দিব্যেন্দু ঘোষ


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

আঁধার যখন কালো পিচের রাস্তা বেয়ে হেঁটে চলে, নিঃঝুম, নিস্তরঙ্গ চৌরঙ্গী রোড যখন গা এলিয়ে পড়ে থাকে, ঠিক তখনই দূর থেকে ভেসে আসে ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ। অন্ধকারের বুক চিরে মিশমিশে কালো গা, তাগড়াই ঘোড়াটা ছুটে আসতে আসতে জানান দিতে থাকে, দ্য নাইট ইজ স্টিল অ্যালাইভ। আই এম হিয়ার টু সেভ ইউ। চওড়া কাঁধ, পেটাই বুক, সরু কোমর আর ভাবলেশহীন ভরাট মুখটা ক্রমেই স্পষ্ট হতে থাকে। যেন মাটি ফুঁড়ে কোনও দেবদূতের আবির্ভাব। শয়তানের দল, অপরাধীর দল ওই ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ চিনত। নিঃশব্দে কেটে পড়ত। শুনশান রাস্তায় পায়চারি দিত ভারী বুট। খট......খট.......খট। রাত বাড়লে আওয়াজটাও বাড়ত। গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল থেকে কার্জন পার্ক হয়ে ধর্মতলা ছুঁয়ে গ্র্যান্ড হোটেলের পাশ দিয়ে পার্ক স্ট্রিট, গোটা চৌরঙ্গী রোড যেন জেগে থাকত। অপরাধ পিছু হটত। হাতে শুধু একটা লাঠি। সেটাই কাফি। গুন্ডা দমন তাঁর কাছে ছিল জলভাত। তাঁকে দেখলেই ছত্রভঙ্গ হয়ে যেত দাঙ্গাবাজরা। তিনি একাই একশো। ময়দানের প্রতিটি ঘাস, প্রতিটি ইট তাঁকে চিনত। বক্সিং রিংয়ে যেমন তাঁর সপাট ঘুসিতে ধরাশায়ী হত প্রতিপক্ষ, ঠিক তেমনই কলকাতা পুলিসের পোশাকে পিটিয়ে ছাতু করে দিতেন মার্কামারা অপরাধীদের। রনি মুর নাম শুনলেই বুকটা তাই ছ্যাঁত করে উঠত দাঙ্গাবাজদের। কলকাতা পুলিসের কিংবদন্তি এই অফিসারের জন্মশতবর্ষ নিঃশব্দে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার সময় হলদে পাতার ভাঁজ থেকে তুলে আনা না-জানা কত কথা।


চুনী গোস্বামী একবার গল্প করেছিলেন। সময়টা ষাটের দশকের শুরু। চিড়িয়াখানায় মাহুতকে মেরে তাণ্ডব চালাচ্ছিল এক দাঁতাল। ডাক পড়ল রনি মুরের। বেয়াদব হাতিকে শায়েস্তা করতে ভালই জানতেন তিনি। অসম-ত্রিপুরায় পাগলা হাতিকে বাগে আনতে রনির ছিল জুড়ি মেলা ভার। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে চিড়িয়াখানার সেই মত্ত হাতিকে ধরাশায়ী করেন কলকাতা পুলিসের দুরন্ত মাসলম্যান।


আরও পড়ুন- গল্পস্বল্প: জলে নেমেও বাঙালি সোনা আনতে পারে, ১০০ বছর আগেই শিখিয়েছেন শচীন
 


কলকাতার প্রাক্তন পুলিস কমিশনার গৌতমমোহন চক্রবর্তী রনিকে কিংবদন্তি বলেই উল্লেখ করেন। লালবাজারের অলিন্দে রনিকে নিয়ে যে কত গল্প, কত বীরগাথা। উন্মত্ত জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে কতবার যে একা বেরিয়ে গিয়েছেন হাতে শুধু একটা লাঠি নিয়ে। সাধারণ মানুষের কাছে তিনি দেবদূত আর দুষ্কৃতীদের কাছে মূর্তিমান বিভীষিকা। পঞ্চাশ-ষাটের দশকে রনি মুরের নাম শুনলেই দাঙ্গাবাজদের শিরদাঁড়া দিয়ে নেমে যেত ঠান্ডা স্রোত। একা রনি ঘোড়ার পিঠে চেপে তাড়া করতেন দাঙ্গাকারীদের। কখনও তর্কাতর্কিতে জড়াতেন না। কখন কোন কাজটা করা দরকার, সেটা বিলক্ষণ জানতেন। হাতের তালুর মতো চিনতেন সেই সময়ের কলকাতার অপরাধ জগত্‍কে। অপরাধীদের কাছে তিনি ছিলেন সাক্ষাত্‍ যমদূত।


আরও পড়ুন- গল্পস্বল্প: মহানায়কের মৃত্যুর ঠিক ২৪ ঘণ্টা আগে...


