সৌমিত্র সেন


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

তিনি কাশ্মীরে বসে আমেরিকার স্বাধীনতা দিবসকে স্মরণ করে একটি কবিতা লিখলেন। সেটা ১৮৯৮ সাল। তারিখ তো সর্বজনবিদিত-- ৪ জুলাই। কবিতাটির নামও 'To The Fourth Of July'। কী আশ্চর্য সমাপতন! আর মাত্র চার বছর পরে এই ৪ জুলাইতেই তাঁর মহাপ্রয়াণ! 


তিনি স্বামী বিবেকানন্দ (Swami Vivekananda)। যখন প্রয়াত হলেন তাঁর বয়স ৩৯ বছর, ৫ মাস, ২৫ দিন। তাঁর মৃত্যু তো শুধু রামকৃষ্ণ মিশনের ক্ষতি নয়, রামকৃষ্ণ ভাবান্দোলনের ক্ষতি নয়, বাংলার ক্ষতি নয়, শুধু ভারতেরও ক্ষতি নয়; তাঁর মৃত্যু সমগ্র মানবজাতির ক্ষতি, মানবাত্মার ক্ষতি, মানবসভ্যতার ক্ষতি, মানবমুক্তির অন্তরায়।


আরও পড়ুন: যেন বাংলার যুযুধান রাজনীতির দিকে তাকিয়েই মহাবাণী উচ্চারণ করেছেন এই মহামানব!


কিন্তু তবুও যত বড় আঘাত-ই তা থাকুক না কেন, তা কিছুতেই আচমকা ছিল না। তিনি যে চল্লিশ পেরোবেন না, তা কথাপ্রসঙ্গে বেশ কয়েকবারই বলেছিলেন। মৃত্যুর বছর পাঁচেক আগে স্বামী অভেদানন্দকে  স্বামীজি বলেছিলেন, তিনি এ পৃথিবীতে আর পাঁচ বছর আছেন। এর অনেকটা পরে এসেছে নিবেদিতা-পর্ব। বেলুড় মঠে শিষ্যাকে নিমন্ত্রণ করে খাইয়েছেন এবং তাঁকে হাত ধোওয়ার জল পর্যন্ত দিয়েছেন! যা দেখে বিস্মিত (আহতও) নিবেদিতাকে তিনি স্মিতহাস্যে বুঝিয়েছিলেন, যিশু তাঁর শিষ্যদের পা ধুইয়ে দিয়েছিলেন! নিবেদিতার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠেছিল, তাঁর মুখ ফসকে বেরিয়ে এসেছিল, সে তো অন্তিম সময়ে! 


বিবেকানন্দের স্তরের মানুষের 'অন্তিম' বলে অবশ্য কিছু হয় না। কেননা, তিনি তো স্বয়ং বলেছিলেন, যতক্ষণ এ পৃথিবীতে একটিও মুক্তিকামী মানুষ থাকবেন, ততদিন তিনি নিজের মুক্তি তুচ্ছ করে সেই মুক্তিকামীর পাশে দাঁড়াবেন, তিনি জন্ম নেবেন, তিনি কাঁদবেন সেই দুঃখীর সঙ্গে। এ যেন সেই বৌদ্ধধর্মের কঠিনলভ্য 'অর্হত্ব'কে হেলায় পরিত্যাগ করে 'বোধিসত্ত্ব' হওয়ার আরও-আরও কঠিন-জটিল রক্তাক্ত অভিযাত্রা। বোধিচিত্তের উন্মীলন এবং সারা জগতের দুঃখ অনুভব করার আশ্চর্য সাধন।


ফলে অন্তরে বোধিদীপ-প্রজ্জ্বলিত বিবেকানন্দের মৃত্যু হয় না, অতএব 'মুক্তি'ও হয় না। হবেই-বা কী করে? তিনি তো 'চিরমুক্ত'ই। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর প্রিয়তম শিষ্যের জাত চিনিয়েছিলেন এই বলে-- 'নিত্যসিদ্ধের থাক', 'অখণ্ডের ঘর' 'হোমা পাখি'। বিবেকানন্দের মতো মানুষের প্রয়াণ বা দেহ-ত্যাগ তাই আসলে খোলস-ত্যাগ, তা প্রতীকী-মুক্তি। ১৯০২ সালের ৪ জুলাই দিনটি তাই দেহ-সীমায়িত বিবেকানন্দ আর শাশ্বত-বিবেকানন্দের মধ্যে স্রেফ একটা হাইফেন! 


