সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের প্রয়াণে অশ্রুসজল সুমিত্রা মহাজন
সুমিত্রা বলেছেন, `তিনি আমার দাদার মতো ছিলেন`।
নিজস্ব প্রতিবেদন: "আপানারা ভুলে যাবেন না, সারা দেশ আপনাদের দেখছে"। চতুর্দশ লোকসভায় এইউপিএ(এক) সরকারের আমলে লোকসভার অধ্যক্ষের আসনে বসা প্রবীণ মানুষটিকে সাংসদদের উদ্দেশে বারবার এই বাক্যটিই বলতে শোনা যেত। সে ছিল জোট রাজনীতির টালমাটাল সময়। কথায় কথায় তখন উত্তাল হত লোকসভা। ফলে, সরাসরি জনগণের ভোটে জিতে আসা আইনপ্রণেতাদের সামলানো ছিল অনেক কঠিন। কিন্তু, সেই কঠিন কাজটিই নিরপেক্ষতা ও প্রত্যয়ের সঙ্গে টানা পাঁচ বছর করে দেখিয়েছেন সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় এবং হয়ে উঠেছেন উদাহরণ। আর এমন অনুকরণযোগ্য প্রাক্তনের ক্যারিশ্মাকে কি করে ভোলা যায়! ফলে প্রাক্তনের বিয়োগে ভেঙে পড়লেন বর্তমান। অথবা, দাদার বিহনে অশ্রু সজল বোন-ও বলা যায়। সোমবার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের প্রয়াণের খবরে লোকসভার বর্তমান অধ্যক্ষ সুমিত্রা মহাজন এতটাই শোকগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন যে সংবাদ মাধ্যমের সামনেই আবেগ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে কেঁদে ফেলেছেন তিনি। এদিন, সুমিত্রা বলেছেন, "তিনি আমার দাদার মতো ছিলেন"। আরও পড়ুন- সোমনাথের প্রয়াণে রাজ্য কমিটির বৈঠক মুলতুবি করল সিপিএম
দীর্ঘ রোগভোগের পর সোমবার কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালে মৃত্যু হয়েছে বর্ষীয়ান রাজনীতিক তথা লোকসভার প্রাক্তন অধ্যক্ষ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের। সংসদীয় রাজনীতিতে ব্যুত্পত্তি এবং শ্রদ্ধার বিরল মিশ্রণে তিনি সমীহ আদায় করে নিয়েছেন সমসাময়িক ও নবীন প্রজন্মের কাছ থেকে। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে মোট ১০ বার লোকসভায় নির্বাচিত হয়েছেন সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। চতুর্দশ লোকসভায় (২০০৪-২০০৯) তাঁর দল সিপিআই (এম) ন্যূনতম অভিন্ন কর্মসূচির ভিত্তিতে ইউপিএ(এক) সরকারকে বাইরে থেকে সমর্থনের সিদ্ধান্ত নেয়। অধ্যক্ষ নির্বাচিত হন সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। কর্তৃত্বের সঙ্গে সভা পরিচালনার ক্ষেত্রে এবং সব পক্ষকে কথা বলার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য, সাংসদ মহলে বিশেষ জনপ্রিয় সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। তাঁর আমলেই লোকসভা টিভি-র মাধ্যমে সংসদের নিম্নকক্ষের অধিবেশন সম্প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। নিজে পেশাদার আইনজীবী হলেও, লোকসভার অধ্যক্ষ হিসাবে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় আইনসভার কাজে বিচার বিভাগের হস্তক্ষেপকে রেয়াত করেননি। আদালতের নির্দেশে ঝাড়খণ্ড বিধানসভায় আস্থা ভোট এগিয়ে নিয়ে আসাই হোক, কিংবা টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন কেলেঙ্কারিতে বহিষ্কৃত সাংসদদের আবেদনের ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্টের নোটিস জারি, সব সময়েই সরব থেকেছেন সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। ঝাড়খণ্ডের ক্ষেত্রে সোমনাথবাবু স্পষ্ট জানিয়েছিলেন, "আদালত লক্ষণরেখা লঙ্ঘন করছে"। আর বহিষ্কৃত সাংসদদের আবেদনের ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া নোটিস গ্রহণ-ই করেননি লোকসভার অধ্যক্ষ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। আরও পড়ুন- পরিবারের আপত্তিতে সোমনাথের দেহ যাচ্ছে না আলিমুদ্দিনে
সোমনাথবাবুর রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে আলোচিত পর্ব, দলের সঙ্গে তাঁর বিচ্ছেদ। লোকসভার অধ্যক্ষ হিসাবে তিনি যে দলীয় হুইপ-এর উর্ধ্বে তা জানাতে বিন্দু মাত্র দ্বিধা করেননি এই প্রবীণ কমিউনিস্ট নেতা। দল তাঁকে ইউপিএ(এক) সরকারের বিরুদ্ধে ভোট টিতে বললে, সোমনাথ জানিয়ে দেন, এ কাজ তাঁর পক্ষে সম্ভব না। কারণ হিসাবে তিনি অধ্যক্ষ পদের সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা ও নিরপেক্ষতার ধর্মের কথা বলেন। আর এতেই শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে সিপিআই(এম) থেকে বহিষ্কৃত হতে হয় তাঁকে। পরবর্তীকালে একসময়ের দলীয় সতীর্থদের সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগ রাখলেও, দলে ফেরার কথা ভাবেননি সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। আমৃত্যু দল থেকে বহিষ্কৃত সোমনাথের মনে দলের প্রতি অভিমানের পাহাড় জমলেও, দলের দূরবস্থা কষ্ট দিত জ্যোতি বসুর শিষ্য সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে। তবে, অভিমানের পলি এতটাই পুরু হয়েছিল যে মৃত্যুর পরও আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে রাজ্য সিপিএম-এর সদর দফতরে প্রয়াত নেতার দেহ নিয়ে যাওয়া হবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে তাঁর পরিবার। আরও পড়ুন- পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সোমনাথকে শেষ বিদায়, ঘোষণা মুখ্যমন্ত্রী মমতার