রনি মুর ছিলেন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান। এই দেশেই জন্ম। এখানেই বেড়ে ওঠা। ছোট থেকেই স্বপ্ন দেখতেন অ্যাডভেঞ্চারের। জীবনটা ছিল ঘোড়দৌড়ের মাঠ। জীবনটা ছিল একটা বক্সিং রিং। বক্সিং রিংয়ে প্রতিটা মার তাঁর চোয়াল শক্ত করেছে। জীবনকে পোক্ত করেছে। সেই অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় কলকাতা পুলিসের উর্দি গায়ে চাপিয়েও বক্সিং রিংকে ভুলতে পারেননি। রোনাল্ড অ্যালেন মুরের প্রথম কাজ অবশ্য ছিল রেলের ফায়ারম্যানের। ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলের দূরপাল্লার ট্রেনের চালক ছিলেন বাবা। বাবাকে দেখেই রেলের চাকরিতে ঢোকা। মা চাইত না, ছেলে রেলে চাকরি করুক। সুস্বাস্থ্যের অধিকারী রনি সোজা চলে আসেন কলকাতা। সটান লালবাজার। পরীক্ষা, ইন্টারভিউয়ের পর পুলিসের প্রশিক্ষণ। ১৯৪১ এর দোসরা এপ্রিল, ২৪৭ লোয়ার সার্কুলার রোডের পুলিস ট্রেনিং স্কুল থেকে শুরু। পরের ৩৬ বছর শুধুই উত্থানের ইতিহাস। 


আরও পড়ুন- গল্পস্বল্প: সে দিন মিটু থাকলে বায়োস্কোপে প্রথম যৌন হেনস্থার শিকার হয়তো কাননদেবীই


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হাওড়ায় মার্কিন সেনা ক্য়াম্পে বক্সিং ট্রেনিং শুরু। সেখানেই দেখা লেস্টার কার্টারের সঙ্গে। যিনি সেই সময়ের ওয়ার্ল্ড হেভিওয়েট বক্সিং চ্যাম্পিয়ন জো লুইসের ট্রেনিং পার্টনার ছিলেন। রনি বক্সিংয়ের ঘাঁতঘোত শিখতে থাকেন কার্টারের কাছ থেকে। ৬ মাস পর কলকাতা পুলিসের মাউন্টেড বাহিনীতে পদোন্নতি।



১৯৪২-এ রাতে টহল দেওয়ার সময় ট্রামের সামনে পড়ে যান রনি। ট্রামের ধাক্কায় তাঁর ঘোড়াটি মারা যায়। পিঠে মারাত্মক চোট পান রনি। প্রায় ৬ সপ্তাহ হাসপাতালের বিছানায় কাটাতে হয়। তার পর ফের বক্সিং রিংয়ে ফিরে আসা। একের পর এক লড়াই থেকে ছিনিয়ে আনতে থাকেন জয়। 


গ্র্য়ান্ড হোটেলে শচীন বোস ধরাশায়ী। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের গ্যারিসন থিয়েটারে কেনেথকে নকআউট। গ্লোব থিয়েটারে তাঁর এক ঘুসিতেই কুপোকাত মার্কিন সেনাবাহিনীর আর রবার্টসন। ফোর্ট উইলিয়ামে তাঁর ঘুসি আছড়ে পড়ে জর্জ প্রিমের গালে। সঙ্গে সঙ্গে নকআউট। বক্সিং রিংয়ে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠতে থাকেন রনি। আর নিজের কর্মদক্ষতার জোরে কর্মস্থলে এগোতে থাকেন তরতর করে। সার্জেন্ট থেকে সার্জেন্ট মেজর, ইনস্পেক্টর, অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার থেকে কলকাতা আর্মড পুলিশের ডেপুটি কমিশনার। যেন স্বপ্নের যাত্রা। যার প্রতিটি পরতে পরতে মিশেছিল এক অদম্য সাহসী যুবকের ময়দানে সঙ্গে জায়গা করে নেওয়ার গল্প।


আরও পড়ুন- গল্পস্বল্প: ফ্যাতাড়ুরা যে কখন বিস্ফোরণ ঘটাবে সরকারও টের পাবে না!
 


