একরাত্রি আর একদুপুরের গল্প
ধ্রুবজ্যোতি অধিকারী
""রাত্রি প্রায় শেষ হইয়া আসিল - ঝড় থামিয়া গেল, জল নামিয়া গেল - সুরবালা কোনো কথা না বলিয়া বাড়ি চলিয়া গেল, আমিও কোনো কথা না বলিয়া আমার ঘরে গেলাম।
ভাবিলাম, আমি নাজিরও হই নাই, সেরেস্তাদারও হই নাই, গারিবালডিও হই নাই, আমি এক ভাঙা স্কুলের সেকেন্ড মাস্টার, আমার সমস্ত ইহজীবনে কেবল ক্ষণকালের জন্য একটি অনন্তরাত্রির উদয় হইয়াছিল - আমার পরমায়ুর সমস্ত দিন-রাত্রির মধ্যে সেই একটি মাত্র রাত্রিই আমার তুচ্ছ জীবনের একমাত্র চরম সার্থকতা।''
"একরাত্রি' গল্প শেষ। গল্পগুচ্ছ বইটা উল্টে নিজের বুকের ওপর রাখল অরিত্র। বিছানার পাশে দেওয়াল জুড়ে খোলা জানালা। তার পিছনে এক চিলতে বাগান। পাতায় পাতায় খেলা করছে সোনা রোদ। "আশ্চর্য রোম্যান্টিক ছিলেন রবি ঠাকুর! প্রেমিক হলে এমনই হতে হয়!' একথা ভাবতে ভাবতে অতীতে ফিরল অরিত্র। "একরাত্রি' গল্পের টাইম মেসিনে চড়ে।
সালটা ২০০৪। কোন মাস ছিল, আজ এত বছর বাদে তা আর মনে নেই। শুধু এটুকু মনে আছে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেন ক্যাম্পাসে রচিত হয়েছিল একটা মায়াবী দুপুর, যে দুপুর আজও অনন্ত হৃদয়ের আলো হয়ে বেঁচে আছে অরিত্রর স্মৃতিতে। প্রলয় রাতের অন্ধকারে কাছাকাছি এসেছিল সুরবালা আর ভাঙা স্কুলের সেকেন্ড মাস্টার। দু'হাজার চারের সেই দুপুরে কলেজস্ট্রিটে কাছাকাছি এসেছিল অরিত্র আর কৃত্তিকা।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতায় এমএ-তে ভর্তির এন্ট্রান্স টেস্ট। বারোটা থেকে পরীক্ষা শুরু। এগারোটার মধ্যে ক্যাম্পাসে হাজির অরিত্র। সিট পড়েছে আশুতোষ বিল্ডিংয়ের দোতলায়। রুম নম্বর খুঁজে নিয়ে নির্দিষ্ট সিটে গিয়ে বসল সে। মফস্বলের ছেলে। ভিতরে চাপা টেনশন। আশপাশে তাকিয়ে বাকি পরীক্ষার্থীদের দেখছিল সে। কেউ চিন্তামগ্ন, কেউ আবার আড্ডার মেজাজে!
পরীক্ষা শুরু হতে পনেরো মিনিট বাকি। হঠাত্ আবির্ভূত হল সে। "এল' না বলে "আবির্ভূত হল' বলাই ভাল। সরস্বতী ঠাকুরের মতো গায়ের রং। পরনে সাদা সালোয়ার। চোখে চশমা। চিবুকের ডানদিকে ছোট্ট তিল। যেন ছোট্ট একখানি নতুন নৌকো, পরীক্ষা সাগরে ভাসতে ভাসতে আশুতোষ বিল্ডিংয়ের এই ঘরে এসে ভিড়েছে।
নৌকোর সঙ্গে অবশ্য মাঝিও ছিল। অরিত্র দেখল, মেয়েটির অভিভাবক হিসেবে সঙ্গে এসেছেন এক তরুণ। দাদা নাকি বয়ফ্রেন্ড? মেয়েটির চোখে লাজুক ভাব, মুখে উত্কণ্ঠা। বাবা-মাকে ডিঙিয়ে প্রেম করার কলজে এমেয়ের আছে বলে তো মনে হয় না! ভাবল অরিত্র।
ক্লাসরুমে ঢুকে নিজের আসন খুঁজছিল "আবির্ভূতা', অত্যন্ত সসঙ্কোচে। ডেস্কের ওপর কাগজে সাঁটা রোল নম্বর হাতড়াতে হাতড়াতে আমার পিছনে এসে দাঁড়াল তার সঙ্গী তরুণ। "আয় মাম্পি এখানে বোস।'
আনন্দে আর বিষাদে মাখামাখি হয়ে গেল অরিত্রর মন। আনন্দ এই ভেবে, যে মেয়েটি তাকে মুগ্ধ করেছে সে কাছাকাছি এল। বিষাদের কারণ, পরীক্ষা মাত্র দু'ঘণ্টার। শেষ ঘণ্টা বাজলেই অমৃত সান্নিধ্যে ইতি। অরিত্র বুঝতে পারল, মেয়েটি পরীক্ষা দিতে এসে তার হৃদয়ের সিংহাসনে চড়ে বসেছে।
মুগ্ধ হওয়ার আরও ছিল বাকি। প্রথম প্রশ্নটা এল পিছনের বেঞ্চ থেকেই। "আপনি কোন ইউনিভার্সিটি' ?