তবু সেই 'হাইফেন'টুকু একটা ইঙ্গিতের মাধুরীতে পর্যবসিত। যার ধরতাই ওই 'To The Fourth Of July' কবিতা। কাশ্মীরে সেদিন ব্রেকফাস্টের টেবিলে স্বামীজি তাঁর আমেরিকান শিষ্যদের আবৃত্তি করে শুনিয়েওছিলেন স্বরচিত কবিতাটি। মনে হয়, শুধু স্ব-রচিতই যেন নয় এ কাব্য; দেশমুক্তির উদযাপনে রচিত এ পঙক্তিমালা যেন স্ব-মথিত, স্ব-রণিত, স্ব-যাপিত এক অলৌকিক বিচ্ছুরণ, যা প্রকারান্তরে তাঁর আঁতের কথা বলতে বলতে কোনও দূরতর হিমশৈলধসের ক্বচিত্‍ আভাস ছুঁড়ে দিয়েই পিছলে বেরিয়ে যায়।    


কী ছিল সেই ৪ জুলাই শীর্ষক পঙক্তিমালায়?


কবি-বিবেকানন্দ লিখছেন-- 'Behold, the dark clouds melt away,/That gathered thick at night, and hung/So like a gloomy pall above the earth!এই ভাবে শুরু হয়ে লিপিমালার চরণে-চরণে তিনি দাসত্ব ও পরাধীনতার বন্ধন থেকে মুক্তির লড়াইয়ের কথা বলতে বলতে এগোন। আনেন LIBERTY-র প্রসঙ্গ। মানবমুক্তির আলো ঝরে পড়ার কথা বলতে-বলতেই একেবারে শেষে এসে স্বামীজি লেখেন-- 'Move on, O Lord, on thy resistless path!/ Till thy high noon o'erspreads the world./ Till every land reflects thy light,/Till men and women, with uplifted head,/Behold their shackles broken, and/ Know, in springing joy, their life renewed!'


আমেরিকার (US)  স্বাধীনতা-দিবস উপলক্ষে রচিত কবিতায় তাঁর নিজের পরাধীন দেশের মুখচ্ছবিও কি ভেসে ওঠেনি? সেই যন্ত্রণাও কি তাঁকে কুরে কুরে খায়নি? হয়তো! না হলে লিখবেন কেন-- 'Till every land reflects thy light'? না, তবুও যেন কবিতাটি এই রাজনৈতিক মুক্তির পরিসরেই শেষ হয়ে যায় না; সে যেন আরও দূরতর উচ্চতর কোনও মুক্তির গানের আভাস দেয়। ঈশ্বরের যে অপূর্ব মধ্যাহ্নকে এই পৃথিবীর মাটিতে নেমে আসার কথা তিনি সেদিন লিখেছিলেন, তা তো প্রতিটি মানবাত্মার শৃঙ্খলভঙ্গের দীপ্তির সংকেত, তা যেন বন্ধন-খোলস ভেঙে আবার নতুন করে জীবনপ্রাপ্তির মহানন্দের উর্মিমালার মুক্তিগানের কথা বলে যায়।  যেন বলে যায়, এমনই এক  ৪ জুলাই আসছে... আসছে আরও কয়েক বছর পরে। 


এ কালের কবি দেবদাস আচার্য তাঁর 'চাষ' শীর্ষক কবিতায় লিখেছেন-- 'প্রকৃত চাষি জানেন সব বীজ মূলত একটিই বীজ/প্রাণবীজ/মানুষের পুষ্টিদানা বা/মাটির অঙ্কুর/সব একই সারাত্‍সার প্রাণ,-- দানাপ্রাণ অঙ্কুরপ্রাণ,/এভাবেই ভাবতে ভাবতে চষতে চষতে চাষি/বীজবিশ্ব বীজব্রহ্মের সন্ধান/মাটি ছেনে তুলে আনেন লাঙলের সমর্থ ফলায়'


তাই তো সারা জীবন ধরে করেছিলেন স্বামীজি। মাটি ছেনে তুলে এনেছিলেন নতুন নতুন অমর অজর 'সন্ধান'! তিনি তো এক শাশ্বত কৃষক। যে-কৃষক নিজের সমস্ত ত্যাগ-যন্ত্রণা-কষ্ট-ক্ষত-রক্ত ছেনে ছেনে লাঙলের সমর্থ ফলায় জাতিধর্মবর্ম নির্বিশেষে অখণ্ড মানবজাতির জন্য তুলে এনেছিলেন বীজব্রহ্ম! তাঁর সেই অ-মরণ অলৌকিক কৃষিকাজে এক ক্ষণিক বিশ্রাম যেন এই ৪ জুলাই! এর বেশি কিছু নয়!


(Zee 24 Ghanta App : দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির লেটেস্ট খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Zee 24 Ghanta App)


আরও পড়ুন: শ্রদ্ধাবীজ, জলপাত্র ও এক 'সম্বুদ্ধ' কৃষক'রত্নে'র কাহিনি