সৌমিত্র সেন


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

উনিশ শতকের নবজাগরণ, যা আধুনিক ভারতকে গড়ে দিয়েছে, তার হোতাদের নিয়ে চর্চার একটা দীর্ঘ ও ব্যাপ্ত পরিসর এ দেশের সংস্কৃতিতে বহু দিন ধরেই আছে। ২৬ সেপ্টেম্বর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্য়াসাগরের জন্মদিনটি আবারও সেই পরিসরটিকে সামনে আনল।


আর এই সামনে আনার প্রক্রিয়ায় ইদানীং কালে একটি নতুন 'ট্রেন্ড' দেখা যাচ্ছে। 'ট্রেন্ড' তৈরি করেছে হিন্দুত্ববাদী একটি (রাজনৈতিক) দল। তারা সযত্নে চেষ্টা করছে, তাদের যে (গোঁড়া) ভাবাদর্শ এবং তার সঙ্গে অন্বিত যে (বিশেষ ধাঁচের) রাজনৈতিক 'আন্ডারস্ট্যান্ডিং', সেটির সঙ্গে এ দেশের মহাপ্রতিভাবান 'আইকন'দের ভাবনাচিন্তা বা 'অ্যাপ্রোচে'র (সুদূরতম হলেও) মিল দেখানো। এই মিলটা দেখিয়ে তারা আসলে বলতে চায়, ভারতের আবহমান ঐতিহ্যেরই ধারক-বাহক তারা। অর্থাৎ, যারা তাদের কড়া সমালোচক, তাদের মুখ বন্ধ করার জন্য তারা পরপর এমন কতগুলি 'নেমড্রপ' করে, যাতে বিস্ময়াবিষ্ট বিরোধী থমকে গিয়ে চুপ করে যায়। এটি আত্মপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এই বিশেষ রাজনৈতিক দলটির একটি সুচিন্তিত 'প্রকল্প'।


আরও পড়ুন: Sarat Chandra Chattopadhyay: 'উত্তরাধিকারসূত্রে' পেয়েছিলেন শুধু অস্থির স্বভাব ও গভীর সাহিত্যানুরাগ


এবং এই 'প্রকল্প'কে তারা অনেকাংশে সফল করেও তুলেছে। তারা এই 'অ্যাঙ্গেলে' বঙ্কিমচন্দ্রকে জাপটে ধরতে পেরেছে; বিবেকানন্দকেও প্রায় কব্জা করে ফেলেছে; অরবিন্দের দিকে হাত বাড়াতে পেরেছে; রবীন্দ্রনাথকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। যদিও প্রতিটা ক্ষেত্রেই কিছু পূর্বাপরহীন মন্তব্যকে খামচা মেরে তুলে ধরে এই খেলাটা খেলা হচ্ছে। কেননা, একটু ভাবলেই এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, কোনও গোঁড়া একদেশদর্শী একমুখী সাম্প্রদায়িক বা ধর্মীয় খাঁচায় এঁদের কাউকেই আঁটানো সম্ভব নয়; এঁদের ভাবনার দিগন্ত অনেক প্রসারিত, ব্যাপ্ত, বহুমুখী। 


তা হলে কেন এরকম হল?


কারণ, একটাই। উক্ত প্রতিভাবান মানুষগুলির জীবনে ও কর্মে কোনও না কোনও ভাবে ধর্ম বা আধ্যাত্মিকতার একটা (কম বা বেশি) সংযোগ থেকেছেই। যে-ধাঁচায় ব্রহ্মবাদী রামমোহন রায় থেকে কালী-উপাসক সুভাষচন্দ্রকে পর্যন্ত সহজেই আঁটিয়ে নেওয়া যায়। যায় না শুধু একজনকেই। সেটা বলার জন্যই এই দীর্ঘ গৌরচন্দ্রিকা।


তিনি এক ও অদ্বিতীয় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। বিদ্যাসাগরের জীবনভর সুবিপুল কাজের মধ্যে কোথাও এতটুকু ধর্মীয় অনুষঙ্গ ছায়া ফেলেনি। ফলত, তাঁকে ধরতে গিয়ে ব্যর্থ হয় ওই বিশেষ রাজনৈতিক প্রকল্প। বারবার হাত পিছলে বেরিয়ে যান তিনি।


এর কতগুলি কারণ আছে। ব্রাহ্মণসন্তান বিদ্যাসাগর উপবীত ত্যাগ করেননি হয়তো এবং চিঠির মাথায় প্রথাসম্মত ভাবে ঈশ্বরস্মরণও করেছেন, কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনচর্যার সেইটুকু স্বাধীনতার বাইরে গিয়ে তিনি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ধর্মচর্চা থেকে সদা সর্বদা যোজন দূরে থেকেছেন। পাশাপাশি, হিন্দুধর্মের বুনিয়াদি যে শাস্ত্রচর্চা, যার সঙ্গে শুধু মনন নয়, ধর্মীয়তারও একটা আবছা যোগসূত্র থেকেছেই, তা নিয়েই তীব্র প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন তিনি।


শোনা যায়, ঈশ্বর আছেন কিনা, একদা কারও দ্বারা এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসিত হলে ঈশ্বরচন্দ্র নাকি বলেছিলেন, তিনি থাকলে থাকুন, তাতে তাঁর (বিদ্যাসাগরের) কিছু যায় আসে না। বড় বেদনার সঙ্গে ঈশ্বরচন্দ্র প্রশ্ন তুলেছিলেন-- চেঙ্গিস খাঁ যখন বন্দিদের নিয়ে যাওয়ার পথে রসদ না জোগাতে পেরে তাদের কচকচ করে কেটে ফেলছিল, তখন ঈশ্বর কী করছিলেন?


