Purba Bardhaman: `ক্ষম মোরে ক্ষম`! স্বামীখুনে যুক্ত মনুয়া এখন রবিঠাকুরের শ্যামা...
Purba Bardhaman: বর্ধমান কারাগারের নিঃশব্দ অন্তরালে কি আর এক নাইজেলের জন্ম হতে চলেছে? জীবনের যত পাপ, যত সন্তাপ সব মুছে ফেলে মনুয়া মজুমদারের জীবনকে ঘিরে কি আর এক মুক্তধারার গল্প জন্ম নেবে?
পার্থ চৌধুরী: বর্ধমান কারাগারের নিঃশব্দ অন্তরালে কি আর এক নাইজেলের জন্ম হতে চলেছে? যত পাপ, যত সন্তাপ সব মুছে ফেলে মনুয়া মজুমদারের জীবনকে ঘিরে কি আর এক মুক্তধারার গল্প জন্ম নিচ্ছে? হ্যাঁ, এমন সম্ভাবনার কথা উঠছে, কেননা, বারাসতের হৃদয়পুরের সেই মনুয়া এখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'শ্যামা'। প্রেমিকের সঙ্গে হাত মিলিয়ে স্বামীকে নৃশংস ভাবে খুনের ঘটনায় সাজাপ্রাপ্ত মনুয়া পূর্ব বর্ধমান সংশোধনাগারে বন্দি এখন। ২০২১ সালে এখানে আসে সে। বন্দি, কিন্তু বন্ধ নয়; বরং নিজের ভিতরে ঢাকা-চাপা পড়ে থাকা ছোটখাটো ভালোলাগা-দক্ষতা-প্রতিভাগুলি যেন অর্গলমুক্ত ধারার মতো বইতে শুরু করেছে নতুন করে। তাই উঠছে এই মুক্তধারার প্রসঙ্গ!
আরও পড়ুন: Poush Mela Santiniketan: মেলার মাঠেই এ বছর আয়োজন হবে পৌষ মেলার! তবু কেন ক্ষুব্ধ স্থানীয় মানুষ?
উঠবে নাই-বা কেন! পূর্ব বর্ধমান সংশোধনাগারে আসার পর থেকেই মনুয়ার মধ্যে নানা প্রতিভার স্ফূরণ দেখতে পান আধিকারিকরা। মনুয়া নাচে, মনুয়া সাহিত্যপ্রেমী, একটি পত্রিকার সম্পাদনার সঙ্গেও সে যুক্ত। পুজো বা যে কোনও ইভেন্টে নেয় নেত্রীর ভূমিকা। ভাবনার যাপনের নানা পরত অন্ধকার-নেমে-আসা তার জীবনের মাটিতে আলোর অঙ্কুর ফোটায়।
২০১৭ সালের স্বামীখুনের ঘটনা এখন তার কাছে অতীত। গত ১ ডিসেম্বর বর্ধমানে খাদ্যমেলার মাঠে মনুয়ার নৃত্য পরিবেশন এখন সেখানে প্রায় 'টক অফ দ্য টাউন'। কখনও 'আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে' কখনও 'আলোকের এই ঝর্ণা ধারায়' গানে নৃত্য পরিবেশন করে দর্শকদের মোহিত করে রাখে মনুয়া। কখনও একক পরিবেশনায় 'মাধুরী মুরুতি' গানে নেচে মঞ্চ মাতায় সে।
এর আগেই সে রবীন্দ্রনাথের শ্যামা হয়েছে। 'ক্ষমা করো নাথ, ক্ষমা করো/এ পাপের যে অভিসম্পাত' ইত্যাদি অনুভব এখন তার নৃত্যের মাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে।
কারা দফতরের এক আধিকারিক জানিয়েছেন, মনুয়ার মধ্য প্রতিভা আগে থেকেই ছিল। সংশোধানাগারে বন্দিদের নানাভাবে ভিন্ন জীবনের ছোঁয়া দিতে চান তাঁরা। তারই সূত্র ধরে দেওয়া হয় নৃত্য প্রশিক্ষণও। এখানে প্রশিক্ষণ দেন মেহবুব হাসান। তরুণ হলেও ভারত-বাংলাদেশে পরিচিত বর্ধমান কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারের নৃত্য প্রশিক্ষক এই মেহবুব। মনুয়া নিয়ে তাঁকে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, 'আমার কাছে সবাই সমান, ও ছোট থেকেই নাচ করত। ভরতনাট্যম শিখত। ফলে অন্যদের যেটা আমাকে কষ্ট করে শেখাতে হয়, মনুয়ার ক্ষেত্রে সেটা করতে হয় না। যারা কোনও ভুল করে ফেলেছে তারা যাতে আবার জীবনের মূল স্রোতে ফিরতে পারে সেই চেষ্টাটাই করি আমরা। এখানে মনুয়া বা যারা এখন আছে তারা প্রত্যেকেই মনোযোগী। মনুয়া যদি চর্চাটা করে যায় তবে আমরা হয়তো আবার একজন নাইজেলকে পাব।'