"বর্ধমান, আপনি'? উত্তর দিয়েই পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ল অরিত্র। দু-এক কথার পরিচয়। ঢং ঢং করে বেজে উঠল পরীক্ষা শুরুর ঘণ্টা। টিচার এসে প্রশ্নপত্র দিলেন। দেখা গেল, সিট নম্বর দিয়ে ভালবাসার যে পথের সূচনা হয়েছিল, প্রশ্নপত্রে সেই পথ আরও প্রশস্ত হয়েছে। মাল্টিপল চয়েস অবজেকটিভের উত্তর দিতে হবে পেনসিলে টিক দিয়ে। পেনের আঁচড় চলবে না।
কিছুক্ষণের মধ্যেই পিছন থেকে আবার প্রশ্ন। "আপনার কাছে এক্সট্রা পেনসিল হবে?' যেন জীবন ধন্য হয়ে গেল অরিত্রর। বাড়তি পেনসিল তার কাছে ছিল। নতুন পেনসিলখানি মেয়েটিকে দিল। নিজে নিল অর্ধেক ক্ষয়ে যাওয়া পেনসিল।
"আপনার কাছে ইরেজার হবে?' এবার আরও খুশি অরিত্র। তার আনা প্রতিটি জিনিসই যে এভাবে সার্থক হয়ে উঠবে, কে ভেবেছিল! আবেগের আতিশয্য মেয়েটিকে বুঝতে দিল না অরিত্র। ইরেজার দিয়েই উত্তরপত্রে মন দিল সে।
পরীক্ষার মাঝামাঝি সময়ে আবার পেছন থেকে ডাক! "আমার পেনটা প্রবলেম করছে। আপনার কাছে কালো কালির পেন হবে?' ভাগ্যচক্রে চাহিদামতো জোগান ছিল অরিত্রর ভাণ্ডারে। বাড়তি পেন মেয়েটিকে দিল সে। মনে মনে একটু বিরক্তও হল। "এর কি সিরিয়াসনেস বলে কিছু নেই! পরীক্ষা দিতে চলে এসেছে কিছুই না নিয়ে!' একথা ভাবার পরক্ষণেই আবার ভিজে গেল মনটা। যাক, একজনের কাজে তো লাগল।
আর পাঁচ মিনিট। জানিয়ে দিলেন টিচার। "ও তাহলে বিচ্ছেদের সময় আসন্ন।' মন খারাপ হয়ে গেল অরিত্রর। এই সোয়া দু'ঘণ্টায় মেয়েটি তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে।
ঢং। বাজল শেষ ঘণ্টা। একে একে খাতা জমা দিল সবাই। অরিত্র দেখল, মেয়েটি তার জন্য দাঁড়িয়ে। "কেমন হল পরীক্ষা? আপনাকে বারবার ডিস্টার্ব করলাম।' অরিত্র হেসে মাথা নাড়ল।
রবিবারের ক্যাম্পাস কিছুক্ষণের মধ্যেই ফাঁকা হয়ে গেল। মেয়েটির গার্জেন দাদা তখনও এসে পৌছননি। ওকে একা ফেলে রেখে চলে যেতে মন চাইছিল না অরিত্রর। মেয়েটি কি বুঝতে পারছে তার ভিতরের যন্ত্রণা? ওর মনের ভেতরেও কি কিছু হচ্ছে? জানতে খুব ইচ্ছা করছিল অরিত্রর।
"দেখেছেন আপনার নামটাই জানা হয়নি!' ... "কৃত্তিকা'।
"আমার নাম অরিত্র। বাড়ি বীরভূমে।'
"আমার চন্দনগরে।'
টুকরো টুকরো কথাই অরিত্রর কাছে হয়ে উঠল - প্রেমের প্রথম কদমফুল।
"দেখেছেন দাদা এখনও এল না!'
দাদা? যাক ঠিকই আছে তাহলে। কিছুটা যেন স্বস্তি পেল অরিত্র। তার মনে হল, দাদা যেন ভগ্নদূত হয়ে কখনও না আসে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেন গেটে দুপুরের এই সময়টুকু যেন শেষ না হয়!
কিন্তু শেষ হল। আড়াই নাগাদ দাদা এসে নিয়ে গেল বোনকে। "আসি' বলে মাথা নীচু করে চলে গেল কৃত্তিকা। হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে রইল অরিত্র। সে জানে, "আসি' বলে গিয়েও সবাই ফিরে আসে না।
টিং টিং। ঘণ্টি বাজিয়ে এসে দাঁড়াল ট্রাম। ঘোর ভাঙল অরিত্রর। মনে হল বইপাড়ার এচরাচরে সে একেবারে একা। নিজের অন্দরে কান পেতে শুনতে পেল,
""আমার বলে রইল শুধু
বুকের মধ্যে মস্ত ধুধু। ''
বুকের ওপর উল্টে রাখা "গল্পগুচ্ছ' আবার চোখের সামনে মেলে ধরল অরিত্র। হাত বোলাল প্রিয় লাইনগুলোয়।
"স্বামীপুত্র গৃহধন জন লইয়া সুরবালা চিরদিন সুখে থাকুক। আমি এই এক রাত্রে মহাপ্রলয়ের তীরে দাঁড়াইয়া অনন্ত আনন্দের আস্বাদ পাইয়াছি।'
সেলাম রবি ঠাকুর। মনে মনে বলল অরিত্র।