নিজস্ব প্রতিনিধি : কেউ একজন সোশ্যাল সাইটে লিখেছিলেন, অতঃপর ঈশ্বর এলেন জলপাই রঙের পোশাক পরে, হেলিকপ্টার চেপে। তাঁর বলা সেই কথাটা যেন পোশাকি ভাষায় ভারতীয় সেনাকে ভগবানের আসনে বসিয়েছিল। কেউ আপত্তি করেননি এমন পোস্টে। আপত্তি করার জায়গাও ছিল না। কারণ, জাগতিক দুনিয়ায় ঈশ্বর বলে কেউ থাকলে কেরলের ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতিতে ভারতীয় সেনার মতোই হয়তো উদ্ধারকার্যে ঝাঁপাতেন। যাই হোক, যাঁকে নিয়ে সারা দেশে গত কয়েকদিন ধরে হাজারো আলোচনা, প্রশংসা, কুর্ণিশ, ভারতীয় নৌসেনার কমান্ডার বিজয় বর্মা কিন্তু এখনও দিন-রাত এক করে উদ্ধারকাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। কেরলের বন্যায় আটকে পড়া এখ অন্তঃসত্ত্বা মহিলাকে উদ্ধার করেছিলেন তিনি। তাও প্রচণ্ড দুর্গম পরিস্থিতির মাঝে। অনেকেই হয়তো জানেন না, নৌসেনার পাইলট বর্মা সেদিন এক নয় দুজন মহিলাকে সঠিক সময় হাসপাতালে পৌঁছেছিলেন। আর তার পরেরদিন একই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করেছিলেন আরও দুজন অন্তঃসত্ত্বা মহিলাকে। কীভাবে চালিয়েছিলেন উদ্ধারকাজ, শুনুন কমান্ডার বিজয় বর্মার নিজের মুখে-


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

''১৭ আগস্ট সকালের দিকে আমরা ফোন পাই, মেডিক্যাল এমার্জেন্সি কেস রয়েছে। একজন মহিলা প্রসব যন্ত্রণা নিয়ে আটকে রয়েছেন। আমার ছোট হেলিকপ্টার কেরলের বন্যায় উদ্ধারকাজ চালানোর জন্য আদর্শ। কারণ ওটা আকারে খুব ছোট। এমন অনেক জায়গা যেখানে বড় কপ্টার পৌঁছতে পারে না সেখানে আমার ছোট্ট বাহন পৌঁছে যায় অনায়াসে। যাই হোক, লোকেশন পেয়ে তড়িঘড়ি রওনা হলাম আমরা চার জন। জায়গাটা আলুভার কাছে চোয়ারা রেলস্টেশনের সামনে এক মসজিদে। বন্যার মাঝে ওই মসজিদে রিলিফ ক্যাম্প হয়েছিল। কিন্তু বন্যার জলে রাস্তা, রেললাইন সবই ডুবে গিয়েছে। ওই এলাকায় অনেকক্ষণ আকাশপথে চক্কর কেটেও জায়গাটা ঠিক ঠাওর করতে পারছিলাম না আমরা। এদিকে, সময় অপচয় করা চলবে না। কয়েক মিনিটের মধ্যে উপর থেকে দেখলাম, এক জায়গায় অনেক মানুষ জটলা করে রয়েছেন। কপ্টার একটু নিচে নামিয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করলাম, মহিলা কোথায় রয়েছেন! উত্তর এল মসজিদের ভেতর।