বর্ধমান কেন্দ্রীয় সংশোধনাগার সূত্রে খবর, অষ্টমীর দিন একটি সাময়িকী প্রকাশিত হয়েছে সেখানে। নাম 'মুক্তমনে'। সংশোধনাগারের আবাসিকেরা তাতে খোলা মনে নিজেদের কথা লিখেছেন। ওই 'মুক্তমনে'র সম্পাদক করা হয়েছে মনুয়াকে। আধিকারিকেরা দেখেছেন, বাংলা সাহিত্যে দখল রয়েছে মনুয়ার। তাই জেল সুপার মনুয়াকে সম্পাদনার দায়িত্ব দিয়েছেন বলে জানা যায়।
এ বছরই জেলে দুর্গাপুজো উপলক্ষে সাংস্কৃতিক নানা অনুষ্ঠান হয়েছিল। সেখানে কেউ আবৃত্তি করেছে, কেউ গান গেয়েছে। স্বল্পদৈর্ঘ্যের একটি নৃত্য আলেখ্য পরিবেশিত হয়েছিল মহিষাসুরবধ নিয়ে। তাতে বিশেষ ভূমিকা ছিল মনুয়ার।
তবে এ কোনও কিছুই হঠাৎ নয়, নতুন নয়। জানা গিয়েছে, দমদম কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে থাকাকালীনই মনুয়ার এই নানা প্রতিভার চিহ্ন প্রথম দেখা দিয়েছিল। দমদম কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারের উদ্যোগে শুরু হওয়া 'দমদম রেডিয়ো'তে রেডিয়ো জকির ভূমিকায় দেখা গিয়েছিল মনুয়াকে। মহিলাদের ক্রিকেটে স্কোরারের ভূমিকাতেও ছিল সে। তখনই নৃত্যশিল্পী হিসেবেও সংশোধনাগারে অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিল। পরে বর্ধমান কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে স্থানান্তরের পরে সেখানেও নানা কর্মসূচিতে যুক্ত থাকার ইচ্ছার কথা সে জানিয়েছিল সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। যুক্ত রাখাও হয়েছে তাকে।
মনুয়া এখন জেলের মহিলা আবাসিকদের নিয়ে নানা কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত থাকে। মহিলা আবাসিকদের সঙ্গে মনুয়ার সম্পর্ক খুব নিবিড়।
আরও পড়ুন: Bankura: বছরের পর বছর ধরে গুদামে পড়ে নষ্ট হচ্ছে কয়েকশো বস্তা জৈব সার, ক্ষোভ চাষিদের মধ্যে...
২০১৭ সালের ২ মে রাতে বারাসতের হৃদয়পুরে নিজের বাড়িতেই খুন হন এক বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় সংস্থায় কর্মরত অনুপম সিংহ। পরের দিন দেহ উদ্ধার করে তদন্তে নামে পুলিস। খুনের ১৩ দিনের মাথায় প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে বারাসত থেকে মনুয়া মজুমদার (সিংহ) এবং তার প্রেমিক অজিতকে গ্রেফতার করে পুলিস। প্রাথমিক তদন্তে পুলিস জানতে পেরেছিল, অজিতের সঙ্গে মনুয়ার বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের জেরেই অনুপমকে নৃশংস ভাবে খুন করে অজিত। তবে সেসব এখন অতীত মনুয়ার জীবনে। সে এখন সেসব ভুলে যেন নতুন করে বাঁচতে চাইছে। দস্যু রত্নাকর একদিন যেভাবে বাল্মীকি হয়ে উঠেছিলেন, অনেকটা যেন সেভাবে। অতীতের ভুলের বল্মীক ভেদ করে যেন জন্ম হচ্ছে এক রত্নের! তার অন্তরাত্মা তাই যেন বলছে-- 'এসেছি প্রিয়তম, ক্ষম মোরে ক্ষম,/ গেল না, গেল না কেন কঠিন পরান মম--/ তব নিঠুর করুণ করে! ক্ষম মোরে'।
(দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির টাটকা খবর, আপডেট এবং ভিডিয়ো পেতে ডাউনলোড-লাইক-ফলো-সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের App, Facebook, Whatsapp Channel, X (Twitter), Youtube, Instagram পেজ-চ্যানেল)