুধু যৌন লালসা বলে দেওয়া মানে অপরাধের অভিঘাতকেই খাটো করা! পেশিশক্তির পাশবিক বহিঃপ্রকাশকে, কোনও এক মহিলাকে 'অওকাদ' দেখিয়ে দেওয়ার চেষ্টাকে যৌন লালসা আর কতদিন বলব?
তাই হথরসের ঘটনায় ধর্ষণের শিকার হওয়া উনিশ বছরের মেয়েটার 'দলিত' পরিচিতিটা গুরুত্বপূর্ণ। 'উঁচুজাতের' পুরুষের হাতে দলিত মেয়ের শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়ার মধ্যে কাজ করে যায় সেই ক্ষমতায়ণের রাজনীতি।
মহিলাদের শরীর দখল মানেই তার সম্ভ্রমের অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া, এ রীতি তো যুগ যুগ ধরে চলে আসছে! ঢাল-তরোয়াল উঁচিয়ে যুদ্ধে নামা রাজারাজরার গল্পে আছে না, জয়ী রাজা রাজ্যের সব স্ত্রী-বউদের হরণ করে নিয়ে যেত? দেশভাগের সময় কিংবা সাম্প্রদায়িক অস্থিরতার সময়েও 'ওদের মেয়েকে' হিঁচড়ে নিয়ে জবরদখলের নজির ভূরিভূরি আছে! দেশভাগের স্মৃতি থেকে গল্প শোনাতে আসা সাদাত হাসান মান্টোর কলমে ছড়ানো আছে সেই পাওয়ার-পলিটিক্সের আখ্যান। প্রাণের প্রিয় স্ত্রীকে ভিনধর্মের লোক তুলে নিয়ে গেলে পাগল হয়ে ওঠে যে স্বামী, সেই স্বামীই আচমকা বাড়ি ফিরে আসা স্ত্রীকে প্রত্যাখ্যান করতে দ্বিধা করে না। কেন? কারণ একটাই, ইজ্জত!
গত কয়েকমাসে উত্তরপ্রদেশে ঘটতে থাকা পরের পর ধর্ষণ-কাণ্ডে নজিরবিহীন নৃশংসতা দেখা গিয়েছে। ১৪ অগস্ট, হাথরস-কাণ্ডের ঠিক এক মাস আগে ১৩ বছরের এক দলিত কিশোরীকে আখের খেতে টেনে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে গলা টিপে খুন করা হয়। মেয়েটির বাবার অভিযোগ, তার জিভ কেটে নেওয়া হয়, উপড়ে নেওয়া হয় চোখ। ১৭ অগস্ট গোরক্ষপুরের কাছে ১৭ বছরের এক কিশোরীকে ধর্ষণ করে দুই যুবক, তার পর সিগারেটের ছেঁকায় ঝলসে দেওয়া হয় মেয়েটির নিথর শরীর। সে দিনই উত্তরপ্রদেশের বাদোহি জেলায় ১৭ বছরের কিশোরীকে ধর্ষণ করে খুন করা হয়। তারপর সেই নিথর শরীরে অ্যাসিড ঢেলে মেয়েটির পরিচিতি লুকোনোর চেষ্টা করে ধর্ষকরা!
পেশিশক্তির প্রকাশ কী ভয়াবহ হলে একটা মৃতদেহের সঙ্গেও জবরদস্তি করা যায়? বিকৃতি তো বটেই, কিন্তু তার থেকেও অনেক বড় আকারে থেকে যায় পাওয়ার-পলিটিক্স! 'দেখ কী করতে পারি'র উল্লাস!
সোশ্যাল ট্যাবুর বাইরে এখনও বেরোতে পারিনি আমরা। কিন্তু মনে মনে, ভেবে দেখতে বাধা কোথায়? লিঙ্গ নির্বিশেষে, সকলের 'ইজ্জতের' মান রাখতে শিখতে হবে আমাদের। ধর্ষণ শুধু মহিলাদের উপর নিরন্তর ঘটতে থাকা একটা 'লালসা' নয়!
পুরুষের ক্ষমতার জোর আজন্মকাল ধরে এই 'সামাজিক বেইজ্জতির' ভারী বোঝা মহিলাদের কাঁধে চাপিয়ে এসেছে! ভবিষ্যতেও হয়তো দেবে।
তবু যোনিপথে অবরুদ্ধ ইজ্জতের বাইরে বেরোতেই হবে আমাদের। জোরগলায় বলতেই হবে, শরীরের দখল মানেই ইজ্জতের দখলদারি নয়! এরপর, প্রত্যেকবার প্রতিবাদের সুর তুলতে গিয়ে যেন ভুলে না যাই, যে ধর্ষণ আসলে ক্ষমতার রাজনীতি! ক্ষমতার দম্ভের শিকার হওয়া কোনও বিচারকাঙ্খী মেয়েকে 'বেইজ্জতির' রাজনীতিতে যেন পড়তে না হয়! ক্ষমতা দর্শানোর এই অসম-যুদ্ধে ধর্ষণ স্রেফ 'লালসা' হয়েই না থেকে যায়!
আরও পড়ুন- নারীকে বাদ দিয়ে কীসের নারীবাদ? অচেনা বিদ্রোহীর ইনকিলাবে, জিন্দাবাদ আমাদেরও!