আরও পড়ুন-  কেরলে বিদেশি সরকারের সাহায্য নেবে না ভারত, স্পষ্ট করল মোদী সরকার


জায়গাটা গাছপালা আর বিদ্যুতের তারে ভর্তি। তার উপর মসিদের ছাদে কপ্টার নামানোর মতো জায়গা নেই। আশেপাশে চারিদিকে দেখলাম জল ভর্তি। কপ্টার কোথায় নামানো হবে তা ভেবে পাচ্ছিলাম না আমরা। একটু পরে দেখা গেল, একটা ছোট্ট ব্যালকনি দেখা যাচ্ছে। আমি আর আমার কো-পাইলট ভেবে দেখলাম, উদ্ধার করতে হলে ওই ব্যালকনি দিয়েই করতে হবে। না হলে কোনও রাস্তা নেই। কিন্তু এত নিচে কপ্টার এনে এক জায়গায় সেটাকে ধরে রাখা সহজ কাজ ছিল না। একটু এদিক-ওদিক হলে মহিলাকে উদ্ধারের আগে আমরা চারজন কপ্টারসমেত মাটিতে আছড়ে পড়ব। কিন্তু আমা্র এই নিজের টিমের উপর ভরসা ছিল। আমরা এর আগেও বহু জায়গায় বন্যা পরিস্থিতিতে উদ্ধারকাজ চালিয়েছি। পাইলট জীবনের কুড়িটা মূল্যবান বছর আমি এই কাজই করে এসেছি। ফলি নিজের উপরও আস্থা ছিল, পারব। খবু ধীরে ধীরে কপ্টার নিচের দিকে নামিয়ে একটা জায়গায় রেখে দড়ি ফেলে প্রথমে ডাক্তারকে নামানো হল। তিনি মহিলার অবস্থা দেখলেন। প্রথমে ডাক্তারকে কপ্টারে ফেরত আনা হল। তার পর মহিলাকে। এক্ষেত্রে আমাদের অনেক হিসাব কষতে হয়েছিল। কারণ, হিসাবে গোলমাল হলে মহিলা দড়িসমেত মাটি থেকে উপরে উঠলেই উল্টো দিকে ঘুরতে থাকবেন। ওনার শারীরীক অবস্থা খুব খারাপ ছিল। ফলে এই ধকল তিনি নিতে পারবেন না। এক্ষেত্রে আমাদের কপ্টারের ডাইভার আসল কাজটা করল। 


আরও পড়ুন-  নাসার উপগ্রহে ধরা পড়ল কেরলের বর্ষণের ভয়াবহতা


সব মিলিয়ে ২৫-৩০ মিনিটের অপারেশন। আমরা সেই মহিলাকে প্রচণ্ড সতর্কভাবে কপ্টারে তুললাম। তার পর আর কোনওদিকে না তাকিয়ে প্রচণ্ড গতিতে কপ্টার নিয়ে ফিরলাম গারুদায় নৌসেনার বেসক্যাম্পে ফিরলাম। সেখানে অ্যাম্বুলেন্স তৈরি ছিল। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ওই মহিলাকে হাসপাতালে পৌঁছানো গেল। পথে আসতে আসতে শুনছিলাম, আরও একজন অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় ওই মসজিদ এলাকাতেই আটকে রয়েছেন। কিন্তু ওনার অবস্থা ততটা খারাপ নয়। তাই আগের মহিলাকে হাসপাতালে পৌঁছে আবার ফিরলাম ওই এলাকায়। একই পদ্ধতিতে আবার ওনাকেও উদ্ধার করা হল। পরের দিন আরও দুজনকে আমরা ওই ছোট হেলকপ্টারে করেই হাসপাতালে পৌঁছলাম।



এই ধরণের অপারেশন করে ফেরার পর শরীরে আর কিছু থাকে না। ক্লান্তি, ধকল যেন শরীরের প্রতিটা পেশিকে বিধ্বস্ত করে দেয়। একে তো কপ্টার থেক ঝুলে থাকা। তার উপর দড়ি বেয়ে নামা-ওঠা, নির্দিষ্ট একটা উচ্চতায় দীর্ঘক্ষণ ঝুলে থাকা, সব মিলিয়ে শরীরের এমন অবস্থা হওয়াই স্বাভাবিক। আমিও সেদিন শারীরীক ও মানসিক দিক থেকে বিধ্বস্ত হয়েই বেসক্যাম্পে পৌঁছলাম। তার পর একজন হঠাত্ করেই এসে বললেন, সরজিথা (মসজিদ এলাকার সেই অন্তঃসত্ত্বা মহিলা) সুস্থ এক পুত্র সসন্তানের জন্ম দিয়েছে। মুহূর্তে আমার শরীরের সমস্ত ক্লান্তি মুছে গেল। আবার উদ্ধারকাজে নামার জন্য নিজেক প্রস্তুত করে ফেললাম। আর মনে মনে নিজেকে বললাম, নিের জীবনটাকে সঠিক পথে চালিত করতে পেরেছি। সাবাশ মিস্টার বর্মা!