১৯৪৬-এর দাঙ্গা দমনের জন্য রনি মুর চিরকাল মনে থেকে যাবেন। কলকাতার রাস্তায় তখন লড়াই, রক্ত আর আতঙ্ক। এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে শুধু গায়ের জোরই যথেষ্ট নয়। চাই ঠান্ডা মাথা, বুদ্ধি আর বিশেষ দক্ষতা। কারণ, একটু এদিক ওদিক হলে আগুন আরও বাড়তে পারে। সেই কাজটাই প্রায় একার হাতে করেছিলেন রনি মুর। বন্দুক, গোলা-বারুদ কিচ্ছু নয়। স্রেফ লাঠির জোরে জয় করেছিলেন সেই কঠিন মুহূর্তকে। সবাই অবাক হয়ে দেখেছিল এক তরুণের বীরত্ব। দাঙ্গা দমনে কলকাতা পুলিস বাহিনীর জন্য হালকা ধাতুর ঢাল তৈরি করিয়েছিলেন রনি। তার পর থেকেই রনি মুর হয়ে গেলেন জীবন্তু কিংবদন্তি। প্রতিটা মানুষ সম্ভ্রমের সঙ্গে উচ্চারণ করত নামটা। কাজের প্রতি নিষ্ঠা, পরিশ্রম ও ব্যক্তিত্বই তাঁকে করে তুলেছিল কিংবদন্তি। হয়ে উঠেছিলেন দ্য ওয়ান অ্যান্ড অনলি রনি মুর।


আরও পড়ুন- গল্পস্বল্প: “বিধান তুমি থাকতে আমার শ্যামা ভুল চিকিৎসায় মারা গেল”


ঘোড়দৌড়ের ট্র্যাক, বক্সিং রিং এবং কলকাতা পুলিস। রনি মুরের জীবন এই তিন সুতোর নিপাট বুননে গাঁথা হয়ে যায়। কলকাতাবাসীর কাছে একজন জলজ্যান্ত স্টার, কিংবদন্তি। ১৯৫২ এবং ১৯৫৭, অ্যামেচার হেভিওয়েট বক্সিংয়ে দুবারের ভারতসেরা। অলিম্পিকের জন্য দুবার তাঁর নাম বাছাই হয়। একজন খেলোয়াড়ের কাছে এর থেকে বড় মঞ্চ আর কী হতে পারে। কিন্তু সেই ডাকও হেলায় ফিরিয়ে দেন রনি মুর! সবাই অবাক হয়ে তাকিয়েছিল মানুষটির দিকে। কাজে ব্যাঘাত ঘটবে, কলকাতা ছেড়ে দূরে চলে যেতে হবে। তাই আর যাননি অলিম্পিকে। ইলেকট্রিকের তারে জড়িয়ে যাওয়া যুবককে খোলা হাতে বাঁচিয়ে ফিরিয়ে আনা রনির কাছে কলকাতা পুলিসই ছিল শেষ কথা। কলকাতা শহর ছিল প্রাণের চেয়েও প্রিয়।


আরও পড়ুন- গল্পস্বল্প: প্রেম, দাম্পত্য, বিচ্ছেদ- তসলিমাকে নিজের হাতে গড়েছিলেন কবি রুদ্র


১৯৭৭-এ বুট আর গ্লাভস চিরকালের জন্য তুলে রাখেন রনি মুর। কর্তব্য, সম্মান আর দেশকে সবার ওপরে রেখেছেন বরাবর। কিন্তু শেষ জীবনে কিছুটা অভিমানী হয়ে পড়েছিলেন বোধহয়। কলকাতার অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সমাজ থেকে অনেক দূরে চলে যান। লালবাজারের লাল বাড়িটা যাঁর কাছে ছিল সব, সেই কিংবদন্তি পুলিস অফিসার রোনাল্ড অ্যালেন মুর শেষ বয়সে অনেক দূরে চলে যান। ২০১৩-য় অস্ট্রেলিয়ার পার্থে ৯৩ বছর বয়সে জীবনাবসান। ২ অগস্ট, ওয়ার্ল্ড অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ডে-তেই চলে যান অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সমাজের অন্যতম সেরা পুরুষ। কয়েকশো কিলোমিটার দূরে কলকাতাও কেঁদেছিল। এমন মানুষই বোধহয় মিথ হয়ে থেকে যান।