এ তো ব্যক্তিগত স্তরের অনুভূতি। তাঁর মননজগতে বা কর্মজগতেও তাঁর এই মনোভাবের ছবিই দেখা গিয়েছে। যেমন, তিনি রামায়ণ-মহাভারত নিয়ে একেবারেই বিহ্বল বিগলিত ছিলেন না। এগুলিকে তিনি আদপেই ধর্মগ্রন্থ মনে করতেন না, নিছক 'কাব্য'ই বলতেন। ভারতীয় পুরাণ নিয়েও তার মনোভাব বেশ তীক্ষ্ম ও নির্মোহ। সব চেয়ে বড় কথা, তিনি নাস্তিবাদী চার্বাক দর্শনের প্রচার ও প্রসারেও কাজ করেছেন। যে 'নব্যন্যায়' নিয়ে বাঙালি যুগের পর যুগে উদ্বেলিত ছিল সেই নব্যন্যায়ের প্রতি কোনও পক্ষপাতিত্বই তিনি দেখাননি। উল্টে, পরবর্তী সময় ও কাল বিদ্যাসাগরকে নব্যন্যায়বিরোধী হিসেবেই জেনেছে। নব্যন্যায়ের তর্কের জন্য তর্ক, যুক্তিখণ্ডন, বাকচাতুর্যের ধার ধারেননি বিদ্যাসাগর। এ বিষয়ে শশধর তর্কচূড়ামণির সঙ্গে বিদ্যাসাগরের কথোপকথনকে স্মরণ করা যেতে পারে। শশধরকে বিদ্যাসাগর নাকি বলেছিলেন, ''আমিও দর্শন পাঠ করিয়াছি, কিন্তু দুর্ব্বোধ্য বিষয়, কিছু ভাল বুঝা যায় না। পণ্ডিত মহাশয় পড়াইবার সময় যখন জিজ্ঞাসা করিতেন, 'ঈশ্বর বুঝ ত?' আমি বলিতাম, 'আপনিও যেমন বুঝেন, আমিও তেমনি বুঝি, পড়িয়ে যান।''' (উদ্ধৃতাংশের বানান পুরনো)  


সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ হওয়ার পর বিদ্যাসাগর পাঠক্রম নিয়ে বিস্তর ভেবেছিলেন। প্রচুর অদলবদল করেছিলেন, সংযোজন-বিয়োজন ঘটিয়েছিলেন। মোট কথা, ভারতীয় শাস্ত্র-দর্শন-পুরাণ-কাব্য ইত্যাদি নিয়ে তিনি প্রভূত সংস্কারসাধন ঘয়িয়েছিলেন, যা আদতে তাঁর সেকুলার মনটিকেই তুলে ধরেছিল। সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক ধর্মীয় পক্ষপাতিত্বহীন এমন একটা মন তাঁর, যার সামনে যেন পথ খুঁজে পেতে অস্বস্তি তৈরি হয়। 


ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে 'শিক্ষা পরিষদ'কে ('কাউন্সিল অফ এডুকেশন') একটি চিঠি লিখেছিলেন বিদ্যাসাগর। সেই চিঠিতেই তিনি বেদান্ত ও সাংখ্যকে 'ভ্রান্ত দর্শন' (এটি একেবারেই তাঁর ব্যক্তিগত মত; এটিকেও আলোচনার টেবিলে রেখে কাটাছেঁড়া করাই চলে) বলে উল্লেখ করেছিলেন। বাঙালি সমাজ যখন বিদ্যাসাগরের এই মতামতের বিষয়ে অবহিত হয় তখন হতবাক হয়ে যায়। 


ফলত, বোঝা অসম্ভব নয় যে, ঠিক কী কী কারণে বিদ্যাসাগর ওই বিশেষ রাজনৈতিক দলটির আগ্রহী হাত পিছলে বার বার বেরিয়ে যান! বিদ্যাসাগরের জীবনে কোনও ব্রহ্ম নেই, ঈশ্বর নেই, মূর্তি নেই, বেদ-বেদান্ত নেই, পুরাণ-কাব্যও নেই! তাঁর কোনও সঙ্ঘ-প্রতিষ্ঠানও নেই, প্রচারশিল্প নেই, প্রচারক-বাহক নেই। বিদ্য়াসাগর একা, বড় অপূর্ব ভাবে একা!                        


(Zee 24 Ghanta App : দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির লেটেস্ট খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Zee 24 Ghanta App)


আরও পড়ুন: UNWTO Award: রাষ্ট্রসঙ্ঘের পুরস্কারের জন্য মনোনীত ভারতের এই ৩ মিষ্টি গ